সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে তুরস্কের ট্যাংক ও সাঁজোয়া বহর প্রবেশের পর তুর্কি সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে আইএস। কুর্দিপন্থী বিদ্রোহী ও আইএস দমনে ওই অভিযান শুরু করে আঙ্কারা। এ অভিযানের অংশ হিসেবে ৩ সেপ্টেম্বর শনিবার তুরস্কের কিলিস প্রদেশ থেকে সিরিয়ায় প্রবেশ করে তুরস্কের সামরিক বহর। তুর্কি সেনারা প্রবেশের পরই সেখান থেকে পালাতে শুরু করে আইএস সদস্যরা। এরপর ৪ সেপ্টেম্বর রবিবার সীমান্ত থেকে আইএসের মূলোৎপাটনের ঘোষণা দেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম। এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেনডেন্ট।
তুরস্কের সীমান্ত সংলগ্ন সিরিয়ার ভূখণ্ড ইতোপূর্বে বিচ্ছিন্নভাবে আইএস এবং কুর্দি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু তুরস্কের অভিযান শুরুর পর সে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। দ্রুততম সময়ে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় আঙ্কারা সমর্থিত ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। এর ফলে পুরো দুনিয়া থেকে আইএসের জঙ্গি সংগ্রহের যে রুট ছিল সেটা বন্ধ হয়ে গেল বলে মনে করা হচ্ছে। আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, রবিবার তুর্কি প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, তুরস্কের সামরিক বাহিনী এবং আঙ্কারা সমর্থিত ফ্রি সিরিয়ান আর্মি আজাজ ও জারাবলুস শহরের মধ্যবর্তী সব এলাকা মুক্ত করেছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস’ এর মুখপাত্র রামি আবদুলরাহমান বলেছেন, ‘সীমান্তে এখন আর আইএসের কোনও উপস্থিতি নেই। ওই এলাকা দখলমুক্ত করতে সিরীয় বিদ্রোহীদের বলতে গেলে কোনও যুদ্ধই করতে হয়নি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আইএসকে পুরো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।’
রামি আবদুলরাহমান বলেন, ‘জারাবলুস শহরে যখন তুর্কি সেনারা ঢুকে পড়ে, তখন আইএস কোনও যুদ্ধই করেনি। তারা পালাচ্ছিল। দুই পক্ষের কারও একজনও মারা পড়েনি।’ গত দেড় বছরে ইরাক এবং সিরিয়ায় নিজেদের দখলকৃত অংশের অর্ধেকেরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে আইএস। ৩ সেপ্টেম্বর সিরিয়ায় প্রবেশ করা তুরস্কের সামরিক বহরে প্রায় ২০টি ট্যাংক, ৫টি সাঁজোয়া গাড়ি এবং ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন ছিল। এর আগে সিরিয়ার অভ্যন্তরে এ অভিযান শুরুর ঘোষণা দেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। তিনি বলেন, আইএস ও কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের লক্ষ্যে এই সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
সিরিয়ার টানা পাঁচ বছরের গৃহযুদ্ধে দেশটিতে এই প্রথম বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু করলো তুরস্ক। আপাতদৃষ্টিতে তাতে বড় ধরনের সফলতাও পেলো দেশটি। ১৯৮০ সাল থেকে তুরস্কের ভূখণ্ডে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে লড়াই চালিয়ে আসছে কুর্দিপন্থী বিদ্রোহীরা। যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত এ কুর্দি বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করে আঙ্কারা। তাদেরকে তুরস্কের অখণ্ডতার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তুরস্কের বিরুদ্ধে হুমকি নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত দেশটির সেনারা সিরিয়ায় অবস্থান করবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম।
এদিকে সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধে কুর্দি বিদ্রোহীদের সঙ্গে তুর্কিপন্থী বিদ্রোহীদের অস্ত্রবিরতির দাবি নাকচ করে দিয়েছে তুরস্ক। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হয়েছিল। তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ওমর কেলিক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবি তার দেশের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কুর্দি যোদ্ধাদের সঙ্গে তুর্কি সেনাবাহিনী কোনও অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে উপনীত হয়নি। কিছুদিন আগেই আইএস বিদ্রোহীদের হাত থেকে সিরিয়ার তুরস্ক সীমান্তবর্তী মানবিজ শহরটি মুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সিরিয়ার কুর্দি বিদ্রোহীরা। তবে বর্তমানে মানবিজের নিয়ন্ত্রণ ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ)-এর হাতে। এটি সিরিয়ার তুরস্কপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তুরস্ক ও সিরীয় কুর্দিদের মধ্যকার সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। একপর্যায়ে দেশটি দাবি করে তুর্কিপন্থী বিদ্রোহীদের সঙ্গে অস্ত্রবিরতিতে উপনীত হয়েছে কুর্দি বিদ্রোহীরা। পরে যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবি প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেয় তুরস্ক।
মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন-এর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উভয় পক্ষেরই লড়াই বন্ধ করা উচিত। তুর্কি ও কুর্দি বাহিনীকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই না করে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টার। এর আগে দীর্ঘদিন আইএসের নিয়ন্ত্রণে থাকার পর গত আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে মানবিজের দখল নেয় যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সিরিয়ার কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ)। শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিতে আইএসের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়ে সহায়তা করে কুর্দি বিদ্রোহীদের সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী। তবে শেষ পর্যন্ত সীমান্তে তুরস্কের অভিযানে পিছু হটে আইএস ও কুর্দি বাহিনী। সিরিয়ার তুর্কি সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ নেয় আঙ্কারা সমর্থিত ফ্রি সিরিয়ান আর্মি।
সূত্র: ইন্ডিপেনডেন্ট, আল জাজিরা, রয়টার্স।