কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গিদের ছবি প্রকাশতথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ। যোগাযোগের বেশিরভাগই চলছে অনলাইনে। ব্যবহার করছে সুরক্ষিত বিভিন্ন অ্যাপ। যেন কোনও তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানতে না পারে। সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে বসবাস করতে হয় বিভিন্ন এলাকার মেসে। তাও আবার এক মেস বাসায় বেশিদিন নয়। নির্দিষ্ট সময় পর বদল হয়ে যায় মেস-বাসা। মাঝেমধ্যে চলে প্রশিক্ষণও। সেসব আয়োজন করা হয় উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা, বগুড়া ও জামালপুরের বিভিন্ন চরাঞ্চলে। ছদ্ম পরিচয়ে থাকা প্রায় সবাই নানা কাজে যুক্ত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে চলতে থাকে সাংগঠনিক কার্যক্রম। শুক্রবার র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া শোলাকিয়ার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া জঙ্গি সদস্য শফিউল ও কল্যাণপুরের আস্তানা থেকে গ্রেফতার হওয়া রাকিবুল হাসান রিগ্যানের কাছ থেকে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে এসব তথ্য জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। একই রকম তথ্য দিয়েছে এর আগে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গি সদস্যরাও।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গিরা অনলাইনের মাধ্যমে তাদের নেটওয়ার্ক সচল রাখছে। তারা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কিছু অ্যাপ ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, জঙ্গিরা ব্যবহার করছে এমন কিছু অ্যাপ চিহ্নিত করে আমরা ওই সবের ডাউনলোড বন্ধের জন্য বিটিআরসিকে সুপারিশ করেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নব্য জেএমবির সদস্যদের বেশিরভাগই তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ। এই দলের বেশিরভাগ সদস্যরা উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। দলে যারা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসে যুক্ত হয় বা পড়াশোনা কম, তাদেরও পর্যায়ক্রমে প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তোলে তারা। সদস্যদের প্রথম কাজই হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়ার সব কৌশল রপ্ত করা। এ কারণে নব্য-জেএমবির সদস্যদের মধ্যে অনেককে গ্রেফতার করতে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।

ঢাকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটি) একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নব্য জেএমবির মাস্টারমাইন্ডরা প্রযুক্তিতে দক্ষ-উচ্চশিক্ষিত। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কৌশলগুলো তাদের ভালো করে জানা। তারাই মূলত দলের সদস্যদের প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তোলে। যদিও প্রতিটি ক্ষেত্রেই মাস্টারমাইন্ডরা নিজেদের পুরো পরিচয় গোপন রাখে। তৈরি করে দেয় স্লিপার সেল। যোগাযোগ চলে কাট-আউট পদ্ধতিতে। একটি স্লিপার সেলের শীর্ষ পর্যায়ের একজন-দুজনের সঙ্গে অন্য স্লিপার সেলের সঙ্গে যোগাযোগ চলে। তারাই মূলত যোগাযোগ করে মাস্টারমাইন্ডদের সঙ্গে। আস্তানায় যাওয়ার পর পরিচয় হয় ‘বড় ভাই’য়ের সঙ্গে। কারও ব্যক্তিগত তথ্য জানতে চাওয়া সাংগঠনিকভাবে নিষেধ। তাই একে অন্যের ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে চায় না। শুধু সাংগঠনিক নামেই একে অন্যকে সম্বোধন করে।

সিটির কর্মকর্তারা বলছেন, গুলশান হামলা থেকে শুরু করে শোলাকিয়া হামলা ও পরবর্তী সময়ে কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে যারা নিহত হয়েছে, তাদের এক জনের সঙ্গে আরেকজনের পরিচয় ছিল না। তারা স্লিাপার সেলে ভাগ হয়ে থাকত। কিন্তু অপারেশনের আগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে একসঙ্গে। গুলশান হামলাকারীরা বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই অবস্থান করছিল ঝিনাইদহের একটি মেসে। আর শোলাকিয়ার হামলাকারীরা গাইবান্ধায়। কিন্তু ঘটনার আগে দুই দলই এসে সাক্ষাৎ করে সিরাজগঞ্জে। সেখান থেকে তাদের নেওয়া হয় বগুড়ার একটি চরাঞ্চলের ট্রেনিং সেন্টারে। সেখান থেকে আবার আলাদা হয়ে যায় তারা। দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গুলশান হামলাকারীরা এসে অবস্থান নেয় বসুন্ধরার আবাসিক এলাকার জঙ্গি আস্তানায়। আর শোলাকিয়ার দলটি অবস্থান নেয় মিরপুরের শেওড়াপাড়ায়। গুলশানের হামলার আগেই শেওড়াপাড়ার দলটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায়।

সিটি সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকাসহ এর আশেপাশের উপশহর ও বিভিন্ন জেলা শহরে বিভিন্ন ছদ্মনামে জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা গড়ে উঠেছে। কল্যাণপুরের পুলিশি অভিযানে নিহত জঙ্গিরাসহ গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলায় অংশ নেওয়া সদস্যরা এক বাসা থেকে আরেক বাসায় অবস্থান পরিবর্তন করে ঘন-ঘন। কয়েক মাস আগে মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও বাড্ডার সাঁতারকুলে পৃথক তিনটি আস্তানায় পুলিশি অভিযান চালানোর কারণে তারা সতর্ক হয়ে যায়। এক বাসায় বেশিদিন অবস্থান করছিল না তারা।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতেই জঙ্গিদের একাধিক আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে। অভিযান চালিয়ে তারা জানতে পারেন জঙ্গিরা অবস্থান করছিল ঠিকই, কিন্তু হুট করে একদিন কাউকে না বলেই চলে যায়। অবস্থান করে অন্য আস্তানায়। সিটির কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গিদের পুরো নেটওয়ার্ক চলছে অনলাইনে। আগে জঙ্গিরা মোবাইল ফোনে সাধারণভাবে যোগাযোগ করলেও এখন তা করছে না। অ্যাপের বাইরে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে হলেও কোড ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করা হয়। এ কারণে সাধারণভাবে ট্র্যাকিং করেও তাদের অবস্থান শনাক্ত করা যায় না।