ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির চার সদস্যকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছে, যারা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলের ছাত্রী।এরা হলেন- মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের ছাত্রী আকলিমা রহমান, মৌ ও মেঘনা এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ঐশী।র্যাব-৪ এর সিপিসি ১ এর অধিনায়ক মেজর সাইদ বলছেন, আটকদের মধ্যে আকলিমা জেএমবির নারী বিভাগের উপদেষ্টা, অন্যরা তার সহযোগী।মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়ায় র্যাব-৪ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
র্যাব জানায়,ওই চারজনকে গাজীপুরের সাইনবোর্ড, মগবাজার ও মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা হলেন জেএমবির নেত্রী আকলিমা রহমান, ঐশী, মৌ ও মেঘলা। আকলিমা মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী।র্যাবের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২১ জুলাই র্যাব জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের আমির মাহমুদুল হাসানকে গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তার করে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, তাঁদের কার্যক্রমে মেয়েদের একটি দল জড়িত। ওই দলের নারী সদস্য আকলিমা রহমান তাঁকে গত রমজান মাসে ১২ হাজার টাকা ইয়ানত (চাঁদা) জোগাড় করে দেন। এর পর থেকে র্যাব আকলিমাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখে।র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী আকলিমা বিভিন্ন সময় জেএমবির দাওয়াতি কার্যক্রমে যোগ দিতে প্ররোচনা দিয়ে আসছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে নতুন ধারার জঙ্গিবাদে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তাঁর ওপর নজরদারির ধারাবাহিকতায় র্যাব-৪-এর একটি দল গতকাল দিবাগত রাত দুইটার দিকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাঁর মুঠোফোনে জঙ্গিবাদ ও বিপুল পরিমাণ অন্যান্য তথ্য পাওয়া যায়। দেড় বছর ধরে তিনি এই জিহাদি দলের সঙ্গে রয়েছেন। মাহমুদুল হাসানের কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণের পর তাঁর সংশ্লিষ্টতা আরও বেড়ে যায়।
র্যাবের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আকলিমার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মগবাজার থেকে ঐশী নামের আরেক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর কাছ থেকে ল্যাপটপ জব্দ করে এতে বিপুল পরিমাণ জিহাদি-বিষয়ক তথ্য, ম্যাগাজিন, লেকচার ভিডিওর সফট কপি পাওয়া গেছে। মিরপুর-১-এর জনতা হাউজিংয়ে অভিযান চালিয়ে মৌ নামের আরেক নারীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। র্যাব তাঁর বাসায় প্রবেশের আগেই তিনি মুঠোফোনের মেমোরি কার্ড ধ্বংস করে ফেলেন। পরে র্যাব তাঁর বাসায় তল্লাশি চালিয় জিহাদি চেতনামূলক বই উদ্ধার করে।র্যাবের তথ্যমতে, আকলিমা ও মৌয়ের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে মেঘলা নামের অপর একজন নারী জিহাদি দলে ভেড়েন। তাঁকেও গতকাল রাত ১০টার দিকে মিরপুরের জনতা হাউজিংয়ের সাবলেট বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। অন্যদের মতো তাঁর কাছ থেকেও একই ধরনের জিহাদি বই, বক্তৃতা ও জিহাদি ভিডিও এবং নির্দেশনার সফট কপি পাওয়া যায়।
গত ২১ জুলাই জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলীয় আমীর মো. মাহমুদুল হাসান ওরফে হাসানকে (২৭) টঙ্গী থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে কয়্জেন নারীর এ দলে যুক্ত থাকার তথ্য পাওয়া যায় বলে র্যাব কর্তকর্তারা জানান।র্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি লুৎফুল কবির মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, হাসানের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে তারা জানতে পারেন, আকলিমা রহমান নামে জেএমবির এক নারী সদস্য রমজান মাসে ১২ হাজার টাকার তহবিল সংগ্রহ করে দিয়েছেন। এরপর তাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে নেওয়া হয়।বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি আকলিমা আরবি শিক্ষার কথা বলে বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগ করতেন। তার সঙ্গে অনেকেই সাক্ষাত করতেন। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।আকলিমার মোবাইল ফোন থেকে জঙ্গি কর্মকান্ডের অনেক তথ্য পাওয়া গেছে বলেও র্যাবের ভাষ্য।লুৎফুল কবির বলেন, আকলিমা প্রায় দেড় বছর ধরে কথিত ওই জিহাদী দলটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কথিত ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য দলকে বড় করা এবং সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তিনি তহবিল সংগ্রহ করে মাহমুদুল হাসানকে পৌঁছে দিতেন।
আকলিমা রহমান: প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকার রেনেসাঁ প্রি-ক্যাডেট হাই স্কুল ও সাইনবোর্ড এলাকার হাজী আহাম্মদ আলী পাবলিক স্কুলে।উত্তরা হাই স্কুল থেকে ২০১০ সালে এসএসসি এবং হলি চাইল্ড কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইচএসসি পাশ করেন। ২০১৩ সালে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া এই তরুণী পড়ছিলেন ফার্মাসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষে।
ঐশি: চিকিৎসক বাবা মায়ের সন্তান ঐশী ২০১০ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। চলতি বছর জানুয়ারিতে এমবিবিএস শেষ করে জুন মাসে তিনি ইন্টার্নশিপ শুরু করেন।ঐশীর বাবা ডা. বিশ্বাস আক্তার হোসেন (৫৮) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। আর মা ডা. নাসিমা সুলতানা (৪৮) আছেন সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগে। মৌ: মিরপুর-২ এর ইসলামীয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি ও মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডের বিসিআইসি কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইচএসসি পাস করেন মৌ। মেডিকেল ও ইউনিভার্সিটি ভর্তির জন্য তিনি ইউসিসির ফার্মগেইট শাখায় কোচিং করেন। পরে ২০১৩ সালে ভর্তি হন মানারত ইউনিভার্সিটির ফার্মাসি বিভাগে।
মেঘনা: ঢাকার আহম্মদনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে এসএসসি ও ঢাকা ক্যামব্রিয়ান কলেজ থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেন মেঘনা। ওই বছরই পারিবারিকভাবে তার বিয়ে হয়। মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী তিনি।জিজ্ঞাসাবাদে আকলিমা র্যাবকে জানান, তার যোগানো ১২ হাজার টাকার মধ্যে আট হাজার টাকা দিয়েছেন ঐশী, যিনি প্রায় তিন বছর ধরে প্রত্যক্ষভাবে এ দলে জড়িত।ওই তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার রাতে মগবাজার এলাকা থেকে ঐশীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার ল্যাপটপে ‘উগ্র মতবাদ সংক্রান্ত বিভিন্ন ফাইল, ম্যাগাজিন, লেকচার ও ভিডিও পাওয়া যায় বলে র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
মৌ : র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, আকলিমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা মৌয়ের নাম জানতে পারেন, যিনি সাত মাস ধরে এ দলে যুক্ত। মৌকে আটক করা হয় মিরপুর-১ এর জনতা হাউজিং থেকে।এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র্যাব জানায়, মৌয়ের বাসায় অভিযান চালানোর সময় তিনি তার মোবাইল ফোনের মেমোরি কার্ড ধ্বংস করে ফেলেন। তার ল্যাপটপে ‘জিহাদি কর্মকান্ডের দলিল’ পাওয়া যায়; বাসায় পাওয়া যায় উগ্র মতবাদের বই।পরে মৌয়ের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জনতা হাউজিংয়ের একটি মেস থেকে মেঘনাকে আটক করা হয় বলে জানানো হয় ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
এর আগে গত জুলাই মাসে সিরাজগঞ্জ এবং টাঙ্গাইল থেকে জেএমবির সাত নারী সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল অস্ত্র, বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম এবং উগ্র মতবাদের বই।টাঙ্গাইলে গ্রেপ্তার তিনজন জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য বলেও সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলাসহ বাংলাদেশে সাম্প্রতিকউগ্রপন্থিদের বিভিন্ন নাশকতার ঘটনায় জেএমবিকেই দায়ী করে আসছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। ওই দুই ঘটনা এবং কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় নিহত জঙ্গিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যারা বাড়ি পালিয়ে জঙ্গিবাদে জড়ান বলে পরে তথ্য বেরিয়ে আসে। গত কয়েক মাস ধরে নিখোঁজদের তালিকায় যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নারীও রয়েছেন।