11-08-16-PM_Jongibad Birodhi Fotowa Meeting at KIB-16

সামান্য কয়েকটি লোক ইসলামকে হেয় করতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন,যখনই কেউ ইসলামিক টেররিস্ট বলে, আমি সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ করি। সন্ত্রাসী কোনো ধর্মের হতে পারে না। সামান্য কয়েকটি লোক ইসলামকে হেয় করতে পারে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে আলেমদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ(কেআইবি) মিলনায়তনে বাংলাদেশ জমিয়াতুল উলামা আয়োজিত ‘ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এবং আমাদের করণীয়’ শীর্ষক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে মানবিক, উদার, শান্তি-সৌহার্দ্য ও সহনশীলতার ধর্ম ইসলাম। সবচেয়ে দুঃখ লাগে যখন সামান্য কিছু লোক ধর্মের নাম ব্যবহার করে সন্ত্রাস চালাচ্ছে, মানুষ হত্যা করছে। আমাদের পবিত্র ধর্মকে হেয় করছে। তিনি আরও বলেন, যারা সন্ত্রাস করে, মানুষ হত্যা করে, তারা আদৌ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে কি না, ভেবে দেখা দরকার।সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কর্মকান্ডে জড়িত ব্যক্তিদের নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কোরআন-হাদিস ও ইসলামের পবিত্র বাণী মানবে না, নামাজ না পড়ে মানুষ খুন করতে যায়, তারা কী করে বেহেশতে যাবে? তারা কী করে ভাবে, তারা মানুষ খুন করে বেহেশতে যাবে!

ইসলামের মহান বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে আলেম সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সারা দেশের মানুষের মধ্যে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একটা চেতনা সৃষ্টি হয়েছে। এ চেতনাকে আরও শাণিত করতে হবে। মানুষকে আরও ভালোভাবে বোঝাতে হবে যে জঙ্গিবাদের পথ ইসলামের পথ নয়। কেউ যেন সন্ত্রাসের পথে না যায়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে হবে।বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর দিক প্রত্যেকে প্রত্যেকের ধর্ম পালনে সহযোগিতা করে। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের উৎসবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে থাকে।

কওমী মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষাদানের বিষয় ও পদ্ধতি ঠিক করতে প্রায় চার বছর আগে গঠিত কমিশনের কাজ দ্রুত শেষ করে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এক কারিকুলাম ও সনদের আওতায় আনার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।তিনি বলেন, আমি মনে করি, এর সময়টা আমরা বৃদ্ধি করে দিয়ে, যদি আরও কিছু সদস্য নিতে হয় তাদেরকে নিয়ে, এই কাজটা খুব দ্রুত করা দরকার।আমি খুব তাড়াতাড়ি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব, আমাদের ধর্মমন্ত্রীও এখানে আছেন, আমি বলব এই উদ্যোগটা নিতে।

কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষাদানের বিষয় এবং কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতির লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নে ২০১২ সালের এপ্রিলে ‘বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করা হলেও মাদ্রাসা পরিচালনাকারীদের একটি অংশের বিরোধিতার কারণে সে প্রক্রিয়া থমকে যায়।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় পড়ছে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী। কমিশনের কাজ শেষ না হওয়ায় দেশের আনাচে-কানাচে গজিয়ে ওঠা এসব মাদ্রাসা কার্যত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। শেখ হাসিনা বলেন, কওমী মাদ্রাসার জন্য পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করে তার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের সনদ দিতে ওই কমিশন গঠন করা হলেও পাঁচ বোর্ডে বিভক্ত মাদ্রাসাগুলোর পরিচালকরা একমত হতে পারেননি।আমরা আশা করি, এখন যখন আমাদের ধর্মের ওপর এতবড় আঘাত এসেছে, এই সময় সকলের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।

সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এসব কওমী মাদ্রাসা জঙ্গিবাদের সূতিকারগার হয়ে উঠছে বলে বিভিন্ন সময়ে খবর এসেছে গণমাধ্যমে। গত কয়েক বছরে জঙ্গি হামলা ও হত্যাকান্ডের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে গ্রেপ্তার অনেকেই এসব মাদ্রাসার ছাত্র। সরকার আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করায় কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সেখানে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষা এবং দেশে-বিদেশে চাকরির সুযোগ পাবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারাই একমত হতে চান, তারাই একমত হন। আমরা এটা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে পারি।তাহলে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা এবং এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা সনদ দিতে পারব।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে শেখ হাসিনা বলেন, সনদ দিতে হলে একটা মিনিমাম কারিকুলাম লাগবে। না হলে কীসের ভিত্তিতে শিক্ষা হবে, কীসের ভিত্তিতে সনদটা দেবেন?ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এবং আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এ উলামা সম্মেলনে সবার সহযোগিতা চেয়ে সরকারপ্রধান বলেন, এই সময় এটা খুব দরকার। যাতে কারিকুলামটা প্রণয়ন করে দ্রুত আমরা সনদ দেওয়ার কাজ শুরু করতে পারি।
কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা আয়োজিত এ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান ও শোলাকিয়ার ঈমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদও বক্তব্য দেন।

ধর্মের নামে যারা মানুষ হত্যা করছে, তাদের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, নিরীহ মানুষ, সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। আর হত্যা করলেই নাকি তারা বেহেস্তে চলে যাবে, হুর পাবে। এটা কোন ধরনের কথা! এটা তো ইসলামের শিক্ষা হতে পারে না। কোরআন থেকে উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, কোরআন শরীফই বলে দিচ্ছে তোমরা সন্ত্রাস ও দুযোগ সৃষ্টি করো না। তারা সন্ত্রাস ও দুর্যোগ সৃষ্টি করে কোরআনের বাণীকেই অস্বীকার করছে। কোন ধর্ম তারা পালন করছে?জঙ্গি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সারাদেশে যে জনমত সৃষ্টি হয়েছে, সেই চেতনাকে আরও শানিত’ করার ওপর গুরুত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। এ দায়িত্ব আমরা আমাদের পক্ষ থেকে করে যাচ্ছি। এবং আপনারা যারা ধর্ম শিক্ষা দেন এবং ধর্মের কথা বলেন, আপনাদের আরও ভালভাবে মানুষকে বোঝাতে হবে।

শেখ হাসিনা জানান, কেউ যাতে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিপথে না নিতে পারে সেজন্য প্রতিটি উপজেলা ও জেলায় একটি করে মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আজকে কয়েকটা লোকের জন্য এই পবিত্র ধর্ম হেয় প্রতিপন্ন হবে- এটা কারও কাছে গ্রহণযোগ্য না।

বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করলেও প্রত্যেকে ভিন্ন ধর্মের মানুষকে শ্রদ্ধা করে, বিপদে আপদে রক্ষা করে।এটা হচ্ছে এদেশের মানুষের সব থেকে বড় অর্জন। সম্মেলনে আলেম সমাজের পক্ষ থেকে কওমি মাদ্রাসা সনদ দেওয়ার উদ্যোগ বাস্তবায়নের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সনদ দিতে হলে নূন্যতম একটি কারিকুলাম দরকার। আমরা কওমি মাদ্রাসা কমিশন গঠন করে দিয়েছি। কিন্তু কওমি মাদ্রাসার পাঁচটি বোর্ড একমত হতে পারেনি। সবাই একমত হন অথবা যাঁরা আগ্রহী, তাঁরা একমত হন, আমরা বাস্তবায়ন শুরু করে দেব। সারা দেশে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় ৫৬০টি মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী।সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত খুঁজে বেড়াচ্ছি, কোথাও আইএস খুঁজে পাইনি।

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশ জমিয়াতুল উলামার সভাপতি ও ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসউদ বলেন, ইসলাম উদারতা ও সহনশীলতার ধর্ম। কিছুসংখ্যক মতলববাজ ইসলামকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ইসলামে অনর্থক গাছের পাতাও ছেঁড়া নিষেধ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা মনে করে, মানুষ হত্যা করে বেহেশতে চলে যাবে, তারা আসলে জাহান্নামে যাবে। যারা মানুষ হত্যা করে, আত্মহত্যা করে, তারা উভয়ই জাহান্নামে যাবে।

১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফরিদউদ্দীন মাসউদ বলেন, ‘ইতিহাসে কারবালার ঘটনার পর এত নিষ্ঠুর ও হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই।অনুষ্ঠানে এক লাখের অধিক আলেমের স্বাক্ষরিত ৩০ খন্ডের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে, ইসলামের শান্তির বাণী নিয়ে ফতোয়া প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়। প্রতীকী হিসেবে ১ খন্ড প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন ফরিদউদ্দীন মাসউদ।