সাঁওতালপল্লি উচ্ছেদের পর জোরেশোরে চলছে সীমানা ঘিরে রাখার জন্য কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ। সাঁওতালদের চাষ করা ধানের খেত চলে যাচ্ছে বেড়ার ভেতরে। সোয়েল রানাগাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের নির্বিঘœ চলাচল নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ৬ নভেম্বরে ঘটে যাওয়া ঘটনায় কী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, কতগুলো মামলা হয়েছে, কতগুলো অভিযোগ নিবন্ধিত হয়েছে, তা জানাতে বলা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুলসহ এ আদেশ দেন।এ ছাড়া অধিগ্রহণ করা জায়গায় সাঁওতালরা যে ফসল ফলিয়েছেন, সেই ফসল যেন তাঁরা তুলতে পারেন বা স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা সেই ফসল তুলে সাঁওতালদের দিতে পারেন, সে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ ব্যাপারে আগামী ১০ দিনের মধ্যে পুলিশ সুপার ও ওসিকে প্রতিবেদন দাখিলে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ৩০ নভেম্বর পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়েছে।এর আগে বুধবার গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর হামলার ঘটনায় আইনি কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানিয়ে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করা হয়। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট এলাকার সাঁওতালদের জানমাল ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি হবে না এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিবাদীদের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে নাÑএ বিষয়ে রুল চাওয়া হয়েছে। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জেড আই খান পান্না ও এ এম আমিন উদ্দিন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী অবন্তী নুরুল। রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে অংশ নেন ডেপুটি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।
৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জের রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। উপজেলার সাপমারা ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ এলাকায় ওই সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন। সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন সাঁওতাল নিহত হন।উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালদের ভাষ্য, তারা একশ একর জমিতে ধান এবং প্রায় আটশ একর জমিতে মাস কালাই, সরিষা ও পাট চাষ করেছিলেন।গত ৬ নভেম্বর চিনিকলের অধিগ্রহণ করা ওই জমি থেকে সাঁওতালদের কয়েকশ ঘর উচ্ছেদের সময় বাড়িঘরের পাশাপাশি মাঠের মাস কালাই, সরিষা ও পাট লুট করা হয়। ধান তখন লুট না হলেও উচ্ছেদের পর চিনিকল কর্তৃপক্ষ পুরো জমি কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রেখেছে।পাক ধরা ধান ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে কাটতে না পারলে সব নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন ঘরহারা সাঁওতালরা। তাদের সম্পত্তি ও জানমাল রক্ষায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়েই রুল জারি করেছে হাই কোর্ট।স্বরাষ্ট্র সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, গাইবান্ধার ডিসি ও এসপি, স্থানীয় সাংসদ ও গোবিন্দগঞ্জের ইউপি চেয়ারম্যানকে এর জবাব দিতে বলা হয়েছে।
পাশাপাশি উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বাইরে চলাচলের ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।তাদের নিরাপত্তার জন্য কী কী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়্ াহয়েছে এবং উচ্ছেদের সময় ভাংচুর-লুটপাটের ঘটনায় কয়টি মামলা হয়েছে তা আগামী ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন আকারে আদালতকে জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার ও গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসিকে।এ বিষয়ে শুনানির জন্য ৩০ নভেম্বর পরবর্তী তারিখ রেখেছে আদালত। গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের জানমাল রক্ষা, নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণ, স্বাধীনভাবে চলা-ফেরার সুযোগ দিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), ব্রতী সমাজ কল্যাণ সংস্থার পক্ষে বুধবার হাই কোর্টে এই রিট আবেদন করা হয়।বৃহস্পতিবার রিটকারীদের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন, রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল। সেই জমি ইজারা দিয়ে ধান ও তামাক চাষ করে অধিগ্রহণের চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলে তার দখল ফিরে পেতে আন্দোলনে নামে সাঁওতালরা।
এরপর সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে বিরোধপূর্ণ চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা ওই জমিতে কয়েকশ ঘর তুলে সাঁওতালরা বসবাস শুরু করেন। গত ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট হয়।সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। ওই ঘটনায় নিহত হন তিন সাঁওতাল, আহত হন অনেকে।সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ওই জমি সাঁওতালদের ছিল না। ভূমিদস্যুরা সাঁওতালদেরকে ‘ব্যবহার করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সাঁওতালদের দিয়ে দখল করিয়ে পরে নিজেদের দখলে নেওয়া।অন্যদিকে সাঁওতাল পল্লীর বাসিন্দারা বলছেন, তারা বাপ-দাদার জমিতে থাকার অধিকার চান। উচ্ছেদ হওয়া দেড় শতাধিক পরিবার গত দশ দিন ধরে মাদারপুর চার্চের খোলা প্রাঙ্গণ ও চার্চের পরিত্যক্ত স্কুলভবনে বসবাস করছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উপর গুলিবর্ষণের ওই ঘটনায় সমালোচনা চলছে দেশজুড়ে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।