সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকজন বন্ধুর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল কানাডা ফেরত রাশেদুজ্জামান ওরফে রোজ। এরপর দেশে ফিরে এসে আব্দুল হাইয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের আমির মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে। তার মাধ্যমেই যোগ দেয় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ- জেএমবিতে। উচ্চ শিক্ষিত হয়েও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে পরিচালনা করতো সাংগঠনিক কার্যক্রম। একই সঙ্গে জেএমবির নারী সদস্যদের প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করতো রাশেদুজ্জামান রোজ। সম্প্রতি র্যাবের হাতে মাহমুদুল হাসান গ্রেফতার হওয়ার পর জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের আমিরের দায়িত্ব পায় সে। বুধবার ভোরে রাজধানীর উপকণ্ঠ টঙ্গীর ছয়দানা হাজিরপুকুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাশেদুজ্জামান রোজসহ জেএমবি’র পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব। রোজের সঙ্গে গ্রেফতারকৃত অন্যরা হলো মোহাম্মদ আব্দুল হাই (৩৬), সাহাবুদ্দিন ওরফে শিহাব ওরফে রকি (২৩), ফিরোজ আহম্মেদ শেখ ওরফে ফিরোজ ওরফে আনসার (২৭) ও সাইফুল ইসলাম।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে ২টি বিদেশি পিস্তল, ৮ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, ৩টি ম্যাগাজিন, ২টি চাপাতি, ১৪টি বিদেশি ছুরি, ৩টি ককটেল, ৫টি ডেটোনেটর, ৫০ গ্রাম পটাশিয়াম, ১৫টি চকলেট বোমা, ২৫টি ইলেক্ট্রোনিক ক্র্যাকার্স, ১টি ল্যাপটপ, বিপুল পরিমাণ জিহাদি বই এবং বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। মুফতি মাহমুদ জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানায়, তারা সবাই নাশকতার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে বড় কোনও নাশকতা করা।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাশেদুজ্জামান রোজ জানিয়েছে, মাহমুদুল হাসান গ্রেফতার হওয়ার পর সে তার স্থলাভিষিক্ত হয়। সে ২০০১ সালে ঝিনাইদহ থেকে এসএসসি ও ২০০৩ সালে এইচএসসি পাস করে। এরপর এমবিবিএস পড়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষায় নির্বাচিত হলেও এমবিবিএস না পড়ে ২০০৬ সালে কানাডায় গিয়ে সেন্ট মারিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকে ভর্তি হয়। ২০১২ সাল পর্যন্ত সে কানাডায় অবস্থান করে। কানাডায় অবস্থানের সময়েই সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকজন বন্ধুর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। এই বন্ধুদের কয়েকজন হলো- আহমেদ কাতিব,মোহাম্মদ কাতিব ও ওমর কাতিব।
২০১২ সালে সে দেশে ফিরে আসে। এরপর পরিবারকে মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে বলে, সে নিজ গ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে এবং ২০১৪ সালে এলাকায় জ্বালানি তেলের ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করে। র্যাব জানায়,রাশেদুজ্জামান রোজের ঢাকার বাসা দক্ষিণ পীরের বাগের মুক্তি হাউজিং -এ। ১৫১/১ নম্বর বাড়ির ৪/সি নম্বর ফ্ল্যাটে বাবা-মা, স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে থাকতো সে।তার বাবা খয়বর হোসেন জনতা ব্যাংকের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আর মা রাজিয়া ইয়াসমিন মহাখালীতে ক্যান্সার হাসপাতালে কর্মরত। রাশেদুজ্জামান রোজ বিবাহিত, তার স্ত্রী মুক্তা খাতুন (মাহমুদা) বর্তমানে পড়াশুনা করছে। তাদের আট মাস বয়সী একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। ছেলের নাম আব্দুর রহমান (শামা)।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, ঝিনাইদহে থাকতে রাশেদুজ্জামানের সঙ্গে আব্দুল হাইয়ের পরিচয় হয়। পরে আব্দুল হাইয়ের মাধ্যমে তার পরিচয় হয় জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের আমির মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে। মূলত শিক্ষিত ও সমমনা হওয়ায় মাহমুদুল হাসান তাকে জেএমবিতে অন্তর্ভুক্ত করে। পরবর্তীতে সে মাহমুদুল হাসানের সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতো। মাহামুদুল হাসান তাকে জেএমবির মহিলা শাখা পরিচালনা ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেয়। এই মহিলা শাখার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে পরিচয় ঘটে জেএমবি মহিলা শাখার নেত্রী আকলিমার সাথে ।
র্যাব সূত্র জানায়, গত ২১ জুলাই মাহামুদুল হাসানকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপরই রাশেদুজ্জামান রোজ দক্ষিণাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালন করতে থাকে। রাশেদের ল্যাপটপে জঙ্গিসংশ্লিষ্ট কিছু নৃশংস ছবি ও ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। প্রশিক্ষণের সময় সদস্যদের সে এসব ছবি ও ভিডিও দেখাতো বলে স্বীকার করেছে। র্যাব সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত আব্দুল হাই ঝিনাইদহের একটি মসজিদের ইমাম হলেও সে নানাবিধ পেশার সাথে জড়িত ছিল। বিভিন্ন সময়ে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা, হোমিও চিকিৎসক ও মোবাইল টাওয়ারে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কাজ করতো। এছাড়া সে আহলে হাদিস আন্দোলনের ঝিনাইদহ শাখার সেক্রেটারি বলে জানায়।
আব্দুল হাই র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানায়, প্রথমে নলডাঙ্গা ভুষন হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে অধ্যায়ন করে। পরবর্তীতে মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে। ১৯৯৯ সালে আলিম এবং ২০০১ সালে দাখিল পাশ করে। এরপর ২০০৭ সালে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আল-হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে। সে কালিগঞ্জ দাখিল মাদ্রাসায় দুবছর শিক্ষকতা করে। পরবর্তীতে ২০১০ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে শিশুদের জন্য সহজ কুরআন শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হয়।২০১৪ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাকে চাকরিচ্যূত করে। সে যশোর ও ঝিনাইদহ এলাকায় বিভিন্ন সময় জেএমবির বৈঠক আয়োজন করতো। উক্ত বৈঠকে দক্ষিণাঞ্চলের আমির মাহমুদ ও জেএমবির অন্যান্য নেতা উপস্থিত থাকতো। এই ধরনের কোনও এক বৈঠকে সে রাশেদুজ্জামানকে মাহমুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এছাড়া আব্দুল হাই মাহমুদের নির্দেশনা মতো দক্ষিণাঞ্চল থেকে সদস্য রিক্রুট করে বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণের জন্য ফিরোজের কাছে পাঠাতো। আর ইয়ানত সংগ্রহ করে সাইফুল ইলেক্ট্রোনিক মানি ট্রান্সফার সিস্টেমের মাধ্যমে ফিরোজের নিকট পৌঁছাতো।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, গ্রেফতারকৃত সাহাবুদ্দিন ওরফে শিহাব ওরফে রকি হচ্ছে শোলাকিয়া হামলায় অংশগ্রহণকারী শফিউলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, শফিউল গ্রেফতার হওয়ার আগে তারা এক সঙ্গে একাধিকবার চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। সে দু-একটি মিশনে অংশও নিয়েছিল। রকি দিনাজপুরের নারায়ণপুর প্রাইমারি স্কুলে পড়ার পর স্থানীয় একটি কওমি মাদ্রাসায় প্রায় ৪ বছরের মতো লেখাপড়া করে। পরবর্তীতে মিরপুরের একটি গার্মেন্টসে ২৫-২৬ দিন চাকরি করে। তারপর বাড়ি ফিরে যায়। বছর তিনেক আগে সে শফিউলের মাধ্যমে জেএমবিতে যোগ দেয়। অপরদিকে ফিরোজ আহম্মেদ শেখ ওরফে আনসার ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। ২০০৮ সালের শেষের দিকে সে ঢাকায় আসে। ২০১০ সালের মাঝামাঝি বাড়িতে বেড়াতে গেলে সিরাজগঞ্জের মাহমুদুল হাসানের সাথে পরিচয় হয়। মাহমুদুলের মাধ্যমে সে জেএমবিতে যোগ দেয়। সে বর্তমানে লাইব্রেরি ব্যবসার আড়ালে জেএমবির সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতো।
র্যাব জানায়, গ্রেফতারকৃত সাইফুল নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানাধীন আশরাফুল উলুম মাদ্রাসায় কৈলাদিতে পড়াশুনা করতো। ২০০৩ সালের দিকে সিলেটের বিশ্বনাথপুর থানাধীন একটি মাদ্রাসায় হাফেজিয়া পড়াশুনা করতে যায় এবং ২০০৭ সাল পর্যন্ত সিলেটের বিভিন্ন মাদ্রাসায় হাফেজি পড়ে। পরবর্তীতে ২০১০ সালের দিকে ঢাকায় তানজিম সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে চাকরি করার সময়ে আলাউদ্দিন সরকার মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে এক বড় ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। ওই বড় ভাইয়ের মাধ্যমে সাইফুল হাজিরপুকুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে মোয়াজ্জিন হিসেবে যোগদান করে। হাজিরপুকুর মসজিদের নিচে বই বিক্রেতা ফিরোজের সাথে এ সময় তার সখ্যতা হয় এবং ফিরোজ তাকে জেএমবিতে সম্পৃক্ত করে।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্ণেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের সহযোগীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।