এবার রিনাকে বেধড়ক মারধর করে একটি পা গোড়ালি বরাবর ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে। শরীরে বেধড়ক পেটানো হয়েছে। পাঁচ বছরের শিশু সন্তান নিয়ে এখন কলাপাড়া হাসপাতালের শয্যায় কাতরাচ্ছে। চিকিৎসা বলতে আশপাশে ভর্তি হওয়া রোগী কিংবা তাদের সজনেরা যে যা পারছে কিনে দিচ্ছে ওষুধ। কেউ বা উপকরন। এভাবেই চলছে। অর্থাভাবে চিকিৎসা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। ওসিসি কিংবা মহিলা অধিদফতর থেকে শুরু কোন মানবাধিকার সংগঠন নির্যাতিতা এ মহিলার কোন ধরনের সহায়তায় এগিয়ে আসেনি। ১১ অক্টোবর রিনাকে চাকামইয়ার নিশানবাড়িয়া গ্রামের রাস্তায় ফেলে ভরদুপুরে মুগুর দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। রিনার অভিযোগ, শ^শুর সৈয়দ হাওলাদার, শাশুড়ি মুনসুরা বেগম, ভাসুর বেল্লাল ও তার স্ত্রী এবং স্বামী ফেরদৌস তাকে বেধড়ক মারধর করেছে। স্বামীর অধিকার প্রতিষ্ঠার এবং ইতোপুর্বে নারী নির্যাতন আদালতে দায়ের করা মামলার স্বাক্ষীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য গেলে রিণাকে এমন মারধর করা হয়। কোন মতে হামাগুড়ি দিয়ে হাসপাতালে আসেন রিণা। উল্টো নিজেকে আহত দেখিয়ে স্বামী ফেরদৌসও কলাপাড়া হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছেন। রিনার অভিযোগ ব্লেড দিয়ে ক্ষত করে তার বিরুদ্ধে মামলা করতেই এমন নাটক করা হয়েছে। চাকামইয়ার এক প্রভাবশালী এসেও রিনাকে ধমকে গেছে বলে অভিযোগ করলেন।
কান্নাঝরা চোখে রিণা জানান, বিয়ের সাত বছরে পাঁচটি মাসও স্বামীর সংসারে ঠাঁই মেলেনি। যে কয়দিন ছিল তা সব ভয়াবহ নির্যাতনের স্মৃতি। লাঠিপেটা, লাথি, চুলের মুঠি ধরে জুতাপেটা ছিল নিত্যদিনের সাধারণ নির্যাতন। মারধর-নির্যাতন থেকে পড়শি কেউ রক্ষা করতে এগিয়ে আসলে বলা হতো “মাথা খারাপ”।
এক পর্যায় ২০১৪ সালের প্রথম দিকে বাড়িছাড়া করা হয় রীণাকে। স্বামীর আশ্রয় ছেড়ে কোথাও যাওয়ার অবলম্বন নেই এ হতভাগীর। অনেক আগেই মা মারা গেছেন। বাবা বৃদ্ধ। সৎ মা ও ভাইদের কাছে যাওয়ারও সুযোগ নেই। শিশু সন্তান মালিয়াকে নিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের যোগান দিতে অন্যের বাসায় ঝি এর কাজ করেছে। এরপর থেকে নিজে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। সকাল থেকে দুপুর একটি কিন্ডার গার্টেনের সামনে, সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা অবধি নাছনাপাড়া চৌরাস্তার পাশে দাড়িয়ে মুড়ি বিক্রি করছেন। এখন কোন উপার্জন নেই। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে এখন অসহায় রীণা দুচোখে অন্ধকার দেখছেন।
ঢাকায় গার্মেন্টে কাজ করার সময় পরিচয় ঘটে স্বামী ফেরদৌস হাওলাদারের সঙ্গে। সাত বছর আগের কথা। এক পর্যায়ে বিয়ে হয়, ২০০৯ সালের ২৭ জুন। কয়েক মাস পরেই গা ঢাকা দেয় ফেরদৌস। কাবিন নামার ঠিকানায় খুঁজতে খুঁজতে স্বামীর বাড়ি চাকামইয়া ইউনিয়নের নিশান বাড়িয়া গ্রামে হাজির হয়। ঠিকঠাক পৌছে শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেও তারা প্রথমে ফেরদৌসের বাড়ি না বলে বের করে দেয়। বুঝতে পেরে বাড়িতে অবস্থান নেয়ার পড়েই প্রথমদফা মারধর হামলা করা হয় রাণীর উপর। এরই মধ্যে স্বামী ফেরদৌসকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া। বহু মারধর, বহু নির্যাতনের পরে স্বামীকে পেয়েছেন। তাকে নিয়ে ঢাকায় গিয়েও শেষ রক্ষা হয় নি। তখন রীণা সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাকে ঢাকা শহরের এক সড়কে পাশে দাঁড় করিয়ে পালিয়ে যায় ফেরদৌস। তিন মাস পরে খুঁেজ পায় রীণা। বহুবার পেটের সন্তানকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। নিজের এ দশার বিচার চাইতে বহুবার ইউনিয়ন পরিষদে ধর্ণা দিয়েছেন রীণা। জীবনের চাকা ঘোরাতে হাত পাততে হয়েছে সকল দরজায়। তার অসহায় হাতটি ধরে কেউ কিছুটা সহায়তা করেছে। তবে সমাজের কীট নামের বহু নরপশু আবার হায়েনার মতো রীনার শরীরের দিকে কালো হাত বাড়ানোর চেষ্টাও করেছে। তার কাছে সবাইকে এখন বিচিত্র মনের মানুষ মনে হয়। নিজের সীমাহীন দুঃখ কষ্ট অসহায়ত্ব এবং শিশু সন্তানের ভবিষ্যত পরিণতির কথা বলতে গিয়ে অঝোর ধারায় কান্না শুরু করে দেয় গৃহবধু। যেন অথৈ সাগরে ভাসছে শিশু সন্তানকে নিয়ে। প্রথম দিকে ২০১৪ সালে ওসিসি তাকে সহায়তা দিয়েছে। কিন্ত এখন অসহায়ের মতো হাসপাতালের শয্যায় পড়ে আছেন। কলাপাড়া থানার ওসি জিএম শাহনেওয়াজ জানান, রিনাকে আইনানুগ সকল সহায়তা দেয়া হবে। চিকিৎসক জেএইচ খান লেলিন জানান, রিনাকে বিশেষভাবে চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।