গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে তিনজন সাঁওতালের মৃত্যুর সুষ্ঠু বিচার করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের কাঠগড়ায় আনতে হবে, সর্বোপরি আদিবাসীদের নিরাপত্তা দিতে হবে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের রংপুর চিনিকলের জমির মালিক সাঁওতাল এবং স্থানীয় দরিদ্র মানুষের বাপ-দাদারা।খতিয়ান অনুযায়ী, জমির মালিকানায় নাম রয়েছে সাঁওতালদের বাপ-দাদাদের।
৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। এতে তিন সাঁওতালের মৃত্যু এবং পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়। এরপর সচেতন নাগরিকবৃন্দ ব্যানারে নাগরিক প্রতিনিধিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে ফিরে অ শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন তাঁরা। সেখানেই এসব দাবি তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমীন মুরশিদ প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বলেছেন, ৩০০ বছর ধরে রাষ্ট্র আদিবাসীর ওপর অত্যাচার করে যাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা যখনই ঘটে, সরকার চোখ বন্ধ করে থাকে। আদিবাসীরা সৎ। এ জন্য তারা তিরের ডগায় বিশেষ কিছু ব্যবহার করেনি। ব্যবহার করলে যারা তিরবিদ্ধ হয়েছে, তারা সবাই মারা যেত। অথচ পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে তিনজনকে হত্যা করেছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ মারা গেছে কি না, তা জানা যায়নি।সাড়ে পাঁচ হাজার একর জমির মধ্যে সাড়ে চার হাজারই সাঁওতালদের। সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা ভিত্তিহীন। অর্থনৈতিক অঞ্চল করার যে শর্ত, তাতে বলা আছে তিন ফসলি জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে না। সাঁওতালদের জমিগুলো সবই তিন ফসলি। অর্থনৈতিক অঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক থাকতে হবে। কিন্তু এসব জমির ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে তা নেই। নাব্যতাসহ নদী থাকতে হবে, সেটাও নেই। যারা আদিবাসীদের ওপর হামলা করেছে, আগুন দিয়েছে, এরা রাজাকার, আলবদর।
ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর সঙ্গে কথা বলেছি। এর সমাধান চাই। জবাবে তিনি বলেছেন, আমি সাঁওতালদের উচ্ছেদ চাই। তাঁর কণ্ঠে আইয়ুব খানের কণ্ঠস্বর শুনেছি। এটা সাম্প্রদায়িক দম্ভোক্তি। বঙ্গবন্ধুর দলের সরকারের এ ধরনের দম্ভোক্তি শোভা পায় না। প্রশাসনের যারা এ হত্যাকা-ে জড়িত, তাদের বরখাস্ত নয়, শাস্তি দাবি করছি।লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সরকার হতদরিদ্র সাঁওতালদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর মতো বল প্রয়োগ করে যাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটল, সেটার তদন্ত চাই।
সংবাদ সম্মেলনে সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকে সাত দফা দাবি তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে তিনজন সাওতালের মৃত্যুর সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে; এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে; নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত সব পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, পূর্ণ নিরাপত্তাসহ আবারও তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে বসবাসের পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে হবে; সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার সার্বিক দায়দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে; সব মিথ্যা মামলা অনতিবিলম্বে বাতিল করতে হবে এবং আদিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; বাপ-দাদার ভিটায় আদিবাসীদের প্রতিষ্ঠা করা ফুলমনি মুরমু শিশু শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র সরকারি খরচে নির্মাণ করতে হবে এবং ঘটনার জন্য দায়ী স্থানীয় প্রশাসনকে অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।’গাইবান্ধায় সাঁওতালদের ওপর অমানবিক নির্যাতনে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দুর্ভোগ পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা ও নাগরিকদের করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানান সচেতন নাগরিকবৃন্দ।
এতে সচেতন নাগরিকবৃন্দের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।গত ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। এতে ৩ সাঁওতাল নিহত হন।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ জমির মালিক সরকার দাবি করা হলেও সাঁওতালদের দাবি, এ জমি তাদের পূর্বপুরুষদের।সচেতন নাগরিকবৃন্দ’র লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘সরকারের মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে অনেকে মিডিয়ার সামনে বলেছেন এই জমি কখনও সাঁওতালদের ছিল না। এটি সম্পূর্ণ অসত্য ও জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল। আমরা যে কথাটি বলতে চাই, তা হল- এটা সাঁওতাল এবং স্থানীয় দরিদ্র মানুষের বাপ-দাদার জমি। আমরা এই জমির খতিয়ান কপি পেয়েছি।’এতে বলা হয়, ‘খতিয়ানে দুদু মাঝি, দুর্গা মাঝি, জলপা মাঝি, জেঠা কিস্কু, মঙ্গলা মাঝি, মুংলি, চারো মাঝি, সুকু মাঝি- এই সব অনেক নাম পেয়েছি, যাদের জমি ছিল বাগদা ফার্মের মধ্যে। সাঁওতালরা বলেছেন, সাঁওতাল বাগদা সরেনের নাম অনুসারে এই ফার্ম পরিচিত পায়।’
সংবাদ সম্মেলনে সঞ্জীব দ্রং বলেন, ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই তৎকালীন প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে সুগারমিল কর্তৃপক্ষের চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির কপি পেয়েছি। সেই চুক্তিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, আখ চাষের জন্য এই জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। যদি ভবিষ্যতে কখনও আখ চাষ না হয় বা আখ ছাড়া অন্য কিছু চাষ হয়, তবে এ জমি উদ্ধার করে প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। ফিরিয়ে দিতে খরচ হলে তাও সরকার দেবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।তিনি আরও বলেন, ‘চুক্তিতে বলা হয়েছে, এই সব জমির বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি জমির আইল পর্যন্ত পরিবর্তন করা যাবে না। অথচ সুগার মিল কর্তৃপক্ষ এ জমি নানা কাজে লিজ দিয়েছে। আমাদের কাছে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের একটি কপি এসেছে। এ দরপত্রের বিজ্ঞাপনে (২০১৫ সালের ১ এপ্রিল) ১১টি পুকুর ও ১২টি প্লটের জন্য দরপত্র চাওয়া হয়েছে। এটি পুরোপুরি চুক্তির লংঘন।’
আদিবাসীরা আমাদের বলেছেন, তারা বাপ-দাদার জমিতেই পুনর্বাসন চান, নতুন কোনো জমিতে নয়। আমাদের তারা এও বলেছেন, জীবন রেখে কি হবে যদি বাপ-দাদার জমি বেদখল হয়ে যায়,’ বলেন আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক।
সংবাদ সম্মেলনে আবুল বারাকাত বলেন, জমি অধিগ্রহণের সময় মৌজা ও খতিয়ানের নামের সঙ্গে মানুষের নামও লেখা হয়েছে। মানুষের নামের ৭৫ ভাগ আদিবাসী। সাড়ে ৫ হাজার বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৪ হাজার বিঘাই সাঁওতালদের।তিনি বলেন, লিজ থেকে লাভের একটা হিসাবও করেছি আমরা, তাতে আসে ২২শ’ কোটি টাকা। ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গটিও যে এসেছে তারও ৭৫ শতাংশ সাঁওতালসহ অন্যান্য আদিবাসীরা পাবেন।
প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও জেলা প্রশাসন চিনিকলের জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে জানিয়ে অর্থনীতিবিদ বারাকাত ওই স্থানে কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চল না করার ঘোষণা দিতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ৬ নভেম্বরের ঘটনা রাষ্ট্রীয় অবিচারের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। পুলিশ গুলি করে ৩ জনকে হত্যা করেছে। আরও মৃতের খবর আপনারা কয়েকদিন পরে পাবেন। কারণ লাশ কোথায় রেখেছে, না রেখেছে তা হয়তো আমরা এ মুহূর্তে জানি না। এ ঘটনা মানবাধিকারের লংঘন, ভূমি অধিকার লংঘন এবং এটা সংবিধানেরও লংঘন।গাইবান্ধায় সাঁওতালদের ওপর হামলার ঘটনায় সরকারের কাছ থেকে পূর্ণ ব্যাখ্যা দাবি করে আবুল মকসুদ বলেন, আমরা ব্যাখ্যা দিয়েছি। আপনারা কেন এমন করলেন তার ব্যাখ্যা দিন। পূর্ণ ব্যাখ্যা মানে তদন্ত রিপোর্ট।নিহত প্রত্যকের পরিবারকে ২০ লাখ টাকা করে ও আহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ৫ লাখ টাকা করে দেয়ারও দাবি জানান তিনি।