মেজর জাহিদ সর্ম্পকে পাওয়া গেছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গি সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলামের শ্বশুর-শাশুড়ীর কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এসব তথ্য যাচাই করে দেখা হচ্ছে। তারা এখন পুলিশের নজরদারিতেই আছে।তাছাড়া হামলার ঘটনায় আরও চার সন্দেহভাজন জঙ্গিকে খুঁজছে পুলিশ। এরই মধ্যে ওই জঙ্গিদের নাম জানা গেছে। তাদের অন্যান্য পরিচয়ও জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। এছাড়া জাহিদুলের বাবা পুলিশের সাবেক পরিদর্শক নুরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করার চেষ্টাও চলছে।পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আহমেদ সোমবার বিকেলে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি জানান, রোববার রাতে জাহিদুলের শ্বশুড়-শাশুড়ীকে রাজধানীর শ্যামলী থেকে আটক করে রূপনগর থানায় আনা হয়।তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার কামাল হোসেন।জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে ডিসি বলেন, যেকোনো সময় আবার তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়া যাবে।অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) কামাল হোসেন জানান, শিগগিরই জাহিদুলের বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।এদিকে রূপনগরের ঘটনায় এসআই মেহেদী হাসান বাদী হয়ে শনিবার রূপনগর থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলা নম্বর ২। মামলাটির তদন্ত করছেন একই থানার এসআই আজিজুল হক-১।

মামলায় সন্দেহভাজন চার জঙ্গির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তাদের বয়স বা ঠিকানা উল্লেখ করা হয়নি। তারা হলেন, মানিক, ইকবাল, আকাশ ও সাগর।মামলার বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে, জননিরাপত্তা, সংহতি ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করতে এই জঙ্গিরা অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের ভামূর্তি ক্ষুন্ন করা ও জনমনে আতংক সৃষ্টি করতে তারা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক ও ধারোলো অস্ত্র ব্যবহার করে পুলিশকে আহত করেছে।জঙ্গি প্রশিক্ষণ, গ্রেনেড সরবরাহ, জঙ্গি অর্থায়ন ও জঙ্গি কাজে প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগও আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।

উল্লেখ্য,গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরের ৩৩ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর বাড়িতে পুলিশের অভিযানে জঙ্গি জাহিদুল নিহত হয়। আহত হন রূপনগর থানার ওসিসহ তিন পুলিশ সদস্য। কুমিল্লার সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা নুরুল ইসলামের ছেলে মেজর জাহিদই মিরপুরের রূপনগরে অভিযানে নিহত জঙ্গি জাহাঙ্গীর ওরফে মেজর মুরাদ।তিনি কানাডায় যাওয়ার কথা বলে সেনাবাহিনী থেকে চাকরি ছাড়েন। এরপর যোগ দেন নিউ জেএমবিতে।বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার পরিচয় প্রকাশের পর রোববার ভোর থেকে স্থানীয় সাংবাদিক, উৎসুক জনতা ও পুলিশ কুমিল্লা সদরের ড্রিম হাউজ নামে জাহিদের গ্রামের বাড়ির সামনে ভিড় জমায়।

জানা গেছে, চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী জেবুন্নাহার (শীলা)। বলেছিলেন, আর দেখা না-ও হতে পারে। স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার চার মাস পর গত শুক্রবার রাতে ঢাকার মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের অভিযানে গুলিতে নিহত হন পদাতিক বাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তা। তাঁর স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানের খোঁজ পাওয়া যায়নি।

জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র বলছে, তারা তথ্য পেয়েছে, জাহিদুল তাঁর স্ত্রীকেও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁরা আইএস মতাদর্শে বিশ্বাসী নব্য জেএমবির অন্য অনেকের মতো হিজরত করার কথা বলে গত এপ্রিলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হন।

ওই সূত্র বলছে, তাদের কাছে তথ্য আছে জাহিদ উগ্রবাদে জড়িয়েছেন অন্তত আড়াই বছর আগে। এরপর গত বছর সেনাবাহিনীর চাকরি ছাড়েন। চাকরি ছাড়ার কারণ হিসেবে তিনি তাঁর পরিচিতজনদের বলেছিলেন, চাকরির কারণে ঠিকভাবে তিনি ধর্ম-কর্ম করতে পারছেন না।

জাহিদের ব্যাপারে জানতে চাইলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লে. কর্নেল রাশিদুল হাসান বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর আসার পর আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ২০১৫ সালের জুলাই মাসে এই নামে একজন মেজর অবসরে যান।

জাহিদের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেন, ২০১৩ সাল থেকে জাহিদের আচরণে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। তখন থেকে তিনি পুরোনো বন্ধুবান্ধব ও চেনা জগৎ থেকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন। গত বছরের মাঝামাঝি হঠাৎ কেন সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন, সে বিষয়টি পুরোনো বন্ধুরা জানেন না।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, গুলশান হামলার অন্যতম সমন্বয়কারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। ক্যালগ্যারি ক্লাস্টার নামের কানাডার বহুল আলোচিত একটি জঙ্গি গ্রুপের সঙ্গেও মেজর (অব.) জাহিদের যোগাযোগ ছিল বলে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন।

গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে পুলিশের অভিযানে তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর কানাডার দৈনিক দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তামিম চৌধুরী এই ক্যালগ্যারি ক্লাস্টারে যুক্ত ছিলেন। কানাডার ক্যালগ্যারি শহরভিত্তিক ছোট অথচ ভয়ংকর এই গ্র“পকে দেশটির বাইরে বিভিন্ন হামলার ঘটনায় দায়ী করা হয়ে থাকে।

অবশ্য ঢাকায় ইমিগ্রেশন পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী, কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরী বাংলাদেশে আসেন ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর। আর জাহিদের শ্বশুর মো. মমিনুল হকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জাহিদ ২০১৪ সালের জুন মাসে একটি প্রশিক্ষণে ছয় মাসের জন্য কানাডায় যান। এরপর দেশে ফিরে সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসে যোগদান করেন। তখন তিনি সেনাবাহিনীর রেশন নেওয়া বন্ধ করে দেন। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন।মমিনুল হক বলেন, সেনাবাহিনীর চাকরি ছাড়ার পর ঢাকায় বেসরকারি স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন। এ সময় তিনি দাড়ি রেখে পায়জামা ও পাঞ্জাবি পরা শুরু করেন। জাহিদের মা-বাবা ও বোন জাহিদের এ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেন।

নিহত মুরাদের প্রকৃত নাম জাহিদুল ইসলাম। তারা দুই ভাই এক বোন। জাহিদ সবার বড়। জাহিদের স্ত্রীর নাম জেবুন্নাহার। তাদের দুটি মেয়ে রয়েছে। জাহিদের পৈত্রিক নিবাস সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে।স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৫ সালের দিকে নুরুল ইসলাম কুমিল্লার চাঁন্দপুর এলাকায় বাড়ি নির্মাণ করেন। তৃতীয়তলা ভবনের দ্বিতীয়তলায় তিনি ও তার স্ত্রী জামিলা ইসলাম থাকেন।প্রথম ও তৃতীয়তলা ভাড়া দেয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে নুরুল ইসলামের হার্টে রিং পরানো হয়েছে। গত শুক্রবার তিনি চিকিৎসার জন্য স্ত্রীসহ ঢাকায় গেছেন। এখনও ফিরে আসেননি বলে বাড়ির ভাড়াটিয়ারা জানিয়েছেন। তবে জাহিদ জঙ্গি কর্মকান্ডে জড়িত কিনা তা এলাকাবাসী অবগত নন। সংবাদ মাধ্যমে তারা জাহিদ সম্পর্কে জেনেছেন। জাহিদ ৫/৬ মাস আগে একবার এলাকায় এসেছিলেন। গত রোজার সময় স্থানীয় মসজিদে জাহিদের বাবা বলেছিলেন, জাহিদ মেজরের চাকরি ছেড়ে কানাডা চলে গেছে।তবে জাহিদের সেনাবাহিনীর চাকরি কিংবা স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার তথ্যও বাড়ির লোকজন অবগত নন বলে জানিয়েছেন।এলাকাবাসী মেজর মুরাদের ছবি দেখে সেই ছবি জাহিদ বলে শনাক্ত করেছেন। ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া আবদুল বারেক, জয়নাল আবেদীন, তন্বী আক্তার জানান, তারা জাহিদকে এ বাড়িতে খুব কমই দেখেছেন।ওই বাড়ির সামনে উপস্থিত কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই শাহীন জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জাহিদের পরিবারের খোঁজ-খবর নিতে এখানে আসি, বাসায় ভাড়াটিয়া ছাড়া কেউ নেই। ছবি দেখে স্থানীয়রা জঙ্গি মুরাদকে জাহিদ বলে শনাক্ত করেছেন।এলাকার ইউপি সদস্য মো.ইউনুস মিয়া বলেন, জাহিদকে আমরা চিনি না। তার বাবার সঙ্গে আমাদের পরিচয় রয়েছে। জঙ্গি কার্যক্রমে সে জড়িত ছিল কিনা তাও জানি না।