benjirdoinikbartaজঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির মাত্র ২১ জন সদস্য এখন মাঠে রয়েছেন বলে জানিয়েছে র্যাব৷ উদ্ধার করা হয়েছে তাঁদের সব অস্ত্রই৷শুক্রবার সকালে কারওয়ান বাজারের বিসিআইসি ভবনে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ এ কথা জানান৷সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ৮অক্টোবর র্যাবের অভিযানের সময় পাঁচতলা থেকে পড়ে নিহত ব্যক্তিই নব্য জেএমবির প্রধান ছিলেন৷ তখন সেখান থেকে পাওয়া পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্রের ভিত্তিতে র্যাব জানিয়েছিল তাঁর নাম আবদুর রহমান৷ পরে তদনত্মে জানা যায়, তাঁর আসল নাম সারোয়ার জাহান, বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে৷ আর সাংগঠনিক নাম ‘শায়খ আবু ইব্রাহীম আল হানিফ’৷এই নব্য জেএমবি যেসব হামলা ও হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তার সবগুলোরই দায় স্বীকার করেছে ইরাক-সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএস৷

ঢাকার আশুলিয়ায় জঙ্গি আসত্মানায় র্যাবের অভিযানের সময় পাঁচ তলা থেকে পড়ে নিহত আবদুর রহমানই নব্য জেএমবি শীর্ষ নেতা শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ বলে দাবি করেছে র্যাব৷বাহিনীর মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ শুক্রবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য তুলে ধরে বলেন, ওই জঙ্গি নেতার প্রকৃত নাম সারোয়ার জাহান৷ বেনজীর বলেন, ওই আবদুর রহমানই শায়খ আবু ইব্রাহীম আল হানিফ নামে নব্য জেএমবি গঠন করে আমিরের দায়িত্ব নেন৷এর প্রমাণ হিসেবে নব্য জেএমবি কর্মকান্ড শুরুর একটি ঘোষণার অনুলিপি সংবাদ সম্মেলনে দেখানো হয়৷ বেনজীর বলেন, ওই ঘোষণায় আবু ইব্রাহীম আল হানিফের সঙ্গে শেখ আবু দুজুনা নামে আরেকজনের সই আছে৷ সেই আবু দুজুনা হলেন নারায়ণগঞ্জের অভিযানে নিহত তামিম চৌধুরী, যাকে এতোদিন নব্য জেএমবির প্রধান সমন্বয়ক বলা হচ্ছিল৷বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার মহাখালী ও মতিঝিল থেকে নাফিজ আহমেদ নয়ন ও হাসিবুল হাসান নামে দুইজনকে আটকের পর শুক্রবার সকালে এই সংবাদ সম্মেলনে আসেন র্যাব প্রধান বেনজীর৷র্যাব সদরদপ্তরের সহকারী পরিচালক মিজানুর বলেন, ওই দুইজনের কাছ থেকে ২৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে৷ তারা দুজনেই নব্য জেএমবির সদস্য এবং আব্দুর রহমান ওরফে আবু হানিফ ওরঠে ঘনিষ্ঠ সহযোগী, বলেন তিনি৷গত ৮ অক্টোবর ঢাকার আশুলিয়ার এক বাড়িতে র্যাবের অভিযানের সময় পাঁচতলা থেকে পড়ে একজনের মৃতু্য হয়৷ সে সময় র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয় নিহত ব্যক্তির নাম আব্দুর রহমান আয়নাল, তিনিই নব্য জেএমবির প্রধান অর্থ যোগানদাতা৷ওই বাসা থেকে যে ৩০ লাখ টাকাও উদ্ধার করে র্যাব৷ নিহতের স্ত্রী মোসাম্মত শাহানাজ আক্তার রুমিকে (২৮) আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়; তাদের দুই শিশু সনত্মনকে পাঠানো হয় সেইফ হোমে৷

সংবাদ সম্মেলনে বেনজীর বলেন, আশুলিয়ার ওই আসত্মানায় ভুয়া ন্যাশনাল আইডি, পাসপোর্ট ও চাকরির আইডি কার্ডসহ বিভিন্ন কাগজপত্র পান তারা৷ সব মিলিয়ে জানা যায়, ওই ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে আসছিলেন৷প্রকৃত নাম: সারোয়ার জাহানবাড়ি চাঁপাইনবাগঞ্জের ভোলারহাটে৷অন্য নাম: মোক্তার, নাজমুল ইসলাম, আব্দুর রহমান, শায়খ আসিম আজওয়াদ, শায়ক আবু ইব্রাহিম আল হানিফলেখাপড়া: ১৯৯৮ সালে নাচোলের একটি কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি হন; সেখান থেকেই দাওরা পাস করে৷পরিবার: বিয়ে করেছে দুটি৷ প্রথম পক্ষে এক মেয়ে এক ছেলে; পরের পক্ষে এক ছেলে রয়েছে৷ বর্তমান স্ত্রী সনত্মান সম্ভবা৷সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, কওমি মাদ্রাসায় ভর্তির পর থেকেই সারোয়ার জাহান জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন৷ ২০০৩ সালে চাঁপাইনবগঞ্জের ক্ষেতলালের এক বাড়িতে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে শতাধিক লোক জড়ো হওয়ার খবরে পুলিশ সেখানে যায়৷ সে সময় বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জঙ্গিরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে তিনটি অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় এবং গুলি করে গ্রেনেড ছুড়ে পালিয়ে যায়৷পুলিশ সেদিন ঘটনাস্থল থেকে ৩৩ জনকে আটক করে, যাদের মধ্যে এই সারোয়ার জাহানও ছিলেন বলে জানান বেনজীর আহমেদ৷সেই এফআইআরের কপি সাংবাদিকদের দেখিয়ে তিনি বলেন, সারোয়ার ওই এফআইআরে সাত নম্বর আসামি ছিল৷আমরা জানতে পেরেছি, ২০০৩ থেকে ২০১৬- এই ১৩ বছর সে জঙ্গি জীবন যাপন করে৷ সর্ববেশ আবু ইব্রাহিম নামে আমির হিসেবে নব্য জেএমবি গঠন করে৷সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত বছরের ২১ জুলাই নব্য জেএমবির আমির হিসেবে দায়িত্ব নেন সারোয়ার জাহান৷ এরপরে ২৬ জুলাই তাঁদের সাংগঠনিক এক প্রতিবেদনে নব্য আমির উলেস্নখ করেন, তাঁদের ৩০০ জন সদস্য, ২০টি আধা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র, নয়টি স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ও কিছু গ্রেনেড রয়েছে৷ এ প্রতিবেদনের আট মাস পর আরেক প্রতিবেদনে সারোয়ার জাহান উলেস্নখ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে তাঁদের ১৫ জন সদস্য নিহত ও ১৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ ছয়টি একে ২২ (একে টোয়েন্টিটু) রাইফেল ও একটি এম ১৬ (এম সিঙ্টিন) রাইফেল র্যাব-পুলিশ জব্দ করেছে৷ নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তাঁদের দুজন কেমিস্ট ও একজন ইলেকট্রিশিয়ান রয়েছেন৷এ ছাড়া একজন ইলেকট্রিশিয়ান গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ (কর্মকর্তারা বলছেন এসব কেমিস্ট ও ইলেকট্রিশিয়ান বোমা তৈরির কাজ করে থাকেন৷) ওই সাংগঠনিক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আট মাসে তাদের সদস্যসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৬৬তে৷ অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি একে ২২ রাইফেল, চারটি মোটরসাইকেল ও একটি মিনি ট্রাক৷

র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, নিহত হওয়ার দুই দিন আগে সারোয়ার যে সাংগঠনিক প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন তাতে ৫টি একে ২২ রাইফেল, ৩৩ জন সদস্যের কথা বলা হয়৷ এই ৩৩ জনের মধ্যে ৮ অক্টোবর টাঙ্গাইল ও গাজীপুরে র্যাব ও পুলিশের চারটি পৃথক অভিযানে মোট ১২ জন নিহত হন৷ ওই সব অভিযানে জঙ্গিদের হিসাবের মধ্যে থাকা পাঁচটি একে ২২ রাইফেলই উদ্ধার করা হয়েছে৷ এর মধ্যে তারা আর কোনো অস্ত্র কিনে না থাকলে ধরে নেওয়া যায় তাদের এখন কোনো অস্ত্র নেই৷ কিছু বোমা তৈরির সরঞ্জাম থাকতে পারে৷ আর ১২ জন নিহত হওয়ার পর এখন গ্রেপ্তার এড়িয়ে রয়েছেন আরও ২১ জন৷ অচিরেই এঁদের ধরে ফেলা যাবে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ২১ জনের মধ্যে তিনজন নীতিনির্ধারনী সদস্য৷ তাঁদের সাংগঠনিক নাম জানা গেছে ইতিমধ্যেই৷ ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, আবদুর রহমানের বাসা থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা, দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্র, বিস্ফোরকদ্রব্য, মুঠোফোন, জিহাদি বই, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্টসহ নানা ধরনের সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়৷ আবদুর রহমানের পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও কর্মস্থলের পরিচয়পত্র যাচাই করে তাঁর চেহারার কাউকে পাওয়া যায়নি৷ তবে তাঁর মা-বাবার সন্ধান পায় র্যাব৷ পরবর্তী সময়ে ছবি দেখে আবদুর রহমানকে শনাক্ত করেন তাঁরা৷ পরিবারের সদস্যদের তথ্য অনুযায়ী, আবদুর রহমানের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভোলাহাট উপজেলার মুশরিভুজা গ্রামে৷ তাঁর বাবার নাম আবদুল মান্নান, মায়ের নাম ছালেহা খাতুন৷

কওমি মাদ্রাসা থেকে দাওরা পাস আবদুর রহমান বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, আরবি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী৷ তিনি প্রায় ১৮ বছর আগে ১৯৯৮ সালে জেএমবির কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন৷ ২০০৩ সালে জেএমবির নেতা বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় তিনি অংশ নেন৷ ওই মামলার ১৪ নম্বর আসামি ছিলেন আবদুর রহমান৷ এই মামলায় নয় মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পান তিনি৷ দেড় মাস গ্রামের বাড়িতে থাকার পর আবারও আত্মগোপনে চলে যান এই জেএমবি নেতা৷ ব্যক্তিগত জীবন দুটি বিয়ে করেছেন আবদুর রহমান৷ প্রথম স্ত্রীর সংসারে দুটি সনত্মান ও দ্বিতীয় স্ত্রীর একটি সনত্মান রয়েছে বলে জানান র্যাবের মহাপরিচালক৷আবদুর রহমানের একাধিক চিঠি, ই-মেইল ও এসএমএস পরীক্ষা করা হয়েছে জানিয়ে বেনজীর আহমেদ বলেন, নয়টি চিঠি গ্রহণ ও ১০টি চিঠি বিতরণ করেছেন তিনি৷ এসব চিঠিতে এই নব্য জেএমবি নেতা আবু ইব্রাহিম আল হানিফ নামে স্বাক্ষর করেছেন৷ নব্য জেএমবির নিহত সদস্যদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার কাজও করতেন আবদুর রহমান৷আবদুর রহমান নব্য জেএমবির আর্থিক কর্মকান্ড পরিচালনার পাশাপাশি বিভিন্ন হামলার পরিকল্পনা, সাংগঠনিক কাঠামো, অস্ত্র ও সামর্থ্য নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতেন৷ তাঁর নির্দেশে নব্য জেএমবির সদস্যরা ঢাকার গুলশানে ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলাকে হত্যা, রংপুরে জাপানি নাগরিক কোনিও হোসিকে, রাজধানীর গাবতলীতে দারম্নস সালাম থানার সহকারী উপপরিদর্শক ইব্রাহিম মোলস্নাকে হত্যা, দিনাজপুর শহরে খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ইতালির নাগরিক পিয়েরো পারোলারি সামিওকে হত্যা করে৷

গত বছর পুরান ঢাকার হোসনি দালানে আশুরার তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা, নন্দনপার্কে শিল্প পুলিশ সদস্য মুকুল হোসেন হত্যা, বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া মসজিদে হামলা, চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ইশা খাঁ নৌঘাঁটিতে বোমা বিস্ফোরণ, এ বছর পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে শ্রীশ্রী সনত্ম গৌরীয় মঠে পুরোহিত যঞ্জেশ্বর দাসাধিকারীকে হত্যা, ২৫ মে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ব্যবসায়ী দেবেশচন্দ্র প্রামাণিক হত্যা, ৫ জুন নাটোরের বনপাড়ায় খ্রিষ্টানপলি্লতে সুনীল গোমেজ হত্যা, ৭ জুন ঝিনাইদহের মহিষডাঙ্গা গ্রামে পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলি হত্যা, পাবনার হেমায়েতপুরে খ্রিষ্টান ধর্মযাজক নিত্যরঞ্জন পান্ডে হত্যা, ১৫ জুন মাদারীপুরে কলেজশিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলা, ১ জুলাই ঝিনাইদহে সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস হত্যা, একই দিন গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা ও হত্যা, ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদগাহ মাঠে হামলার ঘটনা আবদুর রহমানের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় ঘটেছে বলে সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানানো হয়৷অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত নব্য জেএমবির আবদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী নাফিস আহমেদ নয়ন ও হাসিবুল হাসানকে গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব৷ এঁদের কাছ থেকে ২৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়৷