চুলের টুপি তৈরির কাজ শেখাচ্ছেন কনিকা।
চুলের টুপি তৈরির কাজ শেখাচ্ছেন কনিকা।

শিল্পীদের ব্যবহারের জন্য চুলের টুপি হাতে বুনছিলেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ভালুকাই গ্রামের কনিকা খাতুন । কঠোর পরিশ্রমী ও আত্মপ্রত্যয়ী এই নারী চুলের টুপি তৈরি করে নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন,স্বাবলম্বী করেছেন অন্যদেরও। অতি সাধারণ হয়েও এখন তিনি অসাধারণ। তার হাত ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের উত্তুরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামীন জনপদের শতাধিক পরিবার। কনিকার ইচ্ছা ছিল ডাক্টার হওয়ার। কিন্তু বাবার মৃত্যুতে তার সেই ইচ্ছের ডানা আর উড়তে পারেনি। এখন তিনি চুলের টুপি তৈরির কারিগর। সংসারের আয় রোজগার বাড়ানোর জন্য কনিকার বাবা আইয়ুব আলী সিলেটে যান। সেখানে ঔষুদের দোকান দেয়ার কিছুদিন পরেই মারা যান তিনি। কিন্তু ভিটে ছাড়া কিছুই রেখে যাননি আইয়ুব আলী। তার এই সংসারের হাল ধরেন কনিকার মা ফাতেমা বেগম। কনিকার বয়স তখন ১০-১১ বছর। ভাই বোনের মধ্যে তিনি বড়। এলাকায় কোন কাজ জোটাতে না পেরে কনিকার মা ফাতেমা বেগম দুই মেয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে যান ঢাকার টংগীতে । সেখানে ভাড়াটে বাসায় ওঠেন ছেলে মেয়েকে নিয়ে ফাতেমা।

বাসার কাছে একটি গার্মেন্টে অল্প বেতনের কাজ নেন তিনি। মেয়ের ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে পুরণ করতে কনিকাকে ভর্তি করেন একটি স্কুলে। ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া হয় তার। সামান্য আয়ে সংসার চলছিলনা। মায়ের কষ্ট দেখে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দেন কনিকা। কাজ নেন তিনিও টংগী এলাকার একটি হেয়ার ফ্যাশন কারখানায় । মা-মেয়ের আয়ে সংসার ভাল চলছিল। অভাবের সংসার,মাত্র ১৩-১৪ বছর বয়সেই মা তার বিয়ে দেন। এক অভাব থেকে আরেক অভাবের সঙ্গী হন তিনি। স্বামীর সংসারেও নুন আনতে পান্তা ফুরায়। বিয়ের দুই বছরের মাথায় কন্যা সন্তানের মা হন কনিকা। এর পর কোল জুড়ে আসে আরেকটি কন্যা সন্তান। সংসারে সদস্য বেড়েছে কিন্তু রোজগার বাড়েনি। অভাব যেন চারদিক ঘিরে ধরে। ঢাকায় স্বামীকে রেখে নিজ এলাকায় ফিরেন তিনি। যেই ভাবনা,সেই কাজ। ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন। তার এই স্বপ্ন পুরনে সহযোগীতা করেন আরডিআরএস-বাংলাদেশ নামে একটি স্থাণীয় এনজিও। সামান্য পুঁজি,সঞ্চিত অভিজ্ঞতা এবং এনজিও থেকে ২০ হাজার টাক ঋন নিয়ে শুরু হয় কনিকার পথ চলা। স্বামীর বাড়ির ওঠানে স্থাপন করেন অভিনয় শিল্পীদের মাথায় ব্যবহার এবং যাদের মাথায় চুল নেই তাদের মাথা ঢাকার জন্য চুলের টুপি তৈরির কারখানা। বিভিন্ন বিউটি পার্লার থেকে সংগ্রহ করেন নারীদের মাথার চুল। ঐ চুল দিয়ে তৈরি করছেন টুপি বা ক্যাপ। সাড়ে তিন বছর আগে শুরু করা ক্ষুদ্র এই শিল্পটি কালের পরিক্রমায় বর্তমানে বৃহৎ আকার ধারণ করেছে। তার উৎপাদিত চুলের টুপি রাজধানী ঢাকা ঘুরে ভারত সহ চলে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। ঠাকুরগাঁওয়ের কনিকা চুলের টুপি তৈরি করে নিজে স্বাবলম্বী হন,এলাকার মেয়েদেরও রোজগারের পথ খুলে দেন। এখানে কাজ করে অনেকে শক্ত হাতে হাল ধরেছেন স্বামীর সংসার। কনিকা বেগম বলেন,বিউটি পার্লার থেকে চুল সংগ্রহ করে ঐ চুল দিয়ে টুপি তৈরি করি। যা আমার ভাগ্য পরিবর্তন করে। তিনি আরও বলেন,এক সময় আমি একাই এই কাজ করতাম। প্রশিক্ষণ দিয়ে অনেক শ্রমিক তৈরি করেছি। এখন শ্রমিক আর কারখানার দেখা শোনা করি। আমার স্বামী ঢাকায় এই পন্য বাজার জাতের কাজ করছেন। আমার কারখানায় শ্রমিকের কাজ করছেন এলাকার শতাধিক নারী। তাদের মধ্যে স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীও রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের অ-ক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিদিন তৈরি হয় কমপক্ষে ৬০-৭০টি টুপি। আর এই চুলের টুপি বিক্রির টাকায় চলে ঐ সব খেটে খাওয়া শ্রমিকের সংসার। চলে অনেকের পড়াশোনার খরচ। মাসিক আয় করেন আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা। স্থাণীয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান লিটন বলেন,এক কালের দারিদ্র পিড়িত গ্রামটি এখন আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। এই গ্রামের কনিকাই যেন পথের দিশারি হয়ে দাঁড়িয়েছে অসহায় নারীদের। তিনি এই শিল্পের প্রসারের জন্য সরকারের পৃষ্ঠ পোষকতা কামনা করেছেন।

এটিএম সামসুজ্জোহা, ঠাকুরগাঁও।