জেএমবি

বোমাহামলার কয়েকটি ঘটনা আগে ঘটলেও ২০০৫ সালের আগে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার খবর তেমন আলোচনায় ছিল না; কিন্তু ওই বছরের ১৭ অগাস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জঙ্গিরা জানান দিয়েছিল যে তারা কতটা সক্রিয়।১৭আগস্ট, ২০০৫।বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা। দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে ৫০০ বোমা ফাটিয়ে অস্তিত্ব, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জানান দিয়েছিল জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এরপর ছয় মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠাতা ও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার, পরের বছর ফাঁসি কার্যকর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার মুখে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জঙ্গি সংগঠনটি। কিন্তু ১১ বছরের মাথায় সেই জেএমবি ভয়ংকররূপে আবির্ভূত হয়ে গত ১জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলা ও হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পুনরুত্থানের জানান দিয়েছে।

তবে এই সংগঠন বা গোষ্ঠীটি নিজেদের আইএস (ইসলামিক স্টেট) দাবি করছে। আর পুলিশ বলছে, এরা নব্য জেএমবি। মূল জেএমবি থেকে বেরিয়ে এসে পৃথকভাবে সংগঠিত হয়েছে।প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশে¬ষণ করে দেখা গেছে, নব্য জেএমবি’র বাইরে সংগঠনটির আরও দুই অংশ এরই মধ্যে এক হয়ে সম্প্রতি সংগঠনের নতুন নেতা নির্বাচন করেছে। এ অংশটি নিজেদের মূলধারার জেএমবি দাবি করে। জঙ্গিনিরোধ ও আন্তদেশীয় অপরাধ দমন-সংক্রান্ত বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, জেএমবির কথিত এই মূলধারার ভারপ্রাপ্ত আমির বা নতুন নেতা হয়েছেন সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন। ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে এই সালাহউদ্দিনকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন জঙ্গিরা। তাঁর বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায়।দীর্ঘদিন জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় কার্যকর বা সমন্বিত পদক্ষেপ ও নিরবচ্ছিন্ন গোয়েন্দা নজরদারির অভাবে ১১ বছরের মাথায় এত ভয়ংকররূপে আবির্ভূত হয়েছে জেএমবি। তিনি বলেন, বিপর্যস্ত জেএমবি আবার ঘুরে দাঁড়াবে, সেটা কেউ ধারণা করেনি। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থা জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করলেও নিরবচ্ছিন্ন গোয়েন্দা নজরদারি ছিল না। তেমনি কারাগারে থাকা জঙ্গিরা কে কখন সাজা শেষে বা জামিনে বের হচ্ছেন, সেটারও ভালো নজরদারি হয়নি।এই কর্মকর্তার মতে, ২০০৭ সাল থেকেই জঙ্গিবাদবিরোধী বিশেষায়িত বাহিনী বা বিভাগ করে একই কেন্দ্র থেকে মামলার তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ, নিরবচ্ছিন্ন গোয়েন্দা নজরদারিসহ সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল।

অবশ্য পর্যবেক্ষকদের মতে, ২০০৭ সালে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ফাঁসি ও নিযুক্ত আমির সাইদুর রহমানসহ বেশ কিছু জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আত্মতুষ্টিতে ভুগছিল। তারা ভেবেছিল জঙ্গিবাদ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কোনো মতাদর্শী উগ্র গোষ্ঠীকে এভাবে শেষ করা যায় না। যতক্ষণ না মতাদর্শ বিলুপ্ত হয়, ততক্ষণ এরা নতুন নতুনরূপে আবির্ভূত হবে। তার ওপর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে অনুকূল পরিবেশ থাকলে এটা নতুন মাত্রা পায়। যার বড় নজির গুলশান হামলা।

তবে জেএমবির এই পুনরুত্থানের বিষয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ যেভাবে বিস্তৃত হয়েছে, তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। ফলে এখানকার অনেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে, সংগঠিত হয়েছে। তবে এদের নিয়ন্ত্রণে আনার সক্ষমতা পুলিশের রয়েছে।

পুনঃসংগঠিত হওয়া শুরু:প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমানের পর জেএমবির দ্বিতীয় আমির মাওলানা সাইদুর রহমানসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। এরপর সংগঠনটির কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিছু সদস্য তখন আনসারুল¬াহ বাংলা টিমের দিকেও ঝুঁকেছিলেন বলে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে বাইরে থাকা জেএমবির সদস্যরা আবার সংগঠিত হতে শুরু করেন। কারাগারে থেকে সাইদুরসহ অন্যান্য জঙ্গিনেতার নির্দেশনাও পাচ্ছিলেন বাইরের জঙ্গিরা, এমন খবর বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের বরাতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ২০১৩ সাল থেকে এই জঙ্গিরা খুলনা ও ঢাকায় কিছু হত্যাকা- ঘটান। কিন্তু বিষয়টি তখন ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

২০১৪ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি ময়মনসিংহের ভালুকায় প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যা করে জঙ্গি সালাহউদ্দিনসহ জেএমবির শীর্ষস্থানীয় তিন নেতাকে (অপর দুজন বোমা মিজান ও হাফেজ মাহমুদ) ছিনিয়ে নেওয়ার পর টনক নড়ে সরকারি বাহিনীগুলোর। এরপর জানাজানি হয় যে জেএমবি তিন ভাগে ভাগ হয়ে পৃথক নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছে। এর একাংশের নেতৃত্বে থাকা কারাবন্দী সাইদুর রহমান তাঁর ছেলে আবু তালহা মোহাম্মদ ফাহিমের (২০১৫ সালের ২৭ জুলাই ঢাকায় গ্রেপ্তার) মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের সদস্যদের সংগঠিত করছিলেন। আরেকটি অংশ সংগঠিত হচ্ছিল প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সালাহউদ্দিন ও জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজানের নেতৃত্বে ভারতে বসে।

জঙ্গিদের তৎপরতা নজরদারি ও এ-সংক্রান্ত তদন্ত তদারক করেন এমন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, জেএমবির এই অংশটি নিজেদের নতুন উপস্থিতির জানান দিতে ২০১৪ সালের শেষ দিকে দেশে বড় নাশকতা ঘটানোর পরিকল্পনা করছিল। কিন্তু তার আগে ওই বছরের ২ অক্টোবর ভারতের বর্ধমানের একটি আস্তানায় বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণের কারণে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সম্প্রতি এ অংশটি মাওলানা সাইদুরের অংশের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে। সাইদুরকে আমির পদে বহাল রেখে সালাহউদ্দিনকে ভারপ্রাপ্ত আমির করা হয়েছে। এ অংশটির তৎপরতা সীমান্তের ওপারে ভারতেও রয়েছে, সেখানে সংগঠনটির অনেকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। জেএমবির অপর অংশটি মূলত আইএস মতাদর্শ অনুসরণ করে। নিজেদের আইএস দাবি করলেও বাংলাদেশ সরকার তা নাকচ করে দিয়ে বলে আসছে যে দেশে কোনো আইএস নেই। এরা জেএমবির একটি অংশ।

তবে এই নব্য জেএমবির প্রধান বা শীর্ষ নেতা কে, তিনি দেশে না দেশের বাইরে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেনÑএ বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি। যদিও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, তামিম চৌধুরী ও মারজান ছাড়াও এই গোষ্ঠীর সাত-আটজন মাস্টারমাইন্ডকে’ তাঁরা শনাক্ত করতে পেরেছেন।

জানা গেছে, শনাক্ত হওয়াদের মধ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর দেশে আসেন এবং দেশীয় জঙ্গিদের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেন। যদিও তারও আগে উগ্রপন্থায় যুক্ত হওয়া যুক্তরাজ্যপ্রবাসীদের কেউ কেউ এখানে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন বলে বিভিন্ন সময়ে তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, রিপন ও রাজীব নামে নব্য জেএমবি’র আরও দুজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকের নাম পাওয়া গেছে, যাঁদের বাড়ি উত্তরবঙ্গে এবং তাঁরা মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব প্রবাসী বাঙালি সিরিয়া গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের কারও কারও সঙ্গে এই নব্য জেএমবিদের যোগাযোগ আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শুরুর দিক থেকেই জেএমবির তৎপরতার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নুর খান। তাঁর মতে, এই কথিত নব্য জেএমবির সঙ্গে ১৯৯৮ সালে শায়খ আবদুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত জেএমবির অনেক তফাত। আগের মতো দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত নয়, উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সন্তান ও আধুনিক শিক্ষিতরাও যুক্ত হয়েছেন নব্য জেএমবিতে। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, নাবিকÑএমন নানা পেশাজীবীও আছেন। বিদেশে লেখাপড়া কিংবা বসবাস করেন, এমন ব্যক্তিরাও যুক্ত হয়েছেন। যাঁরা আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে এ দেশে এসে জঙ্গিদের সমন্বয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

ঢাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশি জঙ্গিদের মধ্যে ঘরছাড়া বা হিজরত করার ধারণা ঢুকিয়েছেন প্রবাসী বা প্রবাসফেরত জঙ্গিরা। মো. নুর খানের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এ কাজে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংস্থাগুলোর সদস্যদের বড় অংশের জঙ্গিগোষ্ঠী সম্পর্কে জানা-বোঝায় ঘাটতি ছিল এবং এখনো আছে। এ ছাড়া বিষয়টিকে কেবল আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে দেখা হয়েছে। এর মতাদর্শিক দিক মোকাবিলা বা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

এই পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অনেকটা একমত জানিয়ে বলেন, এ ধরনের ধর্মভিত্তিক মতাদর্শিক গোষ্ঠীর মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি থাকতে হয়। যেটার ঘাটতি আছে।এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশে¬ষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, এখন পর্যন্ত দেশে জঙ্গিবাদ মোকাবিলার কোনো কর্মকৌশল ঠিক হয়নি। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় র‌্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং অন্যদের কার কী দায়িত্ব, কর্মপরিচালনার পদ্ধতি কী হবে, তা ঠিক করা হয়নি। তিনি বলেন, গুলশান হামলার পর সমাজে জঙ্গিবাদবিরোধী একটা সচেতনতা ও বোধশক্তি জাগ্রত হয়েছে। সরকারের উচিত সমাজের এই বোধশক্তিকে কাজে লাগানো এবং সবাইকে নিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া।

শুরুতে অস্বীকার করে এলেও তারপর জেএমবি নামে জঙ্গিরা নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিলে প্রশাসনকেও নড়েচড়ে উঠতে হয়। জেএমবিসহ চারটি দল নিষিদ্ধ এবং শীর্ষ জঙ্গিনেতাদের ফাঁসিতে ঝোলানোর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুরও তুলতে শুরু করেছিল।কিন্তু ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ আন্দোলন গড়ে ওঠার পর তার বিপরীতে নাস্তিক ব-গারদের’ শাস্তির দাবিতে হেফাজতে ইসলামের সক্রিয়তার প্রেক্ষাপটে একটির পর একটি হত্যাকান্ড ঘটতে থাকে।

২০০৫ সালের বোমা নিয়ে হামলার পর চাপাতি ও ধারাল অস্ত্রে লেখক, প্রকাশক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, পুরোহিত, যাজক, শিয়াদের উপর বিচ্ছিন্ন হামলার পর এই বছর গুলশানে কূটনীতিক পাড়ায় হলি আর্টিজান বেকারিতে অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে এক হামলায় ১৭ বিদেশিকে হত্যার সাক্ষী হয় বাংলাদেশ।এর মধ্েযই নতুন নতুন দলের খবর আসে, তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে জঙ্গিদের পারদর্শিতাও উন্মোচিত হয়, হামলার পর নানা নামে ইন্টারনেটে বার্তাও আসতে থাকে, আইএস কিংবা আল কায়দার মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর নামে হয় দায় স্বীকারও; তবে ১১ বছর পর ঘুরেফিরে আবার ফিরে এসেছে ২০০৫ সালের সেই জেএমবির নামই।আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সেই জেএমবি কয়েকটি ধারায় ভাগ হওয়ার পর তার একটি এখন ‘নিও জেএমবি’ নামে সক্রিয় এবং তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমসহ কয়েকটি সংগঠন।

গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমের সাম্প্রতিক ধারার শুরুটা হয়েছিল হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বা হুজির মধ্য দিয়ে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনীর হয়ে লড়াই চালিয়ে আসা বাংলাদেশিরাই এ সংগঠনটি গড়ে তোলেন।আমরা সবাই তালেবান-বাংলা হবে আফগান এই ¯ে¬াগানে মিছিল আড়াই দশক আগে বাংলাদেশে দেখা গেলেও হুজির তৎপরতা তখনও প্রকাশ্য ছিল না। এরপর ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর সম্মেলন, ২০০১ সালে পল্টনে সিপিবির সমাবেশ ও রমনা বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান, গোপালগঞ্জে গির্জা এবং নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ কার্যালয়, ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলা হলেও এসব ক্ষেত্রে জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতার খবরটি তখন পুলিশের তদন্তেও আসেনি।একইভাবে বইমেলার বাইরে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ইউনুসের উপর হামলা হলেও তার পেছনে যে সংঘবদ্ধ জঙ্গিরা রয়েছে, তা তখন পর্যন্ত ছিল অজানা। আর তখন হামলার দায় স্বীকার করে কোনো সংগঠনের কোনো ধরনের বার্তাও আসেনি।

২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট দেশজুড়ে বোমা হামলা চালানোর সময় প্রতিটি স্থানে প্রচারপত্র রেখে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয় জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি। গত শতকের ৯০ দশকে গঠিত এই দলটি প্রকাশ্যে আসার আগে রাজশাহীর বাগমারায় এক ধরনের মহড়াও দিচ্ছিল বলে গোয়েন্দারা বলছেন। ১৭ অগাস্ট বোমা হামলার পর ঝালকাঠীতে বিচারক ও গাজীপুর আইনজীবী সমিতিসহ বিভিন্ন এলাকায় আদালত লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে জেএমবি। বাংলাদেশে আত্মঘাতী হামলা এই জেএমবির মধ্য দিয়েই শুরু হয়।ঝালকাঠীর দুই বিচারক হত্যা মামলায় ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ফাঁসি কার্যকর হয় আমির শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইসহ জেএমবির ছয় শীর্ষনেতার। এরপর প্রকাশ্য তৎপরতা কমে আসে এই সংগঠনটির। আগে শুধু আদালত লক্ষ্য করে হামলা হলেও ২০১৩ সালের পর হামলার ধরন বদলে শুরু হয় গুপ্তহত্যা। নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত করে একের পর এক হামলা হতে থাকে; সেটা কখনও নির্জন রাস্তায়, কখনও ব্যস্ত সড়কে, কখনও বাড়িতে, কখনও কার্যালয়ে।

অসাম্প্রদায়িক লেখক-সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা এবং সবশেষে বিদেশিরা।শুরুতে গ্রেনেড ও বোমা হামলা চালিয়ে হামলার যে প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল, তা থেকে ধারাল অস্ত্র ব্যবহারের পর এখন দেখা যাচ্ছে একে-২২ রাইফেল, পিস্তলের মতো আগ্নেয়াস্ত্র।তখন জঙ্গি হিসেবে মাদ্রাসা ছাত্রদের নাম এলেও এখন বিদেশ থেকে পড়ে আসা এবং দেশের নামি সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদেরও দেখা যাচ্ছে এই নব্য জেএমবিতে। আধুনিক শিক্ষায় বেড়ে ওঠা স্বচ্ছল পরিবারের এই তরুণ-যুবকদের তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের পারদর্শিতায় গোয়েন্দারাও হিমশিম খাচ্ছেন।জঙ্গিদের আক্রমণের ধরন বদলানোর বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, জঙ্গিবাদের ধরন বদলাচ্ছে, কারণ আগে আন্তর্জাতিক অবস্থাটা এই রকম ছিল না।এটা মোকাবেলার উপায় কী- প্রশ্ন করা হলে সাবেক এই পুলিশ প্রধান বলেন, এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভাল রকমের গোয়েন্দা তথ্য দরকার। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট করা হয়েছে, এটা ভালো।পুলিশের চোখে নিষ্ক্রিয়তার মধ্েয ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশকে মেরে তিন জেএমবি নেতাকে জঙ্গিরা ছিনিয়ে নেওয়ার পর নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। তারপর গত ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর পুলিশ জানায়, কানাডা প্রবাসী তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে সক্রিয় আছে এখন নিও জেএমবি।সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমি যতদূর জানি, জেএমবি এখন তিনভাগে বিভক্ত। একটা গ্র“প হচ্ছে, ওল্ড জেএমবি। এই ধারার মূল নেতাদের ফাঁসি হয়েছে। এই গ্র“প খুব বড় নয়। পুলিশের বক্তব্য অনুসারে অন্য একটি গ্রুপ বেশ শক্তিশালী মনে হয়।বাংলাদেশে আইএস তার শাখার প্রধান হিসেবে আবু ইব্রাহিম আল হানিফের নাম ঘোষণা করেছিল বলে তাদের কথিত সাময়িকী দাবিক-এ খবর প্রকাশ হয়েছিল; তামিম চৌধুরীই সেই ব্যক্তি বলে অনেকে মনে করছেন।সাখাওয়াত বলেন, এই দুই ব্যক্তি এক কি না, সেটা আমি বলতে পারব না। মনে হয় তামিম চৌধুরী আইএস সংযুক্ত অংশের সঙ্গে বেশ ভালোভাবে সংযুক্ত। এটা যদি জেএমবির অংশ হয়ে থাকে, তাহলে সম্ভবত তিনিই এই অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।তিনি যদি জেএমবির এই অংশের নেতৃত্বে থেকে থাকেন, তাহলে এ সম্পূর্ণ নতুনভাবে সংগঠিত জেএমবি। যার সঙ্গে পুরাতন জেএমবির কোনো সম্পর্ক নাই।তামিম চৌধুরীর যে অংশটা রয়েছে, এরা মূলত ইন্টারনেট প্রজন্ম। তবে তাদের সঙ্গে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও রয়েছে। সমাজের পৃথক দুই ধারার এই সমন্বয়ও বেশ বিস্ময়কর।

জেএমবির তৃতীয় ধারাটি আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল¬াহ বাংলাটিমের সঙ্গে একীভূত হয়ে থাকতে পারে বলে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা মনে করেন।আনসারুল¬াহ বাংলা টিম খুব সম্ভবত প্রশিক্ষণ, সাইবার ওয়ারফেয়ার ইত্যাদি কাজে তাদের প্রকাশ্য নাম। বৈশ্বিকভাবে আনসার আল ইসলাম মূলত আল কায়দা থেকে জন্ম নেওয়া। এটা ইরাকভিত্তিক। এক পর্যায়ে তারা দুই ভাগ হয়ে যায়। যার একভাগের নেতৃত্বে ছিলেন আবু মুবাব আল জারকাবি, যারা পরে আইএস হয়ে যায়। অন্যভাগ হচ্ছে সিরিয়ার আল নুসরা ফ্রন্ট।আইএসের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে সাখাওয়াত বলেন, আইএস দুইভাবে কাজ করে। একটা হচ্ছে, তারা বেলায়েত ঘোষণা করে। বেলায়েত মানে হচ্ছে প্রদেশ। মিসর, ইয়েমেন ও লিবিয়ায় তাদের তিনটি বেলায়েত রয়েছে। এ সব জায়গায় কেন্দ্রের সঙ্গে তাদের সরাসরি লিঙ্ক রয়েছে।অন্য সব জায়গায় স্থানীয় গ্র“প কাজ করছে। যেমন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার কাতিবাহ নুসানতারা।বাংলাদেশের এই জঙ্গিদের বিষয়ে সাখাওয়াত বলেন, হয়ত এরা স্থানীয়ভাবে কাজ করছে, যাদের আইএসের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রয়েছে। আইএসের শাখা হতে কাজ দেখানোর অংশ হিসাবে তারা নতুন নতুন হামলা করছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেনের মতে বাংলাদেশের নতুন ধারার জঙ্গিবাদী দলটিকে আইএস না বলে নব্য জেএমবি’ বলাই যুক্তিযুক্ত।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অরল্যান্ডোতে যখন হামলা হয় তখনও আইএস তার দায় স্বীকার করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, সেই হামলাকারীদের সাথে তারা আইএসের কোনো সংযোগ খুঁজে পায়নি। ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র ভাবছে, এরা মূলত আইএস দ্বারা উৎসাহিত হয়েছে।পৃথিবীর যেখানেই সন্ত্রাসবাদী ধরনে কোনো আক্রমণ হয়, তার দায় স্বীকার করা আইএসের একটা প্রবণতা হয়ে গেছে।ভীতি ছড়ানোর জন্যও স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের নাম ব্যবহার করতে পারে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।এদের আইএস না বলার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আইএস সাধারণত নির্বিচারে হত্যা করে। সুযোগ পেলেই তারা হামলা করে।বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন তারা বিদেশিদের মারছে? মাইনোরিটির লোকজনদের মারছে? মাইনোরিটির উপর হামলা হলে ভারত; খ্রিস্টানদের উপর হামলা হলে পশ্চিমারা; জাপানিদের উপর হামলা হলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী দেশটি উদ্বিগ্ন হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এগুলোর সবগুলোই একটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।বাংলাদেশে ইসলামের নামে এই ধরনের তৎপরতা সফল হবে না বলে মনে করেন দেলোয়ার। বাংলাদেশের ভোটিং প্যাটার্ন দেখলেই বোঝা যাবে, সবচেয়ে বড় ইসলামি দলটাও কিন্তু বড় জোর ৫ শতাংশ পায়। এটা থেকেই বোঝা যায়, এখানে জনগণের মাঝে এই ধরনের সন্ত্রাসের কোনো স্থান নাই।তারা আফগানিস্তানে কিছু চাইলে করতে পারে, কারণ সেখানে ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি রয়েছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা স্বল্পকালীন লক্ষ্যকেন্দ্রিক কার্যক্রমই মনে হয়, যার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা।