মানবতা বিরোধী অপরাধে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামী জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর সঙ্গে শনিবার দুপুরে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এ তার এক ছেলে ও এক আইনজীবী সাক্ষাৎ করেছেন।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পাট-২ এর জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক জানান, মানবতা বিরোধী অপরাধে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামী জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী গাজীপুরস্থিত কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর কনডেম সেলে বন্ধি রয়েছেন। তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে তার ছেলে মীর আহমেদ বিন কাসেম ও আইনজীবী সাঈদ মো. রায়হান উদ্দিন শনিবার কারাগারে আসেন এবং অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। পরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে বেলা ১২ টায় মীর কাসেম আলীর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা করা হয়। কারাগারের একটি কক্ষে তারা মীর কাসেম আলীর সঙ্গে দুপুর ১২ টা থেকে ১২টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত সাক্ষাৎ করেন এবং কথাবার্তা বলেন। এসময় তারা মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলেন। গত ২৬ জুলাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে এ কারাগারে স্থানান্তার করা হয়।
উল্লেখ্য, গত ১৯ জুন ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন মীর কাসেম আলী। ২৫ জুলাই উচ্চ আদালত রায় পুনর্বিবেচনার বা রিভিউ আবেদনের শুনানি এক মাস পিছিয়ে ২৪ আগস্ট পুনর্র্নিধারণ করেন। মীর কাসেমের পক্ষে আইনজীবীর দুই মাসের সময়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ দিন ধার্য করেন।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলের নয়া দিগন্ত কার্যালয় হতে মীর কাসেম আলীকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি ২০১৪ সালের আগে হাজতবাসকালে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দির মর্যাদায় ছিলেন। পরে দন্ডপ্রাপ্তির পর তাকে ফাঁসির (কনডেম) সেলে পাঠানো হয়।
২০১২ সালে গ্রেফতারের পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে তার যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়। ২০১৪ সালের ২ নবেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের রায় দেয়। একই বছরের ৩০ নবেম্বর ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদন্ডের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন এই আলবদর কমান্ডার। চলতি বছরের (২০১৬) ৮ মার্চ দেওয়া রায়ে আপিল বিভাগও তার মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে। গত ১৯ জুন ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন মীর কাসেম আলী। রিভিউ পিটিশনের রায়ের উপরই নির্ভর করছে দন্ড প্রক্রিয়ার পরবর্তী কার্যক্রম।
প্রসঙ্গত, ১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মীর কাসেম আলীর জন্ম মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামে। ডাকনাম পিয়ারু ওরফে মিন্টু। বাবার চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামে থাকতেন ছোটবেলায়। সেখানে জড়িত হন ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতিতে। ১৯৭১ সালের ৭ নবেম্বর পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। ১৯৭৭ সালে নাম বদল করে তার নেতৃত্বে ইসলামী ছাত্রশিবির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এ সংগঠনটি। তিনি হন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরবর্তীতে যোগ দেন জামায়াতে ইসলামীতে। একাত্তরে চট্টগ্রামে অবস্থানের সময় ঘাতক আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প ও টর্চার সেল স্থাপন করেন ডালিম হোটেল নামে পরিচিত স্থানীয় মহামায়া হোটেলে। সেখানে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে স্বাধীনতার বহু সমর্থককে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ডালিম হোটেল চট্রগ্রামবাসীর কাছে হত্যাপুরী হিসেবে পরিচিতি পায়। নৃশংসতার জন্য মীর কাশেমের পরিচয় হয় ‘বাঙালি খান’। ছাত্রসংঘের বাছাই করা কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর তিনি ছিলেন তৃতীয় কমান্ডার।
এই গুপ্ত ঘাতক বাহিনীতে নেতৃত্ব ও প্রভাব বিবেচনায় ছিল জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পর জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা এবং একই সাথে আলবদর বাহিনীর তৃতীয় প্রধান নেতা। আর বিশেষভাবে তিনি ছিলেন চট্রগ্রাম অঞ্চলে এই বাহিনীর প্রধান। স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামীকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করতে কাজ করেন তিনি। ১৯৮০ সালে তিনি মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক এনজিও রাবেতা আল আলম আল ইসলামীর এ-দেশীয় পরিচালক হন। তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শুরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন।
ইবনে সিনা ট্রাস্টসহ বহু আর্থিক, বাণিজ্যিক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা পরিচালক মীর কাসেম আলী দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান। বিগত তিন দশকে তিনি জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অর্থের অন্যতম জোগানদাতায় পরিণত হন। অর্থাৎ তার যোগানো অর্থেই জামায়াতে ইসলামী শক্ত ভিত্তি পায়। যার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায়েও সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্ত এসেছে।
মোস্তাফিজুর রহমান টিটু, স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর।