ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে দেশব্যাপী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপিত হচ্ছে।রোববার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের পূজামন্ডপে অষ্টমী পূজা ও কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। অষ্টমী পূজার অঞ্জলি দিতে প্রতিটি পূজামন্ডপে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।কুমারী পূজা উপলক্ষে সকাল থেকেই রামকৃষ্ণ মিশনে ভিড় জমান রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জসহ আশপাশের জেলার ভক্তগণ।
নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন’ এই দার্শনিক তত্ত্বে মহাঅষ্টমী তিথিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পালন করলেন কুমারী পূজা।সৃষ্টি-স্থিতি-লয়- এই ত্রিবিধ শক্তি বীজ আকারে কুমারীতে নিহিত, সেই বিশ্বাস থেকেই দেবী দুর্গার কুমারীরূপের আরাধনা করেন ভক্তরা। নারীত্বের বন্দনায় আবারও ধ্বনিত হল, নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা।সারা দেশে রামকৃষ্ণ মিশনের মতো ঢাকার গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে রোববার সকালে কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়।ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠে সকাল ১১ টায় শুরু হয় কুমারি পূজা। তবে ভক্তদের ভিড় ছিল আরও আগে থেকে।
এবারের কুমারীর নাম সর্বাণী ভট্টাচার্য বিদ্যা। সে এসেছে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার আউপাড়া থেকে। নারায়ণ ভট্টাচার্য ও অনিতা ভট্টাচার্যের মেয়ে সর্বাণী আউপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ম শ্রেণির ছাত্রী। যোগিনীতন্য, কুলার্বতন্য, দেবীপুরাণ,স্তোত্র, কবচ, সহ¯্রনাম, তন্যসার, প্রাতোষিনী, পুরোহিত দর্পণ- হিন্দু শাস্ত্রের এসব ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি ও মাহাত্ম্য বিশদভাবে রয়েছে।তন্ত্রসার মতে, ১ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত বালিকারা কুমারী পূজার উপযুক্ত; তাদের অবশ্যিই ঋতুমতি হওয়া চলবে না। মেরুতন্ত্রে বলা আছে, সর্বকামনা সিদ্ধির জন্য ব্রাহ্মণ কন্যা, যশোলাভের জন্য ক্ষত্রিয় কন্যা, ধনলাভের জন্য বৈশ্য কন্যা ও পুত্র লাভের জন্য শূদ্রকুল জাত কন্যা কুমারী পূজার জন্য যোগ্য।
১৯০১ সালে ভারতীয় দার্শনিক ও ধর্মপ্রচারক স্বামী বিবেকানন্দ সর্বপ্রথম কলকাতার বেলুর মঠে কুমারী পূজার মাধ্যমে এর পুনঃপ্রচলন করেন। তখন থেকে প্রতিবছর দূর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠে এ পূজা চলে আসছে।নববস্ত্র পরিহিতা হয়ে কুমারী দেবী আসেন বিল্বপত্র, পুষ্পাসনে আসীন হয়ে। তার হাতে ফুল, কপালে লাল সিঁদুর এবং পায়ে আলতা। যেহেতু কুমারির বয়স সাত, তাই তার নামকরণ হয়েছে মালিনী।
পূজা শেষে বিদ্যা বলে, জগতের সকলের কল্যাণ হোক, সেটাই আমার প্রার্থণা। জগতের সকলের মঙ্গল হোক, সকলে সুখে শান্তিতে থাকুক। এর আগে সকাল সাড়ে ৬টায় মহাঅষ্টমী পূজা শুরু হয়। পূজা পরিচালনা করেন প্রধান পরিচালক গুনেশ চৈতন্য। তন্ত্রধারক ছিলেন মহারাজ তিরাত্মানন্দ।
রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের অধ্যক্ষ স্বামী ধ্রুবেশ্বানন্দ কুমারী পূজার মাহাত্ম্য বিষয়ে বলেন, আমাদের নারীদের ওপর অত্যাচার যেন কম হয়, সেজন্য আমরা কুমারী রূপে মায়ের আরাধনা করেছি। আমাদের সকলের মধ্যে থেকে যেন আসুরিক ভাব দমন এবং একই সঙ্গে দৈবশক্তি তথা মাতৃশক্তি জাগরিত হোক – এটাই মূল কথা।হিন্দু সম্প্রদায় সোমবার শারদীয় দুর্গাপূজার মহানবমী পালন করবে। আর মাত্র একদিন পরেই মর্ত্য ছেড়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে ফিরে যাবেন দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা। পেছনে ফেলে যাবেন ভক্তদের চার দিনের আনন্দ-উল্লাস আর বিজয়ার অত্র“।
রোববার ছিল মহাষ্টমী। রাজধানীর রামকৃষ্ণ মিশনে অনুষ্ঠিত হয় পূজার আকর্ষণীয় পর্ব কুমারী পূজা। মাতৃভাবে কুমারী কন্যাকে জীবন্ত প্রতিমা কল্পনা করে জগজ্জননীর উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করাই কুমারী পূজা। শাস্ত্র মতে, এদিন তার নামকরণ করা হয় উমা। ভক্তদের মতে, এটি একাধারে ঈশ্বরের উপাসনা, মানববন্দনা আর নারীর মর্যাদার প্রতিষ্ঠা। নারীর সম্মান, মানুষের সম্মান আর ঈশ্বর আরাধনাই কুমারী পূজার অন্তর্নিহিত শিক্ষা।কুমারী পূজা দেখতে সকালে রামকৃষ্ণ মিশন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। সকালে মতিঝিল থেকে গোপীবাগমুখী রাস্তায় ঢুকতেই ঢাকঢোলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। বিরামহীন ঢোলের আওয়াজের সঙ্গে থেমে থেমে বেজে উঠে ঘণ্টা আর কাঁসার শব্দ আর নানা বয়সের নারীদের ভক্তিভরা উলুধ্বনি। এরই মাঝে পিতার কোলে চড়ে মন্ডপে অধিষ্ঠিত হলেন কুমারী মা। হাজারো ভক্ত জয়ধ্বনি দিয়ে বরণ করে নেন কুমারী মাকে। সারাদেশের রামকৃষ্ণ মিশন ছাড়াও মিশন নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন মঠেও কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। টুকটুকে লাল শাড়ি পরে আসা কুমারী মায়ের চোখে-মুখে ভীতিমিশ্রিত আনন্দের ছাপ। চারদিকে তখন অগণিত মানুষের ভিড়। কুমারী মা আসনে আসার পর পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় বেলা ১১টায়।