রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার আরেক পরিকল্পনাকারী ছিলেন মারজান

রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার আরেক পরিকল্পনাকারী ছিলেন মারজান (সাংগঠনিক নাম)। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। হামলাসংক্রান্ত সব ছবি মারজানের আইডি থেকেই বাইরে পাঠানো হয়।শুক্রবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানানো হয়।এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের প্রধান (সিটি) মনিরুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর গুলশান, কল্যাণপুর ও শোলাকিয়া হামলার মাস্টারমাইন্ড’ তামিম চৌধুরী ও ব্লগার হত্যায় জড়িত বলে সন্দেহে থাকা চাকরিচ্যুতসেনা কর্মকর্তা জিয়াউল হক ঢাকাতেই আছেন বলে তাঁদের ধারণা।হামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়া হাসনাত ও তাহমিদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

মনিরুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে দারুস সালাম থানার টেকনিক্যাল মোড় এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া নব্য জামাআতুল মুজাহিদীনের (জেএমবি) পাঁচ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গুলশান ও কল্যাণপুরের হামলা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন আতিকুর রহমান ওরফে আইটি আতিক, মো. আবদুল করিম বুলবুল ওরফে ডা. বুলবুল, আবুল কালাম আজাদ, মতিউর রহমান, শাহিনুর রহমান হিমেল ওরফে তারেক। ঘটনাস্থল থেকে নান্নু, সজীব, ইমরান, জিন্সিসহ কয়েকজন পালিয়ে যান। এসব এঁদের সাংগঠনিক নাম।ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে ২৫টি ডেটোনেটর, ৮৭৫ গ্রাম জেল উদ্ধার করা হয়েছে। রাজধানীর টেকনিক্যাল মোড় থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) পাঁচ সদস্যকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁদের আটক করা হয়।মনিরুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজন উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। কল্যাণপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে জঙ্গিরা নিহত ও একজন গ্রেপ্তার হওয়ার পর ঢাকায় নব্য জেএমবির কর্মিসংকট দেখা দেয়। এ জন্য তাঁরা উত্তরবঙ্গ থেকে কাঁচামাল নিয়ে ঢাকায় আসেন।আতিকুর নব্য জেএমবির উচ্চপদে রয়েছেন বলে জানান মনিরুল। অন্যরা সবাই সদস্য। এঁদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ রয়েছে। বড় ধরনের হামলার উদ্দেশে তাঁরা ঢাকায় আসেন। যে দুজনকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জঙ্গি কর্মকান্ডের হোতা বলা হচ্ছে, সেই তামিম চৌধুরী ও মো. জিয়াউল হক ঢাকাতেই অবস্থান করছেন বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা।ওই দুইজনকে ধরিয়ে দিতে চলতি মাসের শুরুতে ২০ লাখ টাকা করে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম কার্যালয়ে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমাদের ধারণা, তারা ঢাকাতেই আছেন। আমরাও চেষ্টা করছি এবং অন্য সবার কাছে সহযোগিতা চেয়েছি। ধরিয়ে দিতে পারলে ২০ লাখ টাকা করে পুরস্কারের ঘোষণাও হয়েছে।

এদের মধ্যে বরখাস্ত মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হককে ২০১২ সালে সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারী বলছে পুলিশ। তিনি জঙ্গি দল আনসার আল ইসলামের হয়ে কাজ করছেন বলে এর আগে মনিরুল রয়টার্সকে জানিয়েছিলেন।আর কানাডীয় পাসপোর্টধারী বাংলাদেশি নাগরিক তামিম চৌধুরীকে আইএস এর বাংলাদেশ শাখার সমন্বয়ক বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবরে।পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক গত ২অগাস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে তামিম ও জিয়াকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেন।

সেদিন তিনি বলেন, তদন্ত করতে গিয়ে আমরা যা পেয়েছি, এখানে মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী। নিও জেএমবির নেতৃত্ব সে দিচ্ছে। এই তামিম চৌধুরীর পর যারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রধান তাদেরকেও আমরা চিহ্নিত করেছি। তাদেরকে আমরা গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।আরেকটা গ্র“প আছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। সেখানে তদন্তে আমাদের ধারণা হয়েছে, তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া।কানাডার উইন্ডসরের বাসিন্দা তামিম ২০১৩ সালের অক্টোবরে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে আসার পর থেকে নিখোঁজ বলে ২ অক্টোবর জানিয়েছিলেন মনিরুল।তখন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি কেন- এ প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, তখন তার জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানা যায়নি। তদন্তে ২০১৫ সালে তার নাম বেরিয়ে আসে।

আর জিয়ার বিষয়ে মনিরুল সেদিন বলেছিলেন, তার নাম আসে জঙ্গি হামলার ঘটনায় বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের আদালতে দেওয়া জবানবন্দি থেকে।জিয়া ও তামিম দেশেই আছে বলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সেদিন ধারণা দিয়েছিলেন মনিরুল। শুক্রবার তিনি সংবাদ সম্মেলনে আসেন ঢাকার দারুস সালাম এলাকা থেকে জেএমবির পাঁচ সদস্যকে বিস্ফোরকসহ গ্রেপ্তারের বিষয়ে তথ্য জানাতে।তিনি বলেন, অভিযানের সময় পাঁচজনকে ধরা গেলেও আরও চারজন পালিয়ে যায় বলে গ্রেপ্তাররা পুলিশকে জানিয়েছে।কল্যাণপুরের ঘটনায় নয়জন নিহত হওয়ার পর ঢাকায় জেএমবির কর্মী সঙ্কট দেখা দেয়। তাই এদেরকে উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকায় আনা হয়। মূলত প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করতে তাদের ঢাকায় আনা হয় বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেছে।গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের এক বাড়িতে আইন-শৃঙ্খলা বহিনীর বিশেষ অভিযানে নয় জঙ্গি নিহত হয়। তারাও জেএমবির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে পুলিশের দাবি।মনিরুল বলেন, গুলশানের ঘটনার পর কল্যাণপুর ছাড়াও বিভিন্ন স্থানের অন্তত দশটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছে পুলিশ। গুলশান ঘটনার দিন জঙ্গিরা ভেতর থেকে বাইরে যে ছবি ও মেসেজ পাঠিয়েছিল, তা মারজান (সাংগঠনিক নাম) নামের এক তরুণ ছড়িয়ে দেয় বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। সে ঢাকায় অবস্থান করছে। সে শিক্ষিত ছেলে বলে মনে হয়েছে। তার একটি ছবি গোয়েন্দা সদস্যদের হাতে রয়েছে।

প্রসঙ্গত, রাজধানীর গুলশান, কল্যাণপুর ও শোলাকিয়া হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী ও ব্লগার হত্যায় সন্দেহভাজন চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল হককে ধরিয়ে দিলে ২০ লাখ টাকা করে ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। তথ্যদাতার নাম-পরিচয় গোপন রাখা হবে।গত মঙ্গলবার পুলিশের সদর দপ্তরে সংবাদ ব্রিফিংয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক এ ঘোষনা দেন।

ঐ সময় সাংবাদিকদের আইজিপি শহীদুল হক বলেন, গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরের হামলার পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ, সার্বিক অর্থায়ন-সবকিছুর সঙ্গেই তামিম চৌধুরী জড়িত। তাঁর বাবার নাম শফিক আহমেদ।মায়ের নাম খালেদা শফি চৌধুরী।বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার বড়গ্রামফাদিমাপুরে। জন্ম ১৯৮৬ সালের ২৫ জুলাই। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর তামিম সর্বশেষ দুবাই থেকে বাংলাদেশে আসেন। তিনি এখন দেশে, না বিদেশে আছেন,তা স্পষ্ট নয়।ব্লগার হত্যায় সন্দেহভাজন বরখাস্ত হওয়া সেনা কর্মকর্তা জিয়াউলের হকের পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। তাঁর বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিল্লুল হক। বাড়ি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরে। সর্বশেষ ব্যবহৃত বর্তমান ঠিকানা পলাশ, মিরপুর সেনানিবাস, ঢাকা।সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশের সদর দপ্তরে এই ব্রিফিং করা হয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, নিষিদ্ধঘোষিত জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলাগুলোর জন্য দায়ী।কানাডার পত্রিকা ন্যাশনাল পোস্ট এই মাসের শুরুতে প্রকাশিত খবরে বলেছে, আইএসের (ইসলামিক স্টেট) কথিত বাংলার খিলাফত দলের প্রধান শায়খ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক। তাঁর প্রকৃত নাম তামিম চৌধুরী। তিনি কানাডা থেকে বাংলাদেশে চলে গেছেন। এর আগে গত ১৩ এপ্রিল অনলাইনে প্রকাশিত আইএসের নিজস্ব সাময়িকী দাবিক-এর ১৪তম সংখ্যায় আইএসের কথিত বাংলাদেশ প্রধান শায়খ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়। এতে জানানো হয়, কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে শক্ত ঘাঁটি করতে চায় আইএস। নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি ও সমর্থনপুষ্ট অন্যান্য সংগঠনের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শের মাধ্যমে সহায়তা ও প্ররোচনা’দেওয়ার অভিযোগে তামিম চৌধুরীসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ।

পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন-এর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৯ জানুয়ারি করাচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে এক বন্দুকযুদ্ধে এজাজসহ আল-কায়েদার চার জঙ্গি নিহত হয়। ওই খবরে এজাজ ওরফে সাজ্জাদকে একিউআইএসের কমান্ডার বলে উল্লেখ করা হয়। পরে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত গোয়েন্দারা এজাজ নিহত হওয়ার কথা নিশ্চিত হন।এজাজের মৃত্যুর পরে আনসারুল্লাহ নতুন নেতৃত্বে পুনর্গঠিত হয়। জসীমুদ্দিন রাহমানীর স্থলে তাত্ত্বিক নেতা হন পুরান ঢাকার ফরিদাবাদের এক মাদ্রাসাশিক্ষক। আর সামরিক শাখার নেতৃত্বে আসেন মেজর (বহিষ্কৃত) সৈয়দ মো. জিয়াউল হক। তিনি ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সেনা অভ্যুত্থানে প্ররোচনা চালিয়ে ব্যর্থ হন। এরপর থেকে পলাতক। তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়।ওয়াকিবহাল একটি সূত্র জানায়, মেজর জিয়া আগে থেকেই উগ্র গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানী গ্রেপ্তার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, ধরা পড়ার আগে তিনি একাধিকবার ঢাকা ও চট্টগ্রামে মেজর জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের ধারণা, জিয়া এই জঙ্গিগোষ্ঠীর সামরিক শাখার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৫ সালে সবচেয়ে বেশি ব্লগার হত্যা ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলা এত বেশি নিখুঁতভাবে হয় যে ঘাতকদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কর্মকর্তাদের ধারণা, নতুন নেতৃত্ব আসার পর আনসারুল্লাহ আনসার আল ইসলাম নাম ধারণ করেছে।