কূটনীতির চাপ তো আছেই। সেই সঙ্গে উরি হামলায় জড়িত চার জঙ্গি এবং তাদের সঙ্গীদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সামনে এনে পাকিস্তানের অস্বস্তি অনেক গুণ বাড়িয়ে দিল নয়াদিল্লি। আজ ভারতে নিযুক্ত পাক হাইকমিশনার আব্দুল বাসিতকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর হাতে চার জঙ্গি, তাদের দুই পথপ্রদর্শক ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরে বসে থাকা হ্যান্ডলারদের সম্পর্কে বিশদ তথ্য তুলে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানান বিদেশসচিব এস জয়শঙ্কর। বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, এর মধ্যে দুই পথপ্রদর্শক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যা বলেছে, তাতে স্পষ্ট, পাকিস্তানের মাটি থেকেই হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল।
দুই পথপ্রদর্শকের খোঁজ মিলল কী ভাবে? গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, উরি সেনা ছাউনিতে হামলার পরেই এলাকায় অচেনা মুখ দেখে সন্দেহ হওয়ায় পুলিশে খবর দেন গ্রামবাসীরা। সেই সূত্রেই দু’জন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। আজ তাদের নাম প্রকাশ করে দিল্লি জানিয়ে দিল, পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মুজফ্ফরাবাদের বাসিন্দা ওই দু’জন জঙ্গিদের পথ প্রদর্শক ছিল। তাদের দায়িত্ব ছিল জঙ্গিদের ভারতে ঢুকতে সাহায্য করা এবং তাদের সেনা ছাউনি অবধি পৌঁছে দেওয়া। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ‘গাইড’দের সাহায্যে ‘গন্তব্যে’ পৌঁছে পাকিস্তানে বসে থাকা হ্যান্ডলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের নির্দেশ মতো হামলা চালিয়েছিল চার জঙ্গি।
বাসিতকে দেওয়া তথ্যে বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, ওই দুই ‘গাইডে’র নাম ফয়জল হুসেন আওয়ান ও ইয়াসিন খুরশিদ। বয়স ১৯-২০। এদের মধ্যে ফয়জলকে জেরা করে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) জানতে পেরেছে, ১৮ সেপ্টেম্বর জঙ্গিদের সীমান্ত পার করে ভারতে নিয়ে আসে তারা। গোয়েন্দাদের ফয়জল জানিয়েছে, জঙ্গিদের নেতা ছিল হাফিজ আহমেদ। তার বাড়ি মুজফ্ফরাবাদের ধারবাঙ্গ গ্রামে। বাকি তিন জন জঙ্গির বাড়িও মুজফ্ফরাবাদেই। জেরায় দুই হ্যান্ডলারের কথাও জানিয়েছে ফইজল। মহম্মদ কবির আওয়ান ও বাশারত নামে ওই দুই হ্যান্ডলার পাকিস্তানে বসেই জঙ্গিদের নির্দেশ দিচ্ছিল, কী ভাবে কোথায় হামলা করতে হবে। ইসলামাবাদের অস্বস্তি বাড়িয়ে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ আজ বলেন, ‘‘পাকিস্তানের ওই দুই নাগরিক (পথ প্রদর্শক)-কে ইসলামাবাদ চাইলে আইনি সাহায্য করতেই পারে।’’ একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘জেরা ও ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করছে, জঙ্গিরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকেছিল। যা আমরা আগেই বলেছিলাম।’’ তিনি জানান, পাকিস্তানের মাটি থেকে ভারত-বিরোধী জঙ্গি কাজকর্ম বন্ধ করার প্রশ্নে ইসলামাবাদ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা যেন তারা মেনে চলে।
উরি হামলার পর থেকেই ইসলামাবাদের দাবি ছিল, ওই ঘটনা ভারতের সাজানো ষড়যন্ত্র। আন্তর্জাতিক স্তরেও এই প্রচারই করছিল তারা। পাকিস্তানের বক্তব্য ছিল, কাশ্মীরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা থেকে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি ঘোরাতেই ভারত এই কৌশল নিয়েছে। গত কালও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোওয়াজা আসিফ দাবি করেছিলেন, ‘‘উরিতে হামলার পিছনে পাকিস্তানের হাত নেই। ভারতই অন্তর্ঘাত ঘটিয়েছে, যাতে পাকিস্তানকে বিশ্বের সামনে হেয় করা যায়।’’ সূত্রের বক্তব্য, এ দিন চার জঙ্গি, তাদের দুই হ্যান্ডলার এবং দুই পথপ্রদর্শক সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য বাসিতের হাতে তুলে দিয়ে দিল্লি শুধু পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ওই বক্তব্য খণ্ডন করেনি, পাকিস্তানের মাটি কী ভাবে লাগাতার ভারত-বিরোধী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, সে প্রমাণও দিয়েছে।
ইসলামাবাদের উপর চাপ বাড়াতে আরও একটি পদক্ষেপ করছে ভারত। উরি-কাণ্ড নিয়ে চাপানউতোরের আবহেই জইশ-ই-মহম্মদ জঙ্গি গোষ্ঠীর মাথা মাসুদ আজহারকে নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে নতুন করে সক্রিয় হয়েছে নয়াদিল্লি। পঠানকোট হামলার আবহে এ বছর মার্চে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে মাসুদকে নিষিদ্ধ জঙ্গি হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল ভারত। সে সময় আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া ভারতের দাবিকে সমর্থন করলেও চিনের আপত্তিতে সেই প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়। সে সময় বেজিং যুক্তি দিয়েছিল, মাসুদ আজহারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তাদের আরও সময় লাগবে। সেই সময়সীমা আগামী দশ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছে একটি মহল। কূটনীতিকদের একটি অংশের আশা, ওই সময়সীমার মধ্যে চিন নির্দিষ্ট ভাবে তাদের আপত্তি না জানালে মাসুদের বিরুদ্ধে ভারতের প্রস্তাব গৃহীত হয়ে যাবে। বিদেশ মন্ত্রক মনে করছে, উরির ঘটনায় যে ভাবে পাকিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির নাম উঠে এসেছে, তাতে চিনের পক্ষে এই মুহূর্তে ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়ানো কিছুটা সমস্যার। ফলে ইচ্ছে থাকলেও পাকিস্তানের মদতেপুষ্ট জইশ প্রধান মাসুদ আজহারকে সমর্থন করা বেজিং-র পক্ষে এ যাত্রায় কঠিন হবে। আর তাতে সুবিধা হবে ভারতেরই। যদি এই সুযোগে মাসুদের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা যায়, তা হলে উরি-কাণ্ডের পরে কূটনৈতিক ভাবে বেশ ফায়দা পাবে ভারত। আর মাসুদ আজহারের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরও অস্বস্তিতে পড়বে ইসলামাবাদ।
Source : anandabazar