প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের বিরূপ মন্তব্যের পরও দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকবে। তিনি বলেছেন, দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক চলবে, ঝগড়াঝাঁটিও চলবে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত শক্তি। তাদের পছন্দের লোকেদের বিচার হচ্ছে। তাই তারা তো কাঁদবেই। নির্বাচন কমিশন গঠনে বিএনপি ভূমিকা রাখতে চায়, আলোচনা চায়। বিএনপির এই আগ্রহের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান কি হবে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি কি ধরনের নির্বাচন কমিশন চায়। তারা কি এমন কমিশন চায় যারা এক কোটির বেশি ভুয়া ভোটার তালিকায় আনবে। বর্তমান কমিশন তো এটা করেনি। তাদের (বিএনপি) পরামর্শ নিলে তো ভুয়া ভোটার তালিকা করে দেবে এমন কমিশন করতে হবে।
রোববার বিকেলে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর সম্পর্কে অবহিত করতে এই সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে তিনি জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদান, কানাডা সফর, দুটি পুরস্কার গ্রহণ, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া, বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য দেওয়াসহ ১৬ দিনের সফরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি এই সফরকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে মন্তব্য করেন।লিখিত বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রথম প্রশ্ন ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের নানা মন্তব্যের পর দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করা হবে কি না? জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, দুটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকে। মতভিন্নতাও থাকতে পারে। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান শক্তি, তাই তারা তাদের পেয়ারা বান্দাদের জন্য কাঁদছে। কিন্তু আমরা তো বিচার বন্ধ করিনি। বিচার চলছে। পাকিস্তান মন্তব্য করছে, আমরা এর জবাব দিচ্ছি। দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক চলবে, ঝগড়াঝাঁটিও চলবে। তিনি বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলেন, দেশের ভেতরের একটি দল এ ধরনের লোকদের মন্ত্রী বানিয়েছে। দেশের ভেতরে বসে দালালি করেছে। আগে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সার্ক থাকার দরকার আছে কি না এবং পাকিস্তানকে বাদ নিয়ে বিকল্প কিছু করার কোনো চিন্তা বাংলাদেশের আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ ব্যাপারে তাঁর একক ভাবে বলার কিছু নেই, সেটা উচিতও হবে না। সার্কের চেয়ারপারসন এখন নেপাল। বাংলাদেশ চেয়ারপারসন বাংলাদেশ নয়। এই সিদ্ধান্ত সবাই মিলে নিতে হবে। সার্কের কি হবে।পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধ হলে আমাদের অগ্রগতিতেও বাধা সৃষ্টি হবে। আমরা চাই দুই দেশ নিজেরাই তাদের সমস্যার সমাধান করুক।সরকারি ভাবে একটি খেলার চ্যানেল করা যায় কি না এমন প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী নাকচ করে দেন। তবে সংসদ টেলিভিশনের সময় থেকে কয়েক ঘণ্টা খেলার জন্য বরাদ্দ দেওয়া যায় কি না সেটা দেখা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, তার দলের আসন্ন সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন হলে এবং এর ফলে তিনি সভাপতির পদ থেকে অবসরের সুযোগ পেলে সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন।আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলটির সংস্কার বা নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, কাউন্সিলর ও ডেলিগেটরা যেভাবে চাইবেন, সেভাবেই সব হবে। আমার তো ৩৫ বছর হয়ে গেছে। আমাকে যদি রিটায়ার করার সুযোগ দেয়, তাহলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হবো। তবে অবশ্যই আমি থাকবো। দল ছেড়ে তো আমি যাচ্ছি না। যদি নতুন নেতা নির্বাচিত করা হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হবো।কানাডায় গ্লোবাল ফান্ড সম্মেলন এবং যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘ ব্যস্ত সফরের পর ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেলে দেশে ফেরেন তিনি।এ সফরে প্রধানমন্ত্রী কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। একইসঙ্গে ভূষিত হন এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’ ও প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ খেতাবে।এ সফরের ফাঁকে ৫ দিন ছুটি কাটিয়েছেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, গত ৩৫ বছরে এই প্রথম ব্যক্তিগত ছুটিতে টানা পাঁচ দিন কাটালাম।সফরে গিয়ে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার পর পাঁচ দিন ওয়াশিংটনে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বাসায় কাটান প্রধানমন্ত্রী। এই সময়টিকেই তিনি তার ব্যক্তিগত ছুটির সময় বলে উল্লেখ করেন।প্রধানমন্ত্রী তার কাটানো অবসর প্রসঙ্গে বলেন, এই সময়ে যদিও আমি ৫১টি ফাইল স্বাক্ষর করেছি, কিন্তু তাতেও সময়টিকে আমি আমার ছুটি হিসেবেই ধরতে চাই।১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত প্রথম দফায়, ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় এবং ২০১৪ থেকে এখন পর্যন্ত তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
প্রধানমন্ত্রী তার কানাডা সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, কানাডায় গ্লোবাল ফান্ড সম্মেলনের ফাঁকে জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে বৈঠক করি। বৈঠকে ট্রুডো দু’দেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও সুসংহত করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থানেরও প্রশংসা করেন।তিনি বলেন, বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনি নূর চৌধুরীকে দেশে ফেরানোর বিষয়ে আলোচনা হয়। তিনি এ নিয়ে সেদেশের আইনি বাধার কথা উল্লেখ করেন। তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিতপূর্বক কীভাবে স্পর্শকাতর ইস্যুটির সুরাহা করা যায়, তার উপায় খুঁজতে দু’দেশের উপযুক্ত প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা শুরুর পক্ষে মত দেন।প্রধানমন্ত্রী জানান, তিনি জাস্টিন ট্রুডোকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং ট্রুডো তা সানন্দে গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতা দেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও আমি বাংলায় বক্তব্য দেই। বক্তৃতায় অভিবাসী ও শরণার্থী ইস্যুটিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অনুরোধ করি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমি সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের পরামর্শদাতা, মূল পরিকল্পনাকারী, মদতদাতা, পৃষ্ঠপোষক, অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহকারী এবং প্রশিক্ষকদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাই।
বক্তৃতায় শেখ হাসিনা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বজুড়ে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন বলেও জানান।প্রধানমন্ত্রী বলেন, মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে আগত শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানের কথা তুলে ধরেছি জাতিসংঘে। এ বিষয়ে আমরা একটি সমাধান চাই বলেও জানিয়েছি তাদের। বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সজীব ওয়াজেদ জয় আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ পাওয়া প্রধানমন্ত্রী তার গর্বের কথা প্রকাশ করে বলেন, আমার এই ছেলে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জন্মগ্রহণ করে। তখন আমাদের বড় দুখের সময়। একটি একতলা বাড়িতে আমাদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তারই একটি দিনে ওর জন্ম। তারপর আল্লাহ তাকে এতো বড় করেছে। বাংলাদেশকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে নিতে পারছে, এটাই অনেক বড় কথা।
এ ‘আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করায় মা হিসেবে এটি আমার জন্য অনেক গর্বের। জয় তথ্য ও প্রযুক্তি উন্নয়নে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে যাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় তার বিশেষ অবদান রয়েছে। বাংলাদেশ যে এতো দ্রুত ডিজিটাল হতে পেরেছে এ জন্য তার অবদান অনেক।তিনি সীমান্তে উত্তেজনার জেরে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে টানাপোড়েনের বিষয়ে বলেন, এই দু’দেশের মধ্যে কোনো সংঘাত হলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো সবচেয়ে বেশি। এটি কাম্য নয়। এই অঞ্চলে শান্তি বজায় থাকুক এটিই আমরা চাই।পাকিস্তানে সার্ক সম্মেলন স্থগিত হয়ে যাওয়ায় সংস্থাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ নিয়ে আমাদের একলা কিছু বলার নেই। সার্কের আরও ৭ সদস্য দেশ আছে, সবাই মিলে যে সিদ্ধান্ত নেবে তা-ই হবে।যুদ্ধাপরাধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পাকিস্তানের নাক গলানো প্রসঙ্গে আরেকটি প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, একটি দেশের সঙ্গে একটি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকে। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কও থাকবে, আবার ঝগড়াঝাটিও হবে। তিনি নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেন, তারা এমন নির্বাচন কমিশন চায়, যারা ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি করবে। অথচ তাদের ক্ষমতাকালে ভোটাধিকার ছিলো না। বরং মিরপুর, মাগুরায় ভুয়া ভোটাররা ভোট দিয়েছে। দেশবাসী ভুলে যায়নি।