একেএম শহীদুল হকের

নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় অভিযান চলাকালে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক। তিনি বলেন, জঙ্গিরা পুলিশের ওপর গ্রেনেড ও গুলি ছোড়ায় বাধ্য হয়ে রেড করা হয়েছে। গুলি চালানো হয়েছে।শনিবার নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব কথা বলেন আইজিপি শহীদুল হক। অভিযানে নিহত তিন জঙ্গির মধ্যে এক জঙ্গির সঙ্গে গুলশান, কল্যাণপুর ও শোলাকিয়া হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীর ছবির হুবহু মিল রয়েছে বলে জানান তিনি। আইজিপি বলেন, এতে স্পষ্ট তিনি তামিম হবেন।

এক ঘণ্টা ধরে ‘হিট স্ট্রং ২৭ নামে মূল অভিযান চলে বলে জানান আইজিপি। অভিযানে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ইউনিট, পুলিশের স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিকস (সোয়াট) ও নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ অংশ নেয়।শহীদুল হক আরও বলেন, নব্য জামাআতুল মুজাহিদীনের একটি শাখার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তামিম চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। কানাডার সিটিজেন। সিরিয়া থেকে তামিম চৌধুরী প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন বলে তাঁদের কাছে খবর রয়েছে। গুলশান, শোলাকিয়াসহ সব হামলাই নিউ জেএমবি ঘটিয়েছে।অনেক দিন ধরেই পুলিশ তামিম চৌধুরীকে খুঁজছিল জানিয়ে শহীদুল হক বলেন, তাঁদের কাছে তথ্য ছিল তামিম নারায়ণগঞ্জে আছেন। ঈদের পর প্রায় এক মাস ধরেই সম্ভবত তাঁরা নারায়ণগঞ্জে ছিলেন। ওষুধ ব্যবসার কথা বলে তাঁরা সেখানে ছিলেন।অভিযান সম্পর্কে আইজিপি বলেন, অভিযানের পরে ভেতরে ঢুকে দেখা গেল সেখানে তিন জঙ্গি নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজনের চেহারা তামিমের ছবির সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। নিহত জঙ্গিদের একজনের সঙ্গে রাইফেল ও একজনের সঙ্গে পিস্তল ছিল। তাঁরা লাইফ জ্যাকেট পরেছিলেন।

জঙ্গিরা প্রতিরোধ করেছিলেন কিনা জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, প্রতিরোধ থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর ছিল। জঙ্গিদের সঙ্গে কথা বলার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলাম। আত্মসমর্পণ করতে চাইলে হাত উঁচু করে দরজা খুলে বের হয়ে আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু জঙ্গিরা পুলিশের ওপর গ্রেনেড ছুড়েছে। গুলি করেছে। পুলিশ বাধ্য হয়ে রেড করেছে। গুলি করেছে।ঘটনাস্থলে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল কাজ করছে বলে আইজিপি জানান। সবকিছু পরিষ্কার হলে প্রত্যেক নিহত জঙ্গির ছবি পাওয়া যাবে। পরে কার্যক্রম চলবে।ওই বাড়ির ভেতরে জঙ্গি ছাড়া আর কেউ আছে কিনা নিশ্চিত হওয়ার পর অভিযান চালানো হয়েছে বলে আইজিপি জানান। কানাডায় বেড়ে ওঠা তামিম আহমেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে জঙ্গিদের নতুন ধারায় তৎপরতার নেপথ্য ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল পুলিশ, যিনি শনিবার নারায়ণগঞ্জে অভিযানে নিহত হলেন।গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন হামলায় ১৭ বিদেশিসহ ২২ জনকে হত্যার পর মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে এই তামিমকেই চিহ্নিত করেছিল পুলিশ।

গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় ঘরছাড়া তরুণ-যুবকদের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিখোঁজ ১০ জনের যে প্রথম তালিকা দিয়েছিল, তাতে সিলেটের তামিমের নাম আসে।এর আগে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস বাংলাদেশে দলের শাখাপ্রধান হিসেবে যে আবু ইব্রাহিম আল হানিফের নাম ঘোষণা করেছিল,সেই ব্যক্তি তামিম বলেই অনেকে মনে করছিলেন।তবে গুলশান হামলার পরই তামিমের নামটি ব্যাপক আকারে আলোচনায় আসে।তামিম সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার দুবাগ ইউনিয়নের বড়গ্রামের প্রয়াত আব্দুল মজিদ চৌধুরীর নাতি। মজিদ চৌধুরী একাত্তরে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন বলে স্থানীয়দের তথ্য।

তামিমের বাবা শফি আহমদ জাহাজে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি সপরিবারে কানাডায় পাড়ি জমান। কানাডার উইন্ডসরে থাকার সুবাদে ৩০ বছর বয়সী তামিমের বেড়ে ওঠাও সেখানে।পরিবার সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা না গেলেও গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তামিম তিন সন্তানের জনক।তামিমের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার শুরু কীভাবে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানা যায়নি। বলা হচ্ছিল, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ফেরার পর থেকে তিনি নিখোঁজ।তিনি ২০১৩ সালের অক্টোবরে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন বলে গত ২ অগাস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।গুলশান হামলার পর তামিমের খোঁজে নামে পুলিশ। তখন বলা হচ্ছিল, তামিম দেশেই রয়েছেন।আইএস-সংশ্লিষ্টতার দাবি প্রত্যাখ্যান করে আইজিপি শহীদুল এক সংবাদ সম্মেলনে তামিমকে ‘নব্য জেএমবি’র শীর্ষনেতা বলে চিহ্নিত করেন।

তিনি বলেছিলেন, এখানে (গুলশান হামলা) মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী। নিও জেএমবির নেতৃত্ব সে দিচ্ছে।এই তামিম চৌধুরীর পর যারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রধান তাদেরকেও আমরা চিহ্নিত করেছি।আইজিপি বলেছিলেন, গুলশান হামলাকারীদের তামিমই রিক্রুট করেছিলেন।ঘটনার আগে সে তাদের ব্রিফিং দিয়েছে, তাদেরকে পাঠিয়েছে এবং ঘটনার সময় তাদেরকে এগিয়ে দিয়েছে, আমরা সে তথ্য পেয়েছি।

গুলশান হামলার পর ঢাকার কল্যাণপুরে যে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নয়জন নিহত হয়েছিলেন, সেখানেও তামিমের অবস্থান ছিল বলে মনিরুল জানিয়েছিলেন।এরপর তামিমের বিষয়ে তথ্য দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি অভিযান শুরু করে পুলিশ।এর মধ্েযই শনিবার ভোরে নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইকপাড়ায় একটি তিন তলা বাড়ি ঘিরে অভিযানে নামে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা, যার নাম দেওয়া হয় অপারেশন হিট স্ট্রং টুয়েন্টি সেভেন।সকাল সাড়ে ৯টা থেকে এক ঘণ্টার অভিযানে তামিমসহ তিনজন নিহত হন বলে মনিরুল জানান।তামিমকে গ্রেপ্তার করা গেলে জেএমবির নতুন ধারার আদ্েযাপান্ত বেরিয়ে আসবে বলে আশা করেছিলেন পুলিশ প্রধান শহীদুল হক। অভিযানের সময় উপস্থিত নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, অভিযান শুরুর পর জঙ্গিরা বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, তারা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলেছে।তবে অভিযানের পর ওই এলাকা পরিদর্শনে যাওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, তামিম চৌধুরীর অধ্যায় এখানেই শেষ হল।