পঁচিশে বৈশাখ এবং বাইশে শ্রাবণ- বাঙ্গালীর বাংলা ক্যালেন্ডারের দু’টো মুখস্ত করা দিন। একটি দিন জন্মের আর একটি মৃত্যুর। আর এ দু’টোদিন মানেই রবীন্দ্রনাথ। এর একটি শনিবার -বাইশে শ্রাবণ।এবার তাঁর ৭৫ তম প্রয়াণতিথি।মহাকালের চেনা পথ ধরে প্রতিবছর বাইশে শ্রাবণ আসে। এই বাইশে শ্রাবণ বিশ্বব্যাপী রবি ভক্তদের কাছে একটি শূণ্য হবার দিন। রবীন্দ্র কাব্য সাহিত্যের বিশাল একটি অংশে যে পরমার্থের সন্ধান করেছিলেন সেই পরমার্থের সাথে তিনি লীন হয়েছিলেন এদিন।রবীন্দ্র কাব্যে মৃত্যু এসেছে বিভিন্ন ভাবে। জীবদ্দশায় মৃত্যুকে তিনি জয় করেছেন বারবার। মৃত্যু বন্ধনা করেছেন তিনি Ñমরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান। মেঘবরণ তুঝ, মেঘ জটাজুট! রক্ত কমলকর, রক্ত-অধরপুট, তাপ বিমোচন করুণ কোর তব মৃত্যু-অমৃত করে দান
রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিজীবনে মৃত্যুকে বড় গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে স্ত্রী বিয়োগ এর মধ্য দিয়ে। কবি যখন দূরে থাকতেন স্ত্রী মৃণালিণী দেবীকে ‘ভাই ছুটি’ সম্বোধন করে চিঠি লিখতেন। কবির সেই ‘ছুটি’ যখন সংসার জীবন থেকে সত্যিই একদিন ছুটি নিয়ে চলে গেলেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ঊনতিরিশ।কিশোর বয়সে বন্ধুপ্রতিম বৌদি কাদম্বরী দেবীর অকালমৃত্যু ও আরও পরে স্ত্রীর মৃত্যু এবং একে একে প্রিয়জনদের মৃত্যুর নীরব সাক্ষী ও মৃত্যুশোক রবীন্দ্রনাথের এক অনন্য অভিজ্ঞতা লাভে সহায়ক হয়েছিল।কবি জীবনস্মৃতিতে মৃত্যুশোক পর্যায়ে অকপটে লেখেন, জগৎকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে দূরত্ব প্রয়োজন, মৃত্যু সেই দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার উপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম, তাহা বডডো মনোহর।
জীবনের শেষ নববর্ষে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর সাধের শান্তিনিকেতনে। সে দিন তাঁর কলমে রচিত হয়েছিল সভ্যতার সংকট নামের অমূল্য লেখাটি। তারও ক’দিন পর ১৯৪১ সালেরই ১৩ মে লিখে রাখলেন, রোগশয্যায় শুয়েই আমারই জন্মদিন মাঝে আমি হারা।শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের শেষ দিনগুলোতে কখনও তিনি শয্যাশায়ী, কখনও মন্দের ভাল। শেষের দিকে ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই, শান্তিনিকেতনের আশ্রম বালক বালিকাদের ভোরের সঙ্গীত অর্ঘ তিনি গ্রহণ করেন তাঁর উদয়ন গৃহের পূবের জানলার কাছে বসে। উদয়নের প্রবেশদ্বার থেকে ছেলেমেয়েরা গেয়ে উঠেন কবিরই লেখা এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার ,আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার।
রবীন্দ্র জীবনী থেকে জানা যায়, মৃত্যুর মাত্র সাত দিন আগে পর্যন্তও কবি সৃষ্টিশীল ছিলেন। জোড়াসাঁকো রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে তিনি বলতেন রানী চন্দ তা কবিতার ছন্দে লিখে নিতেন । কবি বলে গেছেন, ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পরেছিলেন কবিতাটি বলতে বলতে। দিনটা ছিল কবির শেষ বিদায়ের কয়েক দিন আগে ১৪ শ্রাবণ। রানী চন্দ সে দিন সূত্রধরের মতো লিখেও নেন রবীন্দ্রনাথ উবাচ কবিতাটি তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি ।
রবীন্দ্রনাথের মুত্যুর বর্ননা পাওয়া গেছে এভাবে – আগস্টের প্রথম দিন দুপুরবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথের হিক্কা শুরু হয়। আগস্টের ৩ তারিখ থেকে কিডনিও নিঃসাড় হয়ে পরে। ৬ আগস্ট রাখি পূর্ণিমার দিন কবিকে পূর্বদিকে মাথা কওে শোয়ানো হল। পরদিন ২২শে শ্রাবণ, ৭ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের কানের কাছে মন্ত্র জপ করা হয় ব্রাহ্ম মন্ত্র ‘শান্তম, শিবম, অদ্বৈতম..’ ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়…..।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন মৃত্যু পথযাত্রী। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ঘড়িতে তখন ২২শে শ্রাবণের বেলা ১২টা বেজে ১০ মিনিট। কবি চলে গেলেন অমৃত আলোকের নতুন দেশে।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠকুরের ৭৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমী দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। শনিবার বিকেল ৪ টায় একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে আহমদ রফিক রচিত রবীন্দ্রজীবন (তৃতীয় খন্ড)-এর প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ প্রদান করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান।দ্বিতীয় দিন রবিবার বিকেল ৪ টায় একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে একক বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং রবীন্দ্রপুরস্কার-২০১৬ প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। রবীন্দ্রবিষয়ক একক বক্তৃতা প্রদান করবেন বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী অধ্যাপক রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।এ বছর রবীন্দ্রপুরস্কার প্রদান করা হবে অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন এবং শিল্পী তপন মাহমুদকে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এ উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহন করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার বিশেষ অনুষ্ঠানমালা ও নাটক প্রচার করবে। বিশ্ব কবির প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশনও শনিবার বিশেষ নাটক এবং অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে।