fishermen-collect-eggs-from-the-halda-river-at-azim-ghat-point

জীববৈচিত্র ও মৎস্য সম্পদের অন্যতম রূপালী খনি জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা দেশের একমাত্র মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন হালদা নদী হারাতে বসেছে তার অতীত ঐতিহ্য। আর এমন অবস্থা চলতে থাকলে হালদাকে বাচিঁয়ে রাখা দূষ্কর বলে মনে করছে হালদা বিশেষজ্ঞরা। তাইতো হালদা নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণা ও নদীকে দূষণ মুক্ত করতে অচিরেই আন্দোলনে যাচ্ছে সাধারণ জনগন।

আন্দোলনের অংশ হিসেবে হালদাকে বাচাঁতে তথা নদীর দূষণ প্রতিরোধ, মা-মাছ রক্ষা, রাবার ড্যাম ও প্যারালাল খাল নির্মাণের মাধ্যমে উজানের পানি প্রত্যাহার বন্ধ এবং অবাধে তামাক চাষ নিষিদ্ধের দাবীতে আজ সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়কের সত্তার ঘাট এলাকায় বিকাল ৩টায় মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে হালদা রক্ষা কমিটি।

সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, প্রায় দুই বছর ধরে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বায়েজিদ থেকে কুলগাঁও পর্যন্ত এলাকার শিল্প কারখানা ও আবাসিকের অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্য হাটহাজারী উপজেলার শিকারপুর এবং মাদার্শা ইউনিয়নের ৬-৭ খাল বেয়ে প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো এলাকায়। এসব অধিকাংশ খালের গন্তব্য দেশের একমাত্র মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। দূষণের শিকার খালগুলো হল-শিকারপুর ইউনিয়নের কুয়াইশ, বাথুয়া, হামিদিয়া ও কৃষ্ণখালি এবং মাদার্শা ইউনিয়নের খন্দকিয়া, কাটাখালি ও মাদারি। এরমধ্যে মদিনা ট্যানারি, রওশন ট্যানারি ও রিফ লেদার নামের প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য কৃষ্ণখালি খাল হয়ে কেডিএস ডাইং ও টিকে ডাইং এর বর্জ্য খন্দকিয়া খাল হয়ে, ইব্রাহিম কটন মিলের বর্জ্য কাটাখালি খাল হয়ে এবং এশিয়ান পেপার মিলের বর্জ্য মাদারি খাল হয়ে হালদায় গিয়ে পড়ছে।

এভাবে অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্য প্রতিনিয়ত হালদা নদীতে পতিত হওয়ায় নদীর কার্প জাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ) মা-মাছ ও জীব বৈচিত্র হুমকির সম্মুখিন হচ্ছে বলে মনে করছেন হালদা গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরিয়া। তিনি এ প্রতিবেদকে আরো জানান, শিল্প কারখানা ও আবাসিকের অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে পতিত হওয়ার ফলে মা-মাছের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে হালদা। এ কারণে চলতি বছর গত ১৮ মে গভীর রাতে প্রবল বর্ষণের সময় মা-মাছ হালদায় স্বল্প পরিমাণে নমুনা ডিম ছাড়ে। স্বাভাবিক নিয়মে ডিম ছাড়বে মা-মাছ এমন আশায় পরের ২ দিন জেলে ও ডিম সংগ্রহকারীরা নদীতে অপেক্ষারত থাকলেও আর ডিম ছাড়েনি মা-মাছ।

নদীর দূষণ প্রতিরোধ করা না গেলে, এমন অবস্থা চলেতে থাকলে হালদার মা-মাছ আর ডিম ছাড়বে কি না তা নিয়েও সন্দিহান ডিম সংগ্রহকারী হালদা পাড়ের মৎস্যজীবি কামাল সওদাগর। তিনি জানান, মারাত্মক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে হালদায়। চলতি বছর মা-মাছ নদীতে অল্প ‘নমুনা ডিম’ ছাড়লেও অন্য বছরের মতো স্বাভাবিক নিয়মে ডিম ছাড়েনি। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ৩ বার দেওয়া স্বল্প পরিমাণে নমুনা ডিম থেকে মাত্র ১২ কেজির মত রেণু পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১২ সালে হালদা নদী থেকে সংগৃহীত ডিমে রেণু হয়েছিল প্রায় এক হাজার ৬০০ কেজি। ২০১৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৬২৪ কেজিতে। ২০১৪ সালে এ পরিমাণ ছিল ৫০০ কেজি। আর গত বছর ২০১৫ সালে সংগৃহীত ডিমে রেণু হয় মাত্র ৪৭ কেজি। তবে যদি নদীর উপর এমন দৈন্যদশা চলতে থাকে তাহলে মা-মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ আরো কমে আসবে, এমনকি আগামী বছর থেকে মা-মাছেরা আর ডিম নাও দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন হালদা বিশেষজ্ঞরা।

প্রসঙ্গত, দেশের একমাত্র মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী বিশ্বের একমাত্র অন্যতম জোয়ার-ভাঁটার নদী। এখানে প্রতি বছর এই সময়ে কার্প জাতীয় রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ সহ বিভিন্ন প্রজাতির মা মাছের নিষিক্ত ডিম ছাড়ে এবং জেলেরা ওই ডিম সংগ্রহ করে তা কয়েক দফায় বিকিকিনি করে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করত। অপার এই জীব বৈচিত্র ও মৎস্য সম্পদের অন্যতম রূপালী খনি জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রেখেছিল।