দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে দিশেহারা হয়ে পড়েছে বিভিন্ন নিষিদ্ধ সংগঠনের জঙ্গিরা। প্রতিদিনই জঙ্গি আস্তানার খোঁজে ও তাদের গ্রেফতারে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্লক রেইড দিয়ে একযোগে অভিযান চালাচ্ছে থানা পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। এমন পরিস্থিতিতে প্রাণ বাঁচাতে আস্তানা গুটিয়ে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করছে জঙ্গিরা। সম্প্রতি বড় দুটি জঙ্গি হামলাকারী ও ২০১৫ সালে দেশজুড়ে ধারাবাহিক গুপ্তহত্যায় জড়িত বেপরোয়া সেই জঙ্গিরা এখন উল্টো ‘দৌড়ের ওপর আছে’ বলে মন্তব্য করেছেন একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা।কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি ও শোলাকিয়ায় ভয়াবহ হামলার পর জঙ্গি দমনে হার্ডলাইনে যায় আইশৃঙ্খলা বাহিনী।
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলার পর পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নতুন ধারার (নব্য জেএমবি) সক্রিয় জঙ্গিদের অপতৎপরতা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে এ সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কসহ অন্তত ২১ সদস্য নিহত হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে অর্ধশতাধিক। তবে এখনো পলাতক ২২ নেতা-সংগঠক। এদের মধ্যে অন্তত এক ডজন জঙ্গি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনায় জড়িত। তাদের মধ্যে কেউ তাত্ত্বিক নেতা, কেউ সংগঠক। সমন্বয়ের কাজ করছে কেউ কেউ। কেউ দিচ্ছে ধর্মীয় দীক্ষা, সামরিক প্রশিক্ষণ। কেউ কেউ অস্ত্র ও বোমা সরবরাহ করছে। আছে আইটি বিশেষজ্ঞও। দলে তারা ছদ্মনামে পরিচিত। তবে সহকর্মীরা এসব নেতাকে ‘বড় ভাই’ বলে ডাকে।
এদিকে,ঘরছাড়া ৩৮ তরুণ-তরুণী দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন পরিবার থেকে। তাদের অবস্থান ও কর্মকা- সম্পর্কে মিলছে না তথ্য। পুলিশ ও গোয়েন্দারা নানামুখী প্রচেষ্টায় তাদের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। এসব নিখোঁজ তরুণ-তরুণীকে নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কারণ প্রাথমিক তথ্য অনুসারে তারা সবাই সন্দেহভাজন জঙ্গি। তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের পর এসব নিখোঁজ তরুণ-তরুণীর সন্ধানে সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর দিকনির্দেশনা পাঠিয়েছে সব জেলায়।পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ক বলেন, যারা নিখোঁজ তারা যেন মা-বাবার কাছে ফিরে আসে, সেটাই আমাদের চাওয়া। তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে যারা উৎসাহ দিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। নিখোঁজরা ফিরে এলে পুলিশ সব ধরনের সহায়তা করবে। তবে কারো বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা থাকলে এই ক্ষেত্রে পুলিশ সহায়তা করবে না। ইতিমধ্যে নিখোঁজদের প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি মা-বাবার উচিত সন্তানরা কোথায় যায়, কী করে তা সার্বক্ষণিক নজরদারি করা।
সূত্র জানায়, পরিবারসহ বিভিন্ন সূত্রে তথ্য সংগ্রহের পর পুলিশ সদর দপ্তর নিখোঁজদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে। তালিকার একপর্যায়ে ৫১ জনের তথ্য ছিল। তাদের মধ্যে ১০ জন ইতিমধ্যে পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছে। আর তিনজন ফিরে এসেছে নিজ পরিবারে। পুলিশ সদর দপ্তর আনুষ্ঠানিকভাবে তালিকা প্রকাশ না করলেও সর্বশেষ নিখোঁজের সংখ্যা ৩৮ বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। আর তাদের প্রায় সবাই জঙ্গি সংগঠন নতুন জেএমবির মতাদর্শী বলে তথ্য মিলছে।পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশে বিচ্ছিন্ন জঙ্গি তৎপরতা নির্মূলে নানা প্রচেষ্টা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এরই মধ্যে ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশ কর্মকর্তা, বিদেশিসহ ২২ জনকে হত্যার ঘটনা চরম উদ্বেগ তৈরি করে। যৌথ বাহিনীর অভিযানে নিহত ছয়জনের পরিচয় যাচাইয়ে দেখা যায়, তাদের পাঁচজনই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। এরপর ঈদুল ফিতরের দিন সকালে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় পুলিশের দুই কনস্টেবল নিহত হন। সেখানে অভিযানকালে নিহত জঙ্গিও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। তরুণ এসব জঙ্গি মতাদর্শীর বেশির ভাগই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী। এ পরিস্থিতিতে র্যাব-পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থা তথ্যানুসন্ধানে নামে। র্যাব প্রথমে ১৮১ জনের একটি নিখোঁজ তালিকা তৈরি করে। পরে তা যাচাই-বাছাইয়ে ৬৮ জনে পৌঁছে। পুলিশ সদর দপ্তর আলাদাভাবে নিখোঁজ তালিকা করে। সেটি যাচাই-বাছাই করে ৫১ জনের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। এ তালিকাভুক্তদের মধ্যে পুলিশের অভিযানে ইতিমধ্যে ১০ জন মারা গেছে। বর্তমানে তালিকায় ৩৮ জনের নাম থাকলেও তারা কোথায় আছে বা কী করছে সেই তথ্য জানা যাচ্ছে না। এ তালিকায় একই পরিবারের চার সদস্য রয়েছে। মঈন উদ্দিন শরীফ, তার স্ত্রী তানিয়া শরীফ, ভাই রেজোয়ান শরীফ ও মা পান্না শরীফ প্রায় দুই বছর ধরে নিখোঁজ বলে জানা গেছে। নিখোঁজদের মধ্যে তেজগাঁওয়ের মোহাম্মদ বাসারুজ্জামান ২০০৭ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। বছর দুয়েক আগে বিয়ে করে এবং পরে নিখোঁজ হয়ে যায়। পরিবারের ধারণা, বাসারুজ্জামান সিরিয়ার সীমান্তবর্তী কোনো এলাকায় আছে। কুষ্টিয়ার মনির হোসেনের ছেলে জুনায়েদ খান ও ইব্রাহিম হাসান খান ২০১৫ সাল থেকে নিখোঁজ আছে। ধানমন্ডির তৌহিদুর রহমানের ছেলে জুন্নুন সিকদার ২০১৫ সাল থেকে নিখোঁজ। সে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। ২০১৪ সালে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য হিসেবে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেছিল। পরে জামিন নিয়ে পালিয়ে যায় জুন্নুন। সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের ছেলে আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম প্রায় এক বছর ধরে নিখোঁজ। প্রায় একই অবস্থা ধানমন্ডির বজলুর রহমানের ছেলে জুবায়েদুর রহিমের ক্ষেত্রে। প্রায় দেড় বছর খবর নেই তার। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের মোহাম্মদ রফিকুল্লাহ আনসারীর ছেলে নজিবুল্লাহ আনসারী চটগ্রাম থেকে নিখোঁজ হয়। লক্ষ্মীপুরের এ টি এম তাজউদ্দিন ওরফে কাওছার দীর্ঘদিন নিখোঁজ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকি বছরখানেক ধরে নিখোঁজ হয়। তার আসল নাম সুজিত দেবনাথ। জাপানের এক নারীকে বিয়ে করে জাপানের নাগরিকত্ব নেয় এবং সেখানেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। গাজীপুরের তৌহিদুল ইসলামের ছেলে রিদওয়ান ইসলাম তুহিন বছরখানেক ধরে নিখোঁজ আছে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার সায়মা আক্তার মুক্তা ও তার স্বামী সাইফুল ইসলাম কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ। সাইফুল সিরিয়ায় নিহত হয়েছেন বলে পুলিশ তথ্য পেয়েছে। ছয় বছরের ছেলে আমান শেখ ও চার বছরের ছেলে রোমান মুক্তার সঙ্গে আছে। মিরপুরের রাবেয়া আক্তার টুম্পা নামের এক তরুণীর সন্ধান মিলছে না দীর্ঘদিন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নুরুল ইসলাম মারজান ওরফে ফাহাদও দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা ডাক্তার রোকন উদ্দিন খন্দকার, তাঁর স্ত্রী নাইমা আক্তার, মেয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রেজওয়ানা রোকন, রামিতা রোকন, ছেলে সাদ কায়েস বর্তমানে সিরিয়ায় অবস্থান করছেন বলে পুলিশ প্রায় নিশ্চিত। আশুলিয়ার আবদুল মালেকের ছেলে আবদুর রহমান মাসুদও দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন,সারা দেশে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের পর ৩৮ জনের জঙ্গি সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব সন্দেহভাজন যেকোনো সময় বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতে পারেÑএমন আশঙ্কা রয়েই গেছে। তারা দেশে, না বিদেশে অবস্থান করছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য মেলেনি। সে কারণে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। নিখোঁজদের সন্ধানে প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপারদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, গুলশান, শোলাকিয়ার ঘটনা তদন্ত, সন্দেহভাজন নিখোঁজদের তথ্য সংগ্রহ, পুরনো জেএমবি সদস্যদের কর্মকান্ড এবং গ্রেপ্তারকৃতদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নব্য জেএমবির এসব দুর্ধর্ষ পলাতক জঙ্গির ব্যাপারে জানা গেছে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ভারতে পালিয়ে গেছে। কয়েকজন আছে মধ্যপ্রাচ্যে। তবে যারা দেশে আছে, তাদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
পলাতক জঙ্গিদের মধ্যে আছে পুরনো জেএমবির শুরা সদস্য মাহফুজ সোহেল ওরফে হাতকাটা সোহেল ওরফে নাসিরুদ্দিন ওরফে ভাগিনা সোহেল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নূরুল ইসলাম মারজান, ডাকাতির সংগঠক ওয়াসিম আজওয়াদ আব্দুল্লাহ ওরফে আসিফ আজওয়াদ, খেলাফত নেতা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ বাঙালি, তাত্ত্বিক নেতা আবুল কাশেম ওরফে বড় হুজুর,উত্তরাঞ্চলের কমান্ডার রাজীব গান্ধী ওরফে রাজীব ওরফে শুভাষ ওরফে জাহাঙ্গীর, মামুনুর রশিদ রিপন ও শরিফুল ইসলাম খালিদ, অর্থ ও আইটি সমন্বয়ক বাশারুল্লাহ ওরফে রাহুল ওরফে চকলেট ওরফে শান্ত, কমান্ডার মানিক, সংগঠক ইকবাল, মামুন, জুনায়েদ হাসান খান, ইব্রাহিম হাসান খান, প্রশিক্ষক আব্দুস সাকিব ওরফে মাস্টার সাকিব, মিজান, অপারেশন বাস্তবায়নকারী বাদল মিয়া ওরফে ওস্তাদ বাদল, দিনাজপুরের আবদুল খালেক ওরফে মামা খালেক, জামায়াত নেতা সাজ্জাদ হোসেন, সাগর, আকাশ ও আজাদুল ওরফে কবিরাজ।সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, নব্য জেএমবির শক্তি অনেক ক্ষয় হয়ে গেছে। গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলার পেছনে যারা ছিল, তাদের অনেকের নাম পাওয়া গেছে। তদন্তের পাশাপাশি পলাতকদের গ্রেপ্তারে অভিযানও চলছে।সিটিটিসি কর্মকর্তারা বলছেন, গুলশানে হামলার সঙ্গে জড়িত চার শীর্ষ জঙ্গি তামিম আহমেদ চৌধুরী, তানভির কাদেরী ওরফে আবদুল করিম, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ও রায়হান কবির ওরফে তারেক (কল্যাণপুরে নিহত) অভিযানে নিহত হয়েছে। গত দুই মাসে আরো ১৭ জন নব্য জেএমবি সদস্য নিহত হয়। গ্রেপ্তার হয়েছে অন্তত ৫০ জন। এতে নব্য জেএমবি প্রায় ৭০ শতাংশ শক্তি হারিয়েছে।
মাহফুজ সোহেল : পলাতক জঙ্গিদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ধষ মাহফুজ সোহেল ওরফে হাতকাটা সোহেল ওরফে নাসিরুদ্দিন ওরফে ভাগিনা সোহেল। পুরনো জেএমবির শুরা সদস্য সে। দীর্ঘদিন ভারতে পালিয়ে থাকলেও গুলশান হামলার কয়েক মাস আগে দেশে আসে। সে গুলশান হামলায় অস্ত্র ও বোমা সরবরাহ করে। ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালের জঙ্গি ছিনতাইয়ের অন্যতম সংগঠক সোহেল বর্তমানে ঢাকাতেই আছে বলে ধারণা তদন্তকারীদের। শেওড়াপাড়ায় একটি বাসার সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে কিছুদিন আগেও ছিল সে। দুই বছর আগে তামিমের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর সে নব্য জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হয়। মাহফুজ গুলশান হামলার অপারেশনাল কমান্ডার নুরুল ইসলাম মারজানের নিকটাত্মীয়। বোমা তৈরির সময় তার এক হাত উড়ে যায়। এক হাতেই সে অস্ত্র চালাতে পারে।
রাজীব গান্ধী : নব্য জেএমবির আরেক দুর্ধর্ষ জঙ্গি রাজীব গান্ধী ওরফে গান্ধী ওরফে রাজীব ওরফে শুভাষ ওরফে জাহাঙ্গীর ওরফে শান্ত ওরফে আদিল। নিজ এলাকায় তার নাম শান্ত হলেও একের পর এক ছদ্মনাম নিয়ে অন্তরালেই আছে সে। এই দুর্ধষ জঙ্গির বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলায়। নব্য জেএমবির অন্যতম সংগঠক গান্ধী এখন উত্তরাঞ্চলের কমান্ডার। তার নেতৃত্ব ও পরিকল্পনায় গত দুই বছরে উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ৩২টি হত্যা-হামলার ঘটনা ঘটে। দীর্ঘদিন খুঁজে অবশেষে গান্ধীর আসল পরিচয় জেনেছেন সিটিটিসি ইউনিটের কর্মকর্তারা। ওই ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, যখন কোনো হামলায় দক্ষ সন্ত্রাসীর প্রয়োজন হয়, তখন রাজীব তাদের সরবরাহ করে। গুলশানে, বগুড়ার দুজন এবং শোলাকিয়ায় একজন জঙ্গি পাঠিয়েছিল সে। উত্তরাঞ্চলের কোথাও সে আত্মগোপন করে আছে বলে ধারণা করছি। ৩৫ বছর বয়সী এইচএসসি পাস এ জঙ্গির গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধায়।
মারজান : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নূরুল ইসলাম মারজান গুলশান হামলার অন্যতম সংগঠক। আইটি এক্সপার্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট মারজান গুলশান হামলার নৃশংসতার ছবি প্রচার করে। সে নব্য জেএমবির সর্বকনিষ্ঠ ন্যাশনাল অপারেশনাল কমান্ডার। বয়স কম হলেও সংগঠনে তার আধিপত্য ব্যাপক। সে সদস্য সংগ্রহ করে থাকে। ঢাকা বা উত্তরাঞ্চলে মারজান লুকিয়ে আছে বলে ধারণা তদন্তকারীদের। তার স্ত্রী আফরিন ওরফে প্রিয়তিকে গত ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরের আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বাশারুল্লাহ ওরফে রাহুল ওরফে চকলেট : রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা ছিল বাশারুল্লাহ। দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ এই যুবকই নব্য জেএমবিতে বাশারুল্লাহ ওরফে আবুল বাশার ওরফে রাহুল ওরফে চকলেট নামে পরিচিত। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বাশারুজ্জামান সংগঠনের আইটি বিশেষজ্ঞ। সে একই সঙ্গে সংগঠনের অর্থ ও পরিকল্পনার সমন্বয়ক। সূত্র জানায়, গুলশান হামলায় জঙ্গিদের জন্য হুন্ডির মাধ্যমে আসা ১৪ লাখ টাকার একটি চালান চকলেটের কাছে আসে। এই চকলেটই বাশারুল্লাহ। আজিমপুরের আস্তানা থেকে তার স্ত্রী শায়লা আফরিনকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।আবু ইউসুফ : পুরনো জেএমবি নেতা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ বাঙালি এখন নব্য জেএমবির খেলাফত নেতা। ভারতে থাকা এই জঙ্গি সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছে বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। গত ১০ আগস্ট রাজধানী থেকে ছয় জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব, যারা দাওলাতুল ইসলাম শব্দ ব্যবহার করে আইএস প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিল। তারা নেতা হিসেবে ইউসুফের নাম জানায়। দেড় বছর আগে ভারতের এনআইএ বাংলাদেশে এসে যে ১০ জনের নামের তালিকা দিয়েছে, তাদের দ্বিতীয় ছিল মাওলানা ইউসুফ শেখ ওরফে বক্কর ওরফে মোহাম্মদ ইউসুফ। বয়স আনুমানিক ৩২ বছর। তার বাবা আবদুল হাফিজ শেখ। ভারতে তার ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান মঙ্গলকোটের কেষ্টবাড়ী।
শরীফুল ইসলাম খালেদ : ভারতের সঙ্গে যৌথ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে জেএমবির উত্তরাঞ্চলের আরেক কমান্ডার শরীফুল ইসলাম খালেদ ওরফে আবু সুলেমান ওরফে জিহাদি জনের নাম। গত ৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান স্টেশন থেকে মুসা নামের একজনকে আটক করে সে দেশের সিআইডি। মুসা দাবি করে, জিহাদি জন ওরফে আবু সুলেমান নামের এক বাংলাদেশি তাকে আইএসের হয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। পরে জানা যায়, আবু সুলেমানই নব্য জেএমবির সদস্য শরীফুল ইসলাম খালেদ। সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যার প্রধান আসামি।
মামুনুর রশীদ রিপন :গুলশান হামলার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে রিপনের নাম। দুর্র্ধষ এই জঙ্গি ভারতে পালিয়ে গেছে বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। গত বছরও রাজশাহীর বাসিন্দা ও উত্তরাঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে কাজ করা মামুনুর রশিদ রিপন কয়েকটি ছদ্মনাম নিয়ে পালিয়ে ছিল। জেএমবির দ-িত কয়েকজন নেতা তার আত্মীয়। গুলশান হামলাসহ বেশ কয়েকটি ঘটনায় তার পরোক্ষ সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে।
ওয়াসিম আজওয়াদ আব্দুল্লাহ ওরফে আসিফ আজওয়াদ : নব্য জেএমবির এই দুর্র্ধষ জঙ্গির অবস্থান নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতির নেতৃত্বে ছিল সে। তবে তদন্তকারীরা তার কোনো ঠিকানাই খুঁজে পাননি। নব্য জেএমবির আরো কয়েকজন সদস্য পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এই জঙ্গির নাম জানালেও তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি তদন্তকারীরা।
আবুল কাশেম ওরফে বড় হুজুর : শায়খ মাওলানা কাশেম নব্য জেএমবির তাত্ত্বিক নেতা। তাকে বলা হয় বড় হুজুর। সর্বশেষ সে দিনাজপুরের ওখড়াবাড়ী মাদ্রাসার শিক্ষক ছিল। গত বছর সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে তামিম চৌধুরী। এই ব্যক্তি কোনো মাদ্রাসাতেই দু-তিন মাসের বেশি থাকে না। তার সর্বশেষ অবস্থান জানার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা।জুনায়েদ ও ইব্রাহিম : কুষ্টিয়ার মনির হোসেনের ছেলে জুনায়েদ হাসান খান ও ইব্রাহিম হাসান খান। গত বছর থেকে নিখোঁজ এই দুই ভাই নব্য জেএমবির সাংগঠনিক নেতা। রাজধানীর বারিধারার বাসিন্দা এই সহোদর মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আত্মগোপনে আছে। জুনায়েদ খান সম্প্রতি ভারতে গেছে বলেও তথ্য মেলে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ইব্রাহিম হাসান খানের ফেসবুক প্রোফাইলে দুই ভাইকে এক ছবিতে দেখা গেছে। ছবিতে তাদের পেছনে আইএসের মতো একটি কালো পতাকা ঝুলতে দেখা যায়। পরদিন প্রোফাইল থেকে ওই ছবি সরিয়ে ফেলা হয়।
সাকিব ওরফে মাস্টার: সাকিব ওরফে মাস্টার ওরফে সাব্বির নামে দিনাজপুরের এক জঙ্গি সংগঠক ও প্রশিক্ষকের ব্যাপারে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। কল্যাণপুরের আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া রাকিবুল হাসান রিগ্যানসহ তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে করতোয়া নদীর চরে শারীরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া দুই ব্যক্তির নাম জানা যায়। তাদেরই একজন সাকিব মাস্টার। অন্যজন মিজান ওরফে মেজর মিজান, যার বাড়ি দিনাজপুরের নওয়াবগঞ্জে। সাকিব উত্তরাঞ্চলে সদস্য সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠায়।আরো যারা অধরা : নব্য জেএমবির পলাতক জঙ্গিদের মধ্যে মানিক ঢাকায়ও সক্রিয়। তবে তার ব্যাপারে এখনো বিস্তারিত তথ্য মেলেনি। কল্যাণপুরের আস্তানা থেকে একটি রাইফেল নিয়ে পালিয়ে যায় ইকবাল নামের আরেকজন, তার বাড়ি গাজীপুরে। সিটিটিসি কর্মকর্তারা বলছেন, ইকবাল শীর্ষ পর্যায়ের নেতা নয়। তবে অপারেশন বাস্তবায়নকারী দলের সদস্য। বগুড়ার শাজাহানপুর থেকে জেএমবি সদস্য সংগ্রহ করছে বাদল। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের আজাদুল ওরফে কবিরাজও উত্তরাঞ্চলের একজন বড় সংগঠক। একইভাবে নাম উঠে এসেছে মামুন, সাগর, আকাশের। তারাও নব্য জেএমবির দুর্ধষ জঙ্গি।জানতে চাইলে সিটিটিসি ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন বলেন, নব্য জেএমবিতে কতজন নেতা আছে তা সঠিক বলা যাবে না। তবে কয়েকজনের নাম আমরা জেনেছি। আরো কিছু নাম শোনা যাচ্ছে। তদন্ত না করে তাদের কী ভূমিকা তা বলা যাবে না।