প্রায় তিন মাস পর গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি ও রেস্তোরাঁর শেফ সাইফুল চৌকিদারের মরদেহ বৃহস্পতিবার দাফন করা হয়েছে। দুপুর ১২টার দিকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ (সিএমএইচ) মরদেহগুলো মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করে।পরে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম মরদেহগুলো জুরাইন কবরস্থানে দাফন করে।আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক লে. কর্নেল রাশিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীরের কাছে দুপুর ১২টার দিকে ছয়টি মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে তিনজন এবং আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের নয়জন প্রতিনিধি ছিলেন।পাঁচ জঙ্গি হলো রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর এ হায়াৎ কবীর, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল।
গত ১ জুলাই গুলশান ২-এর ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় কয়েকজন বন্দুকধারী ঢুকে দেশি ও বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে। রাতভর জঙ্গি হামলায় ১৭ জন বিদেশি, ৩ জন বাংলাদেশি ও পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন। পরে কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও রেস্তোরাঁর এক কর্মী নিহত হয়। এরপর থেকে এ ছয়টি মরদেহ সিএমএইচে ছিল।মাস খানেক পর পাঁচ জঙ্গি ও রেস্তোরাঁর ওই কর্মীর অভিভাবকদের দেহ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে মরদেহ নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আবেদন না করায় তা আঞ্জুমান মুফিদুলের মাধ্যমে দাফন করা হলো।আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ছয়টি মরদেহ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে ।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার সমন্বয়কারী ছিলেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এ দাবি পুলিশের। তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, হামলার দুই দিন আগে আক্রমণকারীদের সঙ্গে তামিম সর্বশেষ ও চূড়ান্ত বৈঠক করেছিলেন। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাসায় ওই বৈঠক হয়েছিল এবং সেখান থেকেই হামলাকারীরা হলি আর্টিজানে গিয়েছিলেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রটি বলেছে, গুলশানে হামলার পরিকল্পনাকারী, সমন্বয়ক, অর্থদাতা এবং হামলায় সহযোগিতা করেছেন এমন ১০ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁরা সবাই নব্য জেএমবির’ নেতা-কর্মী। তাঁদের মধ্যে তামিম পরিকল্পনায় যুক্ত ছিলেন। পরে নারায়ণগঞ্জে নিহত হয় জঙ্গি তামিম । তবে মূল পরিকল্পনাকারী আরেকজন।এ ছাড়া মূল পরিকল্পনাকারী, সমন্বয়ক, অর্থদাতাসহ গুলশানের হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। তাঁদের ধরতে অভিযান চলছে।পুলিশ ইতিমধ্যে গুলশানে হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরী এবং ব্লগার হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে সন্দেহভাজন চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল হককে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে। পরে নারায়ণগঞ্জে নিহত হয় জঙ্গি তামিম ।
মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানে আহত জঙ্গি রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যানসহ বিভিন্ন ঘটনায় গ্রেপ্তার থাকা জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গুলশানে হামলাকারী জঙ্গিরা প্রথমে রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় ভাড়া করা একটি বাসায় উঠেছিলেন। সেখান থেকে তাঁরা হামলার দুই দিন আগে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ভাড়া করা বাসায় গিয়ে ওঠেন। ওই দিনই সেখানে তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেন তামিম চৌধুরী। ওই বৈঠকে আক্রমণকারীদের হামলার ছক বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ১ জুলাই রাতে ওই বাসা থেকেই পাঁচ জঙ্গি গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলা চালান।
তামিম চৌধুরীওই দিন রাত ৮টা ৪২ মিনিটে জঙ্গিরা অতর্কিতে হামলা চালিয়ে দেশি-বিদেশি ২০ নাগরিককে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। ওই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গিদের বোমায় নিহত হন পুলিশের দুজন কর্মকর্তা। পরদিন সকালে সেনা নেতৃত্বে সেনা অভিযানের মধ্য দিয়ে জঙ্গিদের ১২ ঘণ্টার জিম্মি সংকটের অবসান হয়। ওই অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হন। আহত হন র্যা ব ও পুলিশের ৩২ জনসহ মোট ৪১ জন।
অন্তত ছয় মাস আগে গুলশানে হামলার পরিকল্পনা করেছেন জঙ্গিরা। এরই অংশ হিসেবে জঙ্গিরা প্রথমে ঢাকার তিনটি স্থানে মেস ভাড়া নিয়ে হামলাকারীদের প্রশিক্ষণ দেন। এরপর গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরের একটি চরে নিয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষকদের মধ্যে একজন হলেন রায়হান কবির ওরফে তারেক, যিনি কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত নয়জনের একজন। কল্যাণপুরের ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় তামিম চৌধুরীকেও আসামি করা হয়েছে।
ড
জজ্ঞাসাবাদ: গুলশানে হামলার ঘটনায় আট দিনের রিমান্ডে থাকা প্রকৌশলী হাসনাত রেজা করিম ও কানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহমিদ হাসিব খানকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, হলি আর্টিজানে হামলার মাত্র ১৩ মিনিটের মধ্যে হাসনাত করিমের মুঠোফোনে ‘অ্যাপ উইকার’ ডাউনলোড করা হয়েছে। এ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধারণা করছেন, এই অ্যাপ ব্যবহার করেই জঙ্গিরা হলি আর্টিজানের ভেতর থেকে বাইরে যোগাযোগ করে থাকতে পারেন। তাই মুঠোফোনের ফরেনসিক পরীক্ষা করা হবে।মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজমের ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, হাসনাত করিমের মুঠোফোনটি পরীক্ষার জন্য সিআইডির ফরেনসিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে। হাসনাত ও তাহমিদকে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া আলামত বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।হাসনাত রেজা করিম ও তাহমিদকে পুলিশ গুলশানে হামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার দেখায়। এরপর তাঁদের আট দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, নিহত ছয়জনের স্বজনের অভিভাবকত্ব নির্ণয়ের জন্য নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য সিআইডির ডিএনএ পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়।