মুক্তিযোদ্ধা লেফট্যানেন্ট গাজী মোহাম্মদ রহমত উল্ল্যাহ দাদু (অব.) বীর প্রতীকের জানাজা সম্পন্ন হয়েছে।বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) বাদ জোহর নগরীর শহীদ হাদিস পার্কে মরহুমের নামাজের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে মরহুমকে গার্ড অব অনার প্রদান করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, নৌ বাহিনী ও পুলিশ। জানাজায় মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ নেতা, বিএনপি নেতা, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নৌ বাহিনীর কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অংশ নেন।
জানাজা শেষে গ্রামের বাড়ি পাইকগাছার গড়ইখালীর পারিবারিক কবরস্থানে মৃতদেহ দাফনের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর আগে বুধবার (১০ আগস্ট) রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে রহমত উল্ল্যাহ দাদু খুলনার শেখপাড়াস্থ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় তিনি স্বাধীনতার পতাকা প্রথম খুলনার সার্কিট হাউজে উত্তোলন করেন। লেফট্যানেন্ট গাজী মোহাম্মদ রহমাতুল্ল্যাহ দাদু ১৯৩৭ সালের ১১ নভেম্বর পাইকগাছার গড়ইখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তান নৌ-বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৬৫ ও ১৯৬৭ সালে তিনি পাক-ভারত যুদ্ধে অংশ নেন। পাকিস্তান নৌ-বাহিনীতে থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৭১ সালে প্রথম বাংলাদেশের গণহত্যায় উদ্বিগ্ন হয়ে যে ক’জন বাঙালি নাবিক ফ্রান্সে অবস্থান করেন তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট প্রথম নৌ-কমান্ডো অপারেশন চালনা (বর্তমান মংলা), চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, দাউদকান্দিতে প্রথম আঘাত হানেন। যে অপারেশন চলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। স্বাধীনতার যুদ্ধে তার নেতৃত্বে নৌ-কমান্ডো সফলতার কারণে ৭৫ ভাগ অগ্রসারিত হয়। তারা ১৩২টি জাহাজ ধ্বংস করার কারণে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নৌ-পথ এবং সামুদ্রিক পথে সব কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত হয়েছিল। গেরিলা যুদ্ধে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট অঞ্চলে, তার আনুমানিক চার হাজারের বেশি যোদ্ধা ছিল। তিনি কপিলমুনি, গড়ইখালি, নীল কমল, চালনা, লক্ষীখোলা, পাইকগাছা, চাপড়া, আশাশুনি, শিয়ালডাঙ্গা, কপিলমুনি ও খুলনায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১৭ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় স্বাধীনতার পতাকা প্রথম খুলনার সার্কিট হাউজে তিনিই উত্তোলন করেন। স্বাধীনতাত্তোর ১৯৭১ সালে ২৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার সম্মেলনে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর এবং ১০নম্বর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন। তারই নেতৃত্বে নৌ-বাহিনীর গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। নৌ-বাহিনীর সমস্ত কার্যক্রম তার দ্বারাই পরিচালিত হয়। পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত নৌ-বাহিনীর অফিসার ও নাবিকদের বাংলাদেশে অবস্থানের সকল ব্যবস্থা তিনিই করেন। তিনি নৌ-বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কাজ করেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের দিন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি ঢাকা বিমান বন্দরে নৌ-কন্টিজেন্টের গার্ড অব অনার প্রদান করেন। তিনি ইংল্যান্ড থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে চাকরি ছাড়ার পর বাংলাদেশের শিল্প জগতে তিনি বেশ অবদান রাখেন। বরিশাল টেক্সটাইল মিল, রাজশাহী টেক্সটাইল মিল, সুন্দরবন টেক্সটাইল মিল, কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিল, সিলেট টেক্সটাইল মিল, নোয়াখালি টেক্সটাইল মিল, মাদারীপুর টেক্সটাইল মিল, মাগুরা টেক্সটাইল মিল তার দ্বারা স্থাপন হয়েছিল। ১৯৮৭ সালে তিনি টেক্সটাইল মিল থেকে চাকরি ছাড়ার পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বেশ অবদান রাখেন। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম আধা নিবিড় বাগদা চাষ শুরু করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশে বাগদার পোনা হ্যাচারি স্থাপন করেন। খুলনা বিভাগীয় চিংড়ি চাষী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। এছাড়া তিনি খুলনা বিভাগীয় সেক্টর ফোরামের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন।
তার প্রচেষ্টায় নৌ-বাহিনীর সমস্ত স্থাপনায় মসজিদ, স্কুল, কলেজ, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও বরিশাল, রাজশাহীতে স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাইকগাছা উপজেলার গড়ইখালি ডিগ্রি কলেজ মসজিদ, মন্দির, স্কুল ও বহু রাস্তাঘাট তার অবদানে হয়। তার গোটা পরিবারই মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবে পরিচিত। তারা ১০ ভাইয়ের মধ্যে সাতজনই মুক্তিযোদ্ধা। এর মধ্যে একজন শহীদ অন্যরা যুদ্ধাহত অবস্থায় পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জল অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত হন।