মাগুরার বৃদ্ধ শিশু বায়েজিদ এখন ঢাকা মেডিকেলে

মাত্র চার বছরের বয়সে বার্ধক্যে নুয়ে পড়া মাগুরার শিশু বায়েজিদ সিকদারকে ভর্তি করা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। আজ শনিবার (০৬ আগস্ট) সকাল ৯টার দিকে তাকে ঢামেকের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়।

বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান, প্রফেসর ডা. আবুল কালাম বিষয়টি নিশ্চত করে জানিয়েছেন, ভর্তির পরপরই তার শরীরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, শিশু বায়েজদের শারীরিক গঠন দেখে অনেকে ধারণা করবে তার বয়স অনেক বেশি। কিন্তু তার বয়স মাত্র চার বছর। এরইমধ্যে সে বৃদ্ধ শিশু হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আমরা চেষ্টা করবো দ্রুত একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তার শারীরিক সমস্যা নির্ণয়ের। এরপর জানবো তার প্রকৃত রোগটি কি।

মায়া জড়ানো হাসিমাখা মুখ বায়েজিদের। তবে কেউ দেখলে চমকে উঠবে। কারণ, চার বছরের এই শিশু দেখতে বৃদ্ধের মতো। মুখ, চোখ, পেটসহ শরীরের চামড়া বয়স্ক ব্যক্তিদের মতো ঝুলে পড়েছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, তার শারীরিক এই দুরবস্থার কারণ বিরল রোগ প্রোজেরিয়া।বায়েজিদের দাদা হাসেম আলী শিকদার বলেন, জন্মের পর বায়েজিদের চেহারা ভয়ংকর দেখাত। ভয়ে কেউ বাড়িতে আসতে চাইত না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ মানুষের চেহারা ও ভাব ফুটে ওঠে।ভয়ংকর চেহারা নিয়ে পৃথিবীতে এলেও মায়ের যতেœ বড় হতে থাকে বায়েজিদ। তবে ওর বৃদ্ধি আর ১০টা স্বাভাবিক শিশুর মতো ছিল না।মা তৃপ্তি খাতুন বলেন, শিশুরা সাধারণত ১০ মাসের মধ্যে হাঁটা শেখে। কিন্তু বায়েজিদের হাঁটা শিখতে লেগেছিল সাড়ে তিন বছর। আট মাস বয়স পর্যন্ত ও হামাগুড়ি দিতেও পারত না। অথচ তিন মাসের মধ্যেই ওর সব দাঁত ওঠে। মনি (মায়ের আদরের ডাক) স্বাভাবিক চলাফেলা, খাওয়াদাওয়া, বায়না, এমনকি খেলাধুলা সবই করে। কিছু প্রয়োজন হলে চায়।

বাবা লাভলু শিকদার জানালেন নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী চিকিৎসা করেছেন ছেলের। ২০১২ সালের ১৪ মে মাগুরা মাতৃসদন হাসপাতালে বায়েজিদের জন্ম হয়। জন্মের পর থেকে অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। এ পর্যন্ত ছেলের চিকিৎসার পেছনে তিন-চার লাখ টাকা খরচ করেছি। আমি ক্ষুদ্র ব্যবসা আর চাষাবাদ করি। তাই আর পারছি না। কিন্তু ছেলের মুখে দিকে তাকালে খুব কষ্ট হয়।মাগুরা সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রোগটিকে হাতিনসন গিলফোর্ড প্রোজেরিয়া সিনড্রোম’ বা কমনালি প্রোজেরিয়া’ বলা হয়। এটি বিরল জেনেটিক অসংগতি। এক কোটি শিশুর মধ্যে একজনের ওই রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত ১০০টির মতো রোগী শনাক্ত হয়েছে। বৃদ্ধি ও চোখের আলো স্বাভাবিক থাকলেও ওই রোগে আক্রান্ত শিশু বুড়ো মানুষের মতো চামড়া কুঁচকানো হয়। মাথায় চুল কম হয় বা থাকে না। দুঃখজনক হলো, এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা ১৩-১৪ বছর বয়সের বেশি জীবিত থাকে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তনালিতে চর্বি জমে। পরে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকে মারা যায়।

মাগুরা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল শিশুটির। ওই হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ জয়ন্ত কুমার কুন্ড বলেন, রোগটি বিরল। রোগের কোনো প্রতিষেধক বা চিকিৎসাও নেই। জানতে পেরে আমরা তার চিকিৎসা এবং পরামর্শের জন্য পাঁচ সদস্যের মেডিকেল টিম গঠন করি। এই টিম উন্নত চিকিৎসার জন্য বায়েজিদকে ঢাকায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।মাগুরার মহাম্মদপুর উপজেলার খালিয়া গ্রামের লাভলু সিকদারের ছেলে বায়েজিদের জন্ম ২০১২ সালের ১৪ই মে। সে হিশেবে তার বয়স চার বছরের কিছু বেশি। কিন্তু বায়জিদ সিকদারের দিকে তাকালে চমকে উঠবেন যে কেউ। তার চার বছরের ছোট্ট দেহটার ওপর কেউ যেন বসিয়ে দিয়েছে আশি বছরের বৃদ্ধের মুখ। চাহনি, অঙ্গভঙ্গিও অনেকটা বৃদ্ধ মানুষের মতো। শরীর এর মধ্যেই কুঁজো হয়ে গেছে। ঝুলে পড়েছে শরীরের চামড়া।ডাক্তারদের ধারণা, অত্যন্ত বিরল এবং জটিল কোনো জেনেটিক রোগে আক্রান্ত বায়জিদ। এ ধরনের বিরল ‘জেনেটিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত আরও একশ’র বেশি শিশু আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ডাক্তারি ভাষায় এর নাম ‘প্রোজেরিয়া’ বা ‘হাচিনসন-গিলফোর্ড প্রোজেরিয়া সিনড্রোম’। মূলত এই রোগে আক্রান্তরা দ্রুত বুড়িয়ে যেতে থাকে, স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ছয়গুন দ্রুত হারে। বায়জিদ শিকদার ঠিক প্রোজেরিয়াতেই আক্রান্ত কি না, সেটা এখনো নিশ্চিত করেননি চিকিৎসকরা। তবে বায়জিদের সমস্ত লক্ষণই মিলে যায় প্রোজেরিয়ার যে লক্ষণ তার সঙ্গে। বায়েজিদের অস্বাভাবিক শারীরিক গঠন সম্পর্কে জানাজানি হওয়ার পর বিভিন্ন জনের পরামর্শে কয়েকদিন আগে তাকে মাগুরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন তার বাবা মা। পরে সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে ঢামেকে স্থানান্তর করেন।