বাংলাদেশে ‘একনিষ্ঠ যোদ্ধা’ পাঠিয়েছে আইএস!

বিশ্বজুড়ে বেড়েই চলেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠন আইএসের বিস্তার। গতকাল বুধবারই এক প্রতিবেদনে এনবিসি নিউজ জানিয়েছে, এই মুহূর্তে বিশ্বের ১৮টি দেশে চলছে তাদের কার্যক্রম। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নামও। আজ বৃহস্পতিবার নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ‘একনিষ্ঠ যোদ্ধা’ও পাঠিয়েছে আইএস। এদের মাধ্যমে ঘাঁটি শক্ত করার পরিকল্পনা করছে সংগঠনটি।

বাংলাদেশে যারা আল-কায়েদার সঙ্গে জড়িত, তাদের দলে টানতে ইসলামিক স্টেট বেশি আগ্রহী বলেও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জার্মানির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শহর ব্রেমেন থেকে সিরিয়ায় সশস্ত্র জিহাদে যোগ দিতে যাওয়া তরুণ হ্যারি সারফোর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সিরিয়ায় যুদ্ধে যাওয়া সম্পর্কে হ্যারির প্রাথমিক ভাবনা এমন ছিল যে, তিনি কোনো পবিত্র ডাকে সাঁড়া দিতেই সেখানে যাচ্ছেন বলে বিশ্বাস করতেন। তবে সিরিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাসের আগেই ইসলামিক স্টেটের (আইএস) গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা মুখোশ পরে এসে হ্যারি এবং তাঁর অন্য জার্মান বন্ধুদের জানালেন, ইউরোপীয়দের আর সিরিয়ায় জিহাদের জন্য আসার প্রয়োজন নেই। তাদের এখন দেশে ফিরে যাওয়া উচিত। তারপর সেখান থেকেই সারা বিশ্বে আইএসের সন্ত্রাসবাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা উচিত।

নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হ্যারি সারফো বলেন, আইএসের গোয়েন্দা সংস্থার ওই সদস্য প্রকাশ্যে তাঁদের জানান যে, ইউরোপীয় দেশগুলোতে এখন অসংখ্য মানুষ রয়েছে যারা ইউরোপের জনগণের ওপর হামলা চালানোর জন্য স্রেফ নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে। প্যারিস ও ব্রাসেলস হামলার আগেই এই তথ্য জানান তিনি। গত সোমবার ব্রেমেনের কাছের একটি কারাগারে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে এই সাক্ষাৎকার নেয় নিউইয়র্ক টাইমস। মুখোশধারী ওই আইএস সদস্য ব্যাখ্যা করে বোঝান যে, কিছু ইউরোপীয় দেশে আইএসের শক্ত ঘাঁটি তৈরি হলেও বিশেষভাবে জার্মানি ও ব্রিটেনে আরো বেশি হামলা হওয়া প্রয়োজন। ওই সদস্য হ্যারিদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা কি জার্মানিতে ফিরে যেতে বললে কিছু মনে করবেন? কারণ এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

হ্যারি বলেন, আইএসের সদস্যরা সবসময় এটাই চাইতেন যে একযোগে যেন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটানো যায়। জার্মানি ও ইংল্যান্ডে যেন একই সময়ে কয়েকটি হামলা চালানো হয় এটাই ছিল তাঁদের চাওয়া। হ্যারি সাফরোর ভাষ্যমতে, সিরিয়ায় আইএসের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ নেতা, মুখপাত্র ও প্রচারণা প্রধান হলেন আবু মুহাম্মাদ আল আদনানি। তাঁর পরই রয়েছে লেফটেন্যান্ট পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি স্তর। যারাই মূলত বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে হামলাগুলোর পরিকল্পনা করে। এদের মধ্যে আবার অঞ্চলভিত্তিক ভাগ রয়েছে। আর এগুলো হলো – ‘সিক্রেট সার্ভিস ফর ইউরোপীয়ান অ্যাফেয়ার্স’, ‘সিক্রেট সার্ভিস ফর এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স’ এবং ‘সিক্রেট সার্ভিস ফর আরব অ্যাফেয়ার্স’।

ইসলামিক স্টেটের ভেতরের বহিঃকার্যক্রম শাখা

পশ্চিমা বিশ্বের ওপর চালানো অন্তত ১০টি হামলা পরিচালনা করেছে ইসলামিক স্টেটের একটি বিশেষ শাখা। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে হামলা চালানোর আগেই এই শাখার অন্তত ৩০ জন সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। ইসলামিক স্টেটের ভেতরে একটি গোয়েন্দা দল রয়েছে। যাদের আরবিতে ‘ইমনি’ নামে ডাকা হয়। এই ইমনি গঠিত হয় আইএসের অভ্যন্তরীণ পুলিশ বাহিনী এবং বহিঃকার্যক্রম শাখার সদস্যদের দিয়ে। এই গোয়েন্দা দলটি মূলত কাজ করে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে। নিউইয়র্ক টাইমসের হাতে আসা ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ার গোয়েন্দাদের অসংখ্য প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

ইমনি ইসলামিক স্টেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য ও সাক্ষাৎকার থেকে দেখা গেছে যে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আইএসের নিয়োগ এবং কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকে ইমনি। নতুন আসা সদস্য থেকে শুরু করে পরিণত যোদ্ধা, সাধারণ যোদ্ধা থেকে কমান্ডো বাহিনী। কে কোথায় যাবে বা কোথায় কাজ করবে তা ঠিক করে ইমনি। যদিও মূল সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন আবু মুহাম্মাদ আল আদনানি। হ্যারি সাফরো জানিয়েছেন, প্রতি মাসের নিয়মিত বৈঠকে আল আদনানই ঠিক করেন যে, কোন ভিডিওচিত্রটি প্রকাশ করা হবে।

আইএসের সন্ত্রাসবাদের পরিকল্পনায় ইমনি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইমনি থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরাই প্যারিস হামলা চালিয়েছিল। এমনকি ব্রাসেলসে হামলার জন্য স্যুটকেস বোমাও তারাই তৈরি করেছিল। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, স্পেন, লেবানন, তিউনিশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়াতে একনিষ্ঠ যোদ্ধা পাঠিয়েছে আইএস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে শতাধিক সদস্য পাঠিয়েছে আইএস। এ ছাড়া শুধু তুরস্কেই পাঠানো হয়েছে শতাধিক সদস্য। একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন জার্মানির কারাগারে বন্দি থাকা হ্যারি সারফো।

সদস্য নিয়োগ প্রক্রিয়া

ইসলামিক স্টেটে যোগ দিতে আগ্রহীরা তুরস্কের সীমান্ত হয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করেন। সেখানেই সাক্ষাৎকার শেষে তাঁদের নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। নিজের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে হ্যারি সারফো জানান, প্রথমে তাঁর আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। এরপর আসেন একজন চিকিৎসক যিনি তাঁর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন এবং তাঁর শারীরিক পরীক্ষা করেন। এসময় কিছু প্রাথমিক প্রশ্ন করা হয়। যেমন : ‘আপনার নাম কী?’, ‘আপনার মা কে?’, ‘আপনার মায়ের নিজের দেশ কোথায়?’, ‘আপনি কোন বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন’, ‘আপনি কোন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন’, ‘আপনার জীবনের লক্ষ্য কী?’, ‘আপনি জীবনে কী হতে চান?’ ইত্যাদি।

হ্যারি ব্রেমেনের যে মসজিদে নামাজ পড়তেন, সেখান থেকে অন্তত ২০ জন সিরিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন। যাদের মধ্যে চারজন যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। হ্যারি জানিয়েছেন, কারো যদি অতীতে কোনো অপরাধের রেকর্ড থাকে, তাহলে তিনি ইসলামিক স্টেটের জন্য মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হন। এ কারণেই আইএসে যোগ দিতে আসা ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত অতীত ইতিহাস খতিয়ে দেখা হয়।

সিরিয়ায় যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই হ্যারিকে আবার জার্মানিতে ফিরে যেতে বলা হয়। যেন তিনি জার্মানিতে থেকেই আইএসের হয়ে কাজ করতে পারেন। সেসময় অর্থাৎ ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে আইএসের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে কথোপকোথন থেকে হ্যারি জানতে পারেন যে, ফ্রান্সে আইএসের হয়ে কাজ করতে আগ্রহী বহু মানুষ রয়েছেন। ফ্রান্স নিয়ে চিন্তা না করতেও পরামর্শ দেন ওই সদস্য। এই কথোপকথনের ঠিক সাত মাস পরে গত নভেম্বরে প্যারিসের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়বহতম হামলা চালায় আইএস।

ইসলামিক স্টেটের ভেতরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখে ইমনি। ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া এবং বেলজিয়ামের গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ইসলামির স্টেটের মূল ঘাঁটির বাইরে অন্তত ২৮ জন সদস্যকে নিয়োগ করেছে ইমনি। যারা বেশ কিছু সফল আক্রমণ করতে সক্ষম হয়েছে। ইমনির সঙ্গে কথোপকোথনের পর হ্যারি সারফো অনুধাবন করেন যে, তারা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের একটি তালিকা তৈরি করছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে সেখানে যেখানে শূন্যস্থান আছে সেগুলো পূরণের চেষ্টা করছে তারা।

হ্যারি সারফো আরো জানান যে, তাঁকে বাংলাদেশে আইএসের পরিকাঠামো তৈরির বিষয়ে বলা হয়েছিল। গত মাসেই বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের বন্দুকধারীদের হাতে ২০ জিম্মি নিহত হয়। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন বিদেশি।

এশিয়া অঞ্চলে সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে আইএস এমন জিহাদী খুঁজছিল যারা ওই অঞ্চলে আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক থেকে উঠে এসেছেন। হ্যারি বলেন, ‘বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে যারা আইএসে যোগ দিতে আসে, তাদের প্রশ্ন করা হয় যে তারা আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক আছে কি না। সেখানে কাজ করার অভিজ্ঞতাও জানতে চাওয়া হয় তাদের কাছে।’

নিজের জবানবন্দি এবং নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হ্যারি ব্যাখ্যা করেছেন যে, ইউরোপে এখনো গোপনে ইমনির কার্যক্রম চলছে। এসব কার্যক্রমের জন্য পরিচ্ছন্ন ইমেজের ব্যক্তিদের ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। ইমনি প্রধানত সেসব মুসলিমকে নিশানা হিসেবে ঠিক করে যারা নব্য মুসলমান হয়েছেন। এসব ব্যক্তিদের সঙ্গে ধীরে ধীরে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। এরপর তাদের আইএসের বার্তা দেওয়া হয়।

হ্যারির দেওয়া তথ্যের সঙ্গে নিজেদের তথ্যের মিল পেয়েছেন গোয়েন্দারা। সেখানেও বলা হয়েছে, এখন বিভিন্ন দেশ থেকে সিরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। বরং নিজ নিজ দেশে থেকে আইএসের কার্যক্রম চালাতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। তবে উত্তর আমেরিকায় এখনো সদস্য পাঠাতে সফল হয়নি বলেও তথ্য দেন হ্যারি। কারণ একবার সিরিয়ায় ভ্রমণ করে আসা মার্কিন নাগরিকদের আবারো নিজ দেশের সীমানায় প্রবেশ করানোটা ভীষণ কঠিন। সেই কারণেই বহু মার্কিন নাগরিক আইএসের সদস্য হলেও নিজ দেশে প্রবেশ করে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যক্রম চালাতে পারেনি।