৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে কাঁপল কাঁপলো সারাদেশ

শক্তিশালী ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চল। এই ভূমিকম্প আঘাত হানলে এতে ১৪ কোটি মানুষের জীবন বিপদের মুখে পড়বে। গত এক বছর চার মাসের ব্যবধানেই পাঁচটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়েছে দেশ।এ সময়ের মধ্যে আরও একাধিক মৃদু ভূমিকম্পেও দুলেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল।গত বছর ২৫ এপ্রিল নেপালের ভূমিকম্পের প্রচন্ড আঘাত বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। সর্বশেষ বুধবারের ভূমিকম্পও মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা থেকে অনেক দূরত্ব আর মাটির অনেক গভীরে সৃষ্ট হওয়ায় এসব ভূমিকম্পে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো গেছে। কারণ, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করে মূলত উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ও কেন্দ্র থেকে মাটির কত গভীরে উৎপত্তি, তার ওপর। এক বছরের বেশি সময়ের ব্যবধানে সৃষ্ট পাঁচটি শক্তিশালী ভূমিকম্প দূরত্বের দিক দিয়ে ছিল ঢাকা থেকে অনেক দূরে।

তাদের মতে, গত বুধবার ইতালিতে যে ভূমিকম্প হয় তার মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৬.২। অথচ এর প্রভাবে ইতালির একটি শহর সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কারণ, এর উৎসস্থল ছিল মাটির মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে। অপরদিকে একই দিনে মিয়ানমারে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পটি মাটির ৮৪ কিলোমিটার গভীরে সৃষ্ট। এসময় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূকম্পন অনূভুত হয় ঢাকা থেকে এর দূরত্ব ৫২৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্প উৎপত্তিস্থল থেকে যত দূরে যায় কম্পনের মাত্রাও তত কমে আসে। গত বছর ২৫ এপ্রিল নেপালে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পটিও মাটির মাত্র ১৫ কিলোমিটার গভীর থেকে উৎপত্তি হওয়ায় সেদেশে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে।২৭ জুলাই রয়টার্স এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গবেষণা প্রতিবেদনটি নেচার জিওসায়েন্স জার্নালে প্রকাশ করা হয়।গবেষক দলের প্রধান নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ মাইকেল স্টেকলার বলেন, ওই ধরনের ভূমিকম্প কবে ঘটতে পারে, সে পূর্বাভাস আরও গবেষণা না করে দেওয়া সম্ভব নয়।গবেষণাটি প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্ব যে অংশ সম্ভাব্য এই ভূমিকম্পের কেন্দ্র হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, তার ১০০ কিলোমিটার ব্যাসের মধ্যে প্রায় ১৪ কোটি মানুষের বসবাস।

গবেষণা কর্তৃপক্ষ জানায়, বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ও অন্যতম দরিদ্র এই অঞ্চলে এ ধরনের একটি ভূমিকম্প মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। এমন শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা ভবন, ভারী শিল্প, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রগুলো ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে বলে গবেষকেরা আশঙ্কা করছেন।গবেষক দলের আরেক সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ১৯ কিলোমিটার গভীর পলি জমে বাংলাদেশের যে ভূখ- সৃষ্টি হয়েছে, তা সেই ভূমিকম্পের প্রভাবে জেলাটিনের মতো কেঁপে উঠতে পারে এবং কিছু কিছু জায়গায় তরলে পরিণত হয়ে ইমারত, রাস্তাঘাট আর মানুষের বসতি গ্রাস করতে পারে। এ গবেষণায় প্রায় ৬২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাকে এই ভূমিকম্পের ঝুঁকির আওতায় বলা হয়েছে।

অধ্যাপক আখতার রয়টার্সকে বলেন, তেমন মাত্রার ভূমিকম্প সত্যিই হলে তার ক্ষয়ক্ষতি এতটাই ভয়াবহ হতে পারে যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হয়তো বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। ২০০৪ সালে যে ফল্ট লাইনের ভূমিকম্পে সৃষ্ট সুনামিতে ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল, সেই একই ফল্ট লাইনে নতুন এই ভূমিকম্পের আশঙ্কা দেখছেন বিজ্ঞানীরা। ১০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করতে গবেষকেরা কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করেছেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতে তাঁরা দেখেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্ব অংশের ভূগাঠনিক প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে সরে গিয়ে মিয়ানমারের ভূগাঠনিক প্লেটে চাপ সৃষ্টি করছে, যাতে সৃষ্টি হচ্ছে অস্থিরতা।গত এক বছরের বেশি সময়ের মধ্যে সৃষ্ট এসব ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থান ছিল ঢাকা থেকে উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব মিয়ানমার ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। এসব ভূমিকম্পে বাংলাদেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও সংশ্লিষ্ট দেশে ঠিকই মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। তাদের মতে, দূরে এবং কেন্দ্রস্থলের অনেক গভীরে সৃষ্ট হওয়ায় হয়ত আমাদের দেশে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ঘন ঘন সৃষ্ট ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে জন্য যেন অশনি সঙ্কেত। ভূমিকম্প কবে হবে তা বলা না গেলেও এসব অবস্থা বলে দিচ্ছে ঝুঁকির বাইরে নয় বাংলাদেশ। বিশেষ করে বাংলাদেশের অবস্থান ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে বলে মনে করছেন তারা।

তারা বলছেন, দেশের ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে আর কোন সন্দেহ নেই। তাই সরকারের উচিত হবে ভূমিকম্প বিষয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি গড়ে তোলা। ভূমিকম্প যেহেতু কোন পূর্বাভাস দিয়ে আসে না; আগাম প্রস্তুতি থাকলেও হয়ত অনেক ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে তারা বলছেন, সচেতন থাকলে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা হলেও মোকাবেলা করা যায়। তাদের মতে, ভূমিকম্পের সময় কোন দিকে ছোটাছুটি না করে নির্দিষ্ট স্থানে থেকেই নিজেকে কিভাবে নিরাপদ রাখা যায় সেদিকে বেশি নজর দেয়া উচিত। বিশেষ করে ভূমিকম্পের সময় ভবন থেকে দ্রুত নেমে প্রাণরক্ষার চেষ্টা হিতে বিপরীত হতে পারে। এক্ষেত্রে বড় জোর ভবনের সিঁড়িতে আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। এছাড়া ঘরের আসবাবপত্র থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে শক্ত কোন পিলারের গায়ে আশ্রয় নেয়া যেতে পারে।

গত বছর ২৫ এপ্রিল নেপালে সৃষ্ট ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে বাংলাদেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও আতঙ্কিত হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪ জনের মৃত্যু হয়। আহতের সংখ্যা ছিল ৪শ’। ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্নস্থানে বহু ভবন হেলে পড়া, ফাটল দেখা দেয়া ও ধসে পড়ার খবর পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত ৮০ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে এত বড় ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ার কোন রেকর্ড নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভয়াবহ মাত্রার ওই ভূমিকম্পটি ঢাকা থেকে সাড়ে ৭শ’ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নেপালের কাঠমান্ডু থেকে ৮২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম এলাকায়। তাদের মতে, উৎপত্তিস্থলের ১৫ কিলোমিটার মাটির গভীর থেকে উৎপন্ন হওয়ায় নেপালে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হলেও দূরত্বের কারণে বাংলাদেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। নেপালে ২৫ এপ্রিল ভূমিকম্পের রেশ কাটতে না কাটতেই ১২ মে আবারও রিখটার স্কেলে ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। তবে সেটিরও উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৬১১ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নেপালে। মূলত দূরত্বের কারণে নেপাল থেকে উৎপন্ন হওয়ার পর পর দুটি ভূমিকম্পে দেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ববিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ন আকতার বলেন, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করে মূলত দূরত্ব আর উৎপত্তিস্থলের গভীরতার ওপর। নেপালে দুটি ভূমিকম্পই ছিল মূলত ঢাকা থেকে ৭শ’ ও ৬শ’ কিলোমিটার দূরে। এছাড়া ২৫ এপ্রিল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল মাত্র ১৫ কিলোমিটার মাটির গভীর থেকে। এ কারণে ওই ভূমিকম্পে অধিকমাত্রা ও স্বল্প গভীরতা থেকে উৎপন্ন হওয়ায় নেপালে মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনে। পরের ভূমিকম্পও মাটির অনেক গভীরে সৃষ্ট বলে মাত্র ৩০ জনের মৃত্যু হয়।

আবার এ বছর জানুয়ারির শুরুরদিকে গত ৪ জানুয়ারি ভোরে সবাই যখন ঘুমে ঠিক তখনি আরও একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সারাদেশ। ভূমিকম্পের প্র্রচ- ঝাঁকুনিতে আর ভবনের মটমট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় সবার। ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। প্রাণ বাঁচানোর তাগিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে অধিকাংশ মানুষ। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৬.৭। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের মনিপুর রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল থেকে ২৯ কিলোমিটার পশ্চিমে। যার দূরত্ব ঢাকা থেকে ৩৪৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। অধিক দূরত্বের কারণে দেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও আতঙ্কে দেশের বিভিন্নস্থানে ৫ জনের মৃত্যু হয়।এর রেশ কাটতে না কাটতে গত পয়লা বৈশাখের আগের দিন আরেকটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে মানুষ। গত ১৩ এপ্রিলের ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৬.৯। ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল ঢাকা থেকে ৪৬৫ কিলোমিটার পূর্বে মিয়ানমারের দক্ষিণ-পূর্বে মাউলাইক শহরের ৭৪ কিলোমিটার পূর্বে। উৎপত্তিস্থলে মাটির ১৩৫ কিলোমিটার গভীর থেকে ভূমিকম্পটির উৎপত্তি। তবে দেশে ক্ষয়ক্ষতি না হলেও অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

সর্বশেষ বুধবার বিকেলের শক্তিশালী ভূমিকম্পে আবারও কেঁপে ওঠে সারাদেশ। শুধু বাংলাদেশে নয় পার্শ্ববর্তী ভারতের বিভিন্ন এলাকায়ও এর প্রভাবে তীব্র কম্পন অনুভূত হয়। আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী রিখটার স্কেলে এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬.৮। উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে ৫২৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের চাউকে। উৎপত্তিস্থলের ভূ-উপরিভাগের ৮৪ কিলোমিটার গভীর থেকে ভূমিকম্পটি সৃষ্ট হয়েছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক বছরের বেশি সময়ের মধ্যে উৎপত্তি সব ভূমিকম্পই বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে। আবার মাটির অনেক গভীর থেকে উৎপত্তি হওয়ায় এটির কম্পনের তীব্রতা অনেক কম ছিল। এ কারণে দেশে এর প্রভার পড়লেও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে দেশের ভেতর থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। যে কোন মাত্রার সম্ভাব্য শক্তিশালী ভূমিকম্প দেশের উৎস থেকে সৃষ্ট হলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। যেমন ২৫ এপ্রিল নেপালে ভূমিকম্পটি রিখটার স্কেলে যেমন অনেক শক্তিশালী ছিল তেমনি মাটির মাত্র ১৫ কিলোমিটার গভীর থেকে উৎপত্তি হওয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টি করে। একইভাবে ইতালির ভূমিকম্পটিও মাটির মাত্র ১০ কিলোমিটারের মধ্যে উৎপত্তি হওয়ায় ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে।