কুড়িগ্রাম,সিরাজগঞ্জ,শরীয়তপুর,গাইবান্ধা,জামালপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারীতে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি রোববার আরো অবনতি হয়েছে।নতুন করে তলিয়ে গেছে বির্স্তীণএলাকা।নদ-নদীর পানি পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পানি বন্ধি হয়ে পড়েছেন কয়েকলাখ মানুষ।বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যেও অভাবে বানবাসী মানুষকে পোহাতে হচ্ছে চরম দূভোর্গ। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা,ধরলা ও ঘাঘট নদ-নদীর পানি হ্রাস অব্যাহত থাকায় আগামী কয়েক দিনে গাইবান্ধা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ,বগুড়া ও কুড়িগ্রাম জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে।
একই সাথে ৪৮ ঘন্টায় পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পদ্মা নদী সংলগ্ন রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি সামান্য অবনতি অব্যাহত থাকবে। তবে ৪৮ ঘন্টা পর এসব জেলার বন্যা পরিস্থিতিরও উন্নতি শুরু করবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জানান, নদ-নদীর পানি আগামী কয়েকদিনে আরো হ্রাস পেতে পারে। ফলে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা অববাহিকার নদ-নদী তীরবর্তী জেলাগুলোর বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হবে।
তিনি জানান, গত ২৪ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নদ-নদী কুড়িগ্রামে ধরলার পানি ১৮ সেন্টিমিটার, গাইবান্ধায় ঘাঘটের পানি ১৭ সেন্টিমিটার, চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্রের পানি ১৭ সেন্টিমিটার, বাহাদুরাবাদে যমুনার পানি ১৮ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দিতে যমুনার পানি ৯ সেন্টিমিটার, কাজীপুরে যমুনার পানি ৭ সেন্টিমিটার এবং সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি ৫ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়েছে। তবে এ সকল স্থানে নদ-নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী কয়েকদিনে পানি হ্রাস অব্যাহত থাকবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ফলে এসব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি হবে।
নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জানান, আগামী ৪৮ ঘন্টা পর পদ্মা নদীর পানি হ্রাস পেতে পারে। ফলে নদী তীরবর্তী জেলা রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলার বন্যা পরি¯ি’তি উন্নতি হবে। তবে আগামী ৪৮ ঘন্টায় পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। তিনি জানান, বাহাদুরাবাদ ঘাটের কাছে যমুনা নদীর পানি ১৯৮৮ সালের তুলনায় এবার ১০ সেন্টিমিটার বেশি পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখ্য, রোববার দেশের নদ-নদীর ৯০ মনিটরিং স্টেশনের মধ্যে ৪৬টি স্টেশনে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ৩৯টি স্টেশনে পানি হ্রাস পেয়েছে। ১৮টি স্থানে পানি বিপদসীমার উপর প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া সারাদেশে বন্যা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সমাজের সকল রাজনৈতিক দল ও বিত্তবান জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।রোববার সকালে বাংলাদেশ প্রকৌশল ইনস্টিটিউশনে দিনব্যাপী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উদ্ভাবনী মেলার উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতাকালে মন্ত্রী বলেন, বন্যা কবলিত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করার জন্য সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো এবং সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদেরও এগিয়ে আসা উচিৎ।
তিনি বলেন, কেবল মাত্র আওয়ামী লীগ সরকারই বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এই ধরণের কোনো উদ্যোগ এখনো কোনো রাজনৈতিক দল নেয়নি। মন্ত্রী, বন্যা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সমাজের সকল রাজনৈতিক দল ও বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানান।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মোহাম্মদ শাহ কামাল মেলার উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।
অধিবেশনে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এমপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।বাংলাদেশকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে রোল মডেল হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বাংলাদেশ এখন জীবন, জীবিকা ও সম্পদের ক্ষতি কমিয়ে জরুরী ত্রাণ ও পুনর্বাসন সহ দুর্যোগ মোকাবেলা ও ঝুঁকি হ্রাস করার সক্ষমতার জন্য কাজ করে একটি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে।এছাড়া, গত কয়েক দশক ধরে আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উপর নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করার মাধ্যমে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সক্ষম হয়েছি বলেও তিনি জানান।
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রমের পাশাপাশি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয় উচ্চশিক্ষার পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বলেন, দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। জামালপুর,: যমুনা নদীর পানির স্তর কমতে শুরু করলেও জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।জেলার সাত উপজেলায় সাতটি পৌরসভা ও ৫৫টি ইউনিয়নে ১০ দিনের বন্যায় ছয় লাখ ৭৪ হাজার লোক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, দুপুর পর্যন্ত গত ২৪ ঘন্টায় যমুনা নদীর পানি ১৩ সেন্টিমিটার কমেছে এবং বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১০৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্র জানায়, বন্যা দুর্গতদের জন্য ২০টি আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয় এবং বন্যা আক্রান্ত দুই হাজার ৮২টি পরিবার সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন।সূত্র জানায়, বন্যায় ছয় কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণভাবে এবং ৪৯ কিলোমিটার বাঁধ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।এছাড়া, বন্যায় ১২ কিলোমিটার পাকা সড়ক সম্পূর্ণভাবে এবং ৭৫ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, জেলার ৫৮৯ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যার জন্য আজ পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে।জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ১৯৬টি প্রতিষ্ঠান বন্যার জন্য বন্ধ রয়েছে।কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্র জানায়, বিভাগের ১৭ হাজার ৪৫ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানির নিচে তলিয়ে গেছে।সিভিল সার্জন ডা. মোসাহেরুল ইসলাম জানান, ৮১ টি মেডিকেল টিম জেলার বন্যা আক্রান্ত এলাকায় কাজ করছে।জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খান জানান, জেলার বন্যা আক্রান্ত এলাকায় শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত আছে।
কুড়িগ্রাম: ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমারসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি হ্রাস পেতে শুরু করলেও জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ও সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপৎসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে বেড়েছে তিস্তা নদীর পানি। ফলে খাদ্য, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও গো খাদ্যের সংকটে দুর্ভোগ বেড়েছে বন্যা দুর্গতদের। গত ২ সপ্তাহের টানা বন্যায় জেলার ৯ উপজেলায় ৫৭ ইউনিয়নের এক লাখ ১০ হাজার পরিবারের প্রায় ছয় লক্ষাধিক মানুষ এখনও পানিবন্দি জীবন-যাপন করছেন। ঘর-বাড়ি থেকে দ্রুত পানি সরে না যাওয়ায় ঘরে ফিরতে পারছেন না বাঁধ ও পাকা সড়কে আশ্রয় নেওয়া বানভাসিরা। আর চারণভূমি তলিয়ে থাকায় গো-খাদ্যের চরম সংকটে পড়েছেন বন্যা দুর্গতরা। জেলা প্রশাসন থেকে এ পর্যন্ত ১১৭৫ মেট্রিক টন চাল ও ৩৮ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। শুরু হয়েছে বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর স্বল্প পরিসরে ত্রাণ তৎপরতা। সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও ৬ লক্ষাধিক বন্যা দুর্গত মানুষের জন্য তা অপ্রতুল। ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ বেশির ভাগ বানভাসির। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী (পাউবো) প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ১৭ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপৎসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ও সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি ১৮ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপৎসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যান্য নদ-নদীর পানি সামান্য হ্রাস পেলেও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি ৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।অপর দিকে চিলমারীতে রবিবার একই দিনে এক কিশোর ও এক বৃদ্ধ পৃথক পৃথক ঘটনায় বন্যার পানিতে ডুবে মৃত্যু বরন করেছে। সকালে সরকার পাড়া গ্রামের মৃত কফিল উদ্দিনের পুত্র ওসমান হোসেন (৫৫) উপজেলার সরকার পাড়া মসজিদ সংলগ্ন বিলে কারেন্ট জাল তুলতে গিয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যু বরন করে। পরে বেলা সাড়ে ১২ টায় চিলমারী ডিগ্রী কলেজ মাঠে একদল কিশোর ফুটবল খেলার সময় বল পাশ্ববর্তী পুকুরে চলে যায়। এসময় থানাহাট বাজারস্থ মোঃ শাহিন মিঞার স্কুল পড়–য়া পুত্র নাজিম মিঞা (১৪) ভাসমান বলটি আনতে গিয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যু বরন করে। মৃত নাজিম মিঞা থানাহাট এ,ইউ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেনীর ছাত্র বলে জানাগেছে।
এদিকে, কুড়িগ্রামের চিলমারীতে রবিবার একই দিনে এক কিশোর ও এক বৃদ্ধ পৃথক পৃথক ঘটনায় বন্যার পানিতে ডুবে মৃত্যু বরন করেছে।সকালে সরকার পাড়া গ্রামের মৃত কফিল উদ্দিনের পুত্র ওসমান হোসেন (৫৫) উপজেলার সরকার পাড়া মসজিদ সংলগ্ন বিলে কারেন্ট জাল তুলতে গিয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যু বরন করে। পরে বেলা সাড়ে ১২ টায় চিলমারী ডিগ্রী কলেজ মাঠে একদল কিশোর ফুটবল খেলার সময় বল পাশ্ববর্তী পুকুরে চলে যায়। এসময় থানাহাট বাজারস্থ মোঃ শাহিন মিঞার স্কুল পড়–য়া পুত্র নাজিম মিঞা (১৪) ভাসমান বলটি আনতে গিয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যু বরন করে। মৃত নাজিম মিঞা থানাহাট এ,ইউ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেনীর ছাত্র বলে জানাগেছে।কুড়িগ্রাম পানি কমতে শুরু করলেও এখনও ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপদসীমার ওপরে থাকায় কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরি¯ি’তি অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েণ্টে বিপদসীমার ৬৫ সে.মি ও ধরলার নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
চিলমারী উপজেলার বরুজের পাড় ও শাকখাওয়ার মোড়ে ৩টি পাকা রাস্তা হঠাৎ করে ভেঙে বানের পানি ঢুকে পড়েছে চিলমারীর বিভিন্ন গ্রামে। পানি ঢুকে পড়েছে উপজেলা সদরের থানা ক্যাম্পাস, উপজেলা পরিষদ, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, স্কুল-কলেজ, খাদ্য গুদামসহ অনেক স্থাপনায়। ৩০টিও বেশী গ্রাম প্লাবিত হবার পাশাপাশি উপজেলা সদরের অনেক এলাকায় জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় শত শত হেক্টর জমির বীজতলা ও আমন ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ঝুঁকিতে পড়েছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়ক, রেলপথ ও কয়েকটি সেতু। ঘর বাড়িতে টিকতে না পেরে অনেকে রাস্তা, রেল লাইন ও বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজার রহমান জানান, গত ২৪ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্রে ১৭, দুধকুমারে ২০ ও ধরলায় ১৮ সেন্টিমিটার পানি কমেছে।
কুড়িগ্রামের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক আকতার হোসেন আজাদ জানান, ৯টি উপজেলার ৫৭টি ইউনিয়নের ৭২৮টি গ্রাম এখন পানির নিচে। ১ লাখ ৫০ হাজার ৫৮৬ পরিবারের প্রায় ৬ লাখ ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা আব্দুল মোত্তালিব জানান, এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৭৫ মে. টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। বিতরণ হয়েছে ১ হাজার ৭৫ মে.টন.। প্রাপ্ত ৩৮ লাখ টাকার মধ্যে ৩৪ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। শুকনো খাবার দুই হাজার প্যাকেট বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
এদিকে, খাল ফটোক তুলি কী হইবে? বাহে না খায়া আছি, ভোকোত প্যাট শুকি গেইছে! কিছু দেন। হামাক গুলা বাঁচান।’ বানভাসিদের চোখেমুখে এখন একটাই চাওয়া পেটপুরে কিছু খেতে চান তারা। রোববার কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সেনেরখামার স্কুলে আশ্রয় নেয়া ৪১টি পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলে এমন দুর্দশার কথা জানাযায়। টানা ৮দিন বন্যার সাথে লড়াই করার পর ঘরবাড়ি ছেড়ে সেনের খামার উচ্চ বিদ্যালয় ও সেনের খামার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়। স্ত্রী সন্তানসহ গবাদিপশু নিয়ে একটু মাথা গোজার জন্য ঠাসাঠাসি করে দিনযাপন করছেন। খোলা মাঠে রেখেছে গবাদিপশু। প্রথম দিন তাদের এক প্রকার উপোস করে কেটেছে। একই রকম অবস্থা সদরের মোগলবাসা ইউনিয়নের চরভেলাকোপা স্কুল, গড়েরমাঠ, চর সিতাইঝাড় ফ্লাড শেল্টারসহ নয়ারহাট হাইস্কুলের। প্রত্যন্ত এসব আশ্রয়কেন্দ্রে কেউ খোঁজ নিতেও আসে না বলে আশ্রিতদের অভিযোগ। ফলে তারা খেয়ে না খেয়ে সময় পার করছে। ব্যক্তিগত ভাবে বন্যার্তদের পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়েছেন প্রতিবন্ধি পল্লী চিকিৎসক তারিকুল ইসলাম তারেক। তার ব্যতিক্রম এ উদ্যোগ আলো ছড়িছে। মুখে মুখে তার নাম। গত বুধবার থেকে সেনের খামার স্কুলে আশ্রিত দু’শতাধিক মানুষের খাবার যোগান দিয়ে আসছেন তিনি নির্লস ভাবে। নিজের প্রতিদিনের আয় ও জমানো টাকা থেকে ইতিমধ্যে খরচ করেছেন ৩০ হাজার টাকা। সেই সাথে বন্যার্তদের চিকিৎসা সেবা এবং ঔষধ সরবরাহ করছেন মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ তারিক। তারিক ভালভাবে কা বলতে পারেন না। শারীরিক ভাবেও কিছু প্রতিবন্ধকথা রয়েছে। কোন বাঁধাই তারেককে আটকাতে পারেনি। সরকার কিংবা ধর্ণাঢ্যরা এগিয়ে না এলেও প্রতিবন্ধি তারিক ভানভাসী মানুষের পাশে দাড়িয়ে। সেনের খামার স্কুলে আশ্রিত আমিনা (৪০) জানান, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এক ছেলেসহ ৩ সন্তানকে নিয়ে তিনি পার্শ্ববর্তী চর কৃঞ্চপুর এলাকায় থাকতেন। ঘরের ভিতর পানি ঢুকে পড়ায় তারা চৌকিতে বাঁশ জোড়া দিয়ে উঁচু মাচা করে আশ্রয় নেন। কিন্তু ছোট সন্তান রাব্বি (৩) পরপর দুদিন চৌকি ডেবে পড়ে গেলে তারা বাড়ী ছেড়ে এই স্কুলে এসে আশ্রয় নেয় গত মঙ্গলবার বিকালে। রাতে উপোস থাকতে হয়। বুধবার দুপুরে এলাকার তারিক নামে এক ব্যক্তি খাওয়ার ব্যবস্থা করে। চেয়ারম্যান, মেম্বর কিংবা প্রশাসনের কেউ খোঁজ না নিলেও তারিক ব্যক্তিগত ভাবে তিন বেলা খাবারের যোগান দিয়ে আসছে। একই কথা জানালেন আশ্রিত চর কিষ্ণপুর এলাকার জহুরুল হক (৫৫), রহিমা বেগম(৪০)। এসব অসহায় মানুষের কাছে তারিক যেন সাক্ষাত দেবদূত। কৃঞ্চপুর মাঝেরচরের কাজলী বেগম(২২) এক বছরের মেয়ে রাবেয়া ও ৪ বছরের রহিমাকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। স্বামী রহিম সাধু প্রতিবন্ধী। জন্ম থেকে দ’ুপা তার কাজ করেনা। হাতকে পা হিসেবে ব্যবহার করে চলাফেরা করেন। গ্রামের লোকজন এই অসহায় পরিবারকে উদ্ধার করেছে। কাজলী বেগম জানান, তার স্বামী ভিক্ষা করে যা পায় তাই দিয়ে চলে চারজনের সংসার। ভিটেমাটি ছাড়া তাদের আর কিছু নেই। বন্যার সময় গ্রামের লোকজন তার স্বামী রহিম সাধুকে কোলে করে নৌকায় তুলে ডাঙ্গায় ছেড়ে দেন। সারাদিন ভিক্ষা শেষে আবার ঘাটে এলে লোকজন তাকে বাড়িতে পৌছে দেয়। এরকম আরেকজন বিউটি বেওয়া (৩৫)। মিষ্টি (৬), বিজয় (৮) ও বিপুল (১০) নামে তার ৩ সন্তান রয়েছে। ছোট মেয়ে মিষ্টি পেটে থাকার সময় স্বামী মজনু ঢাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে গিয়ে স্ট্রোক করে মারা যান। তারপর থেকে তিন সন্তানকে নিয়ে তার জীবনযুদ্ধ। চলতি বন্যায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে এক প্রকার অনাহার-অর্ধাহারে থাকতে হয়েছে তাদের। ঘরের চাল পর্যন্ত পানি ওঠায় তারা বাড়ী ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেন। সরকারি কোন সহায়তা পাননি এ অভিযোগ বিউটির। স্থানীয় নির্মল কুমার, মুক্তিযোদ্ধা মন্তাজ আলী জানান, প্রথমদিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে বন্যার্তদের। দ্বিতীয়দিন থেকে তাদের জন্য খাবার নিয়ে আসে তারিকুল ইসলাম তারেক। সেনের খামার স্কুলের পিছনেই তার বাড়ী। স্থানীয় লোকজন তাকে পাগলা ডাক্তার বলে সম্বোধন করে। পেশায় পল্লী চিকিৎসক। গরীব মানুষের ডাক পেলেই সে রাত-বিরাতে ছুটে যায় তাদের পাশে। বাবা নুরুল ইসলাম কৃঞ্চপুর মৌজা আওয়ামীলীগের সভাপতি। মা তফিরণ নেছা। ১৬ শতক জমিতে পৈত্রিক নিবাস। তিন ভাইয়ের মধ্যে তারিক দ্বিতীয়। অপর দু’ ভাইয়ের আয়ে মুলত তার নিজের সংসার চলে। আর তারিক স্ত্রী, ২ কন্যা সন্তানকে রেখে দিন-রাত সমাজের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছে। তারিকুল জানান, প্রতিবছর এখানে বন্যার্ত মানুষ আশ্রয় নেয়। ছোট বেলায় অনেক মানুষকে না খেয়ে থাকতে দেখেছি। তাদের কষ্ট আমাতে খুব নাড়া দেয়। আমার চিকিৎসা পেশা থেকে ৭/৮শত টাকা আয় হয়, তা বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করি। এতেই আমার আনন্দ। মোগলবাসা ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান নূর জামাল বাবলু জানান, সেনের খামার ছাড়াও চরের মধ্যে ৮ থেকে ১০টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এই আশ্রয়কেন্দ্রটি মেইনল্যান্ডে হওয়ায় আশপাশের লোকজন সহযোগিতা করছে। তবে দুরের আশ্রয়কেন্দ্রগুলিতে সরকারি সহযোগিতা ছাড়া বেসরকারীভাবে সহযোগিতা ক নেই।
দিনাজপুর: ভারী বর্ষণ ও বড়পুকুরিয়া খনির কারণে ভূমি অবনমন হয়ে তলিয়ে গেছে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী-বড়পুকুরিয়া সড়কটি। ফলে চলাচলে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে বড়পুকুরিয়া এলাকাসহ ১০ গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষ। রোববার (৩১ জুলাই) বড়পুকুরিয়া বাজার এলাকায় দেখা যায়, বড়পুকুরিয়া বাজার থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় আধা কিলোমিটার রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ওই রাস্তায় রজ্জব আলীসহ চলাচলকারীরা জানায়, ভারী বর্ষণ ও খনির কারণে ভূমি অবনমন হওয়ায় রাস্তাটি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। অনেক জায়গায় খানাখন্দে পরিণত হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে বড়পুকুরিয়ার পাতিগ্রাম, জিয়াগাড়ী, পাথরাপাড়া, বাঁশপুকুর, শিবক্ষ্ণৃপুর, হামিদপুর, ধুলাউদাল, পলাশবাড়ীসহ ১০ গ্রামের মানুষকে।এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, এই জায়গাটির কিছু অংশ অধিগ্রহণ করলেও এলাকাবাসীর যাতায়াতের জন্য আলাদা কোনো রাস্তা করে নাই। ফলে এ রাস্তা দিয়েই তাদেরকে প্রতিদিনই চলাচল করতে হচ্ছে।হামিদপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মন্ডল বলেন, হামিদপুর ইউনিয়নটি পার্বতীপুরের হলেও ভৌগলিক কারণে ফুলবাড়ী শহরের কাছে। হামিদপুর ইউনিয়নবাসিরা হাটবাজারসহ কেনা-বেচায় ফুলবাড়ীর উপর নির্ভরশীল। আর এই সড়কটি যাতায়াতের প্রধান সড়ক। একই কথা বলেছেন, বর্তমান চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলামও সাবেক ইউপি সদস্য জাবেদ আলী। বড়পুকুরিয়া খনি শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি রবিউল ইসলাম বলেন, রাস্তাটি বৃষ্টি হলেই পানির নিচে তলিয়ে যায়। এই রাস্তাটি খয়েরপুকুর হাট দিয়ে ফুলবাড়ী থেকে বদরগঞ্জ উপজেলার একটি সংযোগ সড়ক। ফলে এ রাস্তা দিয়ে ফুলবাড়ী পার্বতীপুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন চলাচল করে। উল্লেখ্য, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কারণে ভূমি অবনমন হওয়ায় গত ২০১১ সালে বড়পুকুরিয়া বাজারসহ ওই এলাকাটির সাড়ে ৬০০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু রাস্তাটি এখন পর্যন্ত স্থানান্তর করা হয়নি। ফলে এই সমস্যার সৃষ্ট হয়েছে।
টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলে বন্যায় পানিবন্দী মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ক্ষতির পাশাপাশি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা।জেলার বন্যা কবলিত ৭টি উপজেলার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বন্যার পানি উঠেছে। এতে শিক্ষার্থীরা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসতে পারছে না। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষিত না হওয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীরা বন্যার পানির মধ্যেও কষ্ট করে বিদ্যালয়গুলোতে আসছেন।
জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্র্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী যমুনার নদীর পানি বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘন্টায় এ নদীর পানি ৫ সেন্টিমিটার কমেছে। পানি বন্দি মানুষকে উদ্ধার, মেডিকেল টিম গঠন এবং ত্রাণ সরবরাহ নিয়ে প্রশাসনের কার্যক্রম ধীর গতিতে চলছে।
এদিকে দক্ষিণ টাঙ্গাইলের নাগরপুর, মানিকগঞ্জের দৌলতপুর, সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলাবাসীর যোগাযোগের একমাত্র সড়ক টাঙ্গাইল-আরিচা আঞ্চলিক মহাসড়কের চাষাভাদ্রা নামকস্থানে বেইলী ব্রীজ ভেঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। শনিবার রাতে বন্যার পানির প্রবল ¯্রােতে চাষাভাদ্রার বেইলী ব্রীজের দক্ষিণ পাশ ভেঙ্গে পড়ে। এর ফলে এ অঞ্চলের জনসাধারণের ঢাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আকস্মিকভাবে ব্রীজটি ভেঙ্গে পড়ায় রাস্তার দুই পাশে যানবাহন আটকা পড়ে। পরে বিকল্প রাস্তা দিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। এতে করে এই ৩ উপজেলার মানুষের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথের সেকশন অফিসার রেজাউল কবির জানান, সাময়িকভাবে ভাঙ্গন প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আমাদের সংগ্রহে ভালো মানের বেইলী নেই, সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ¯’ানে যোগাযোগ করছি। যতদ্রুত সম্ভব বেইলী এনে ব্রীজটি সংস্কার করে চলাচলের উপযোগী করে তোলা হবে।
এদিকে, বোরো ধান আবাদের অধিকাংশ জমিতে দ্বিতীয়বার রোপা আমন আবাদ হয়। একই জমিতে দু-ফসল উৎপাদনে কৃষক অনেকটাই ফুরফুরে। শ্রাবনের শুরু থেকে ভাদ্রের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এসব জমিতে রোপা আমন (ভাদ্রা) রোপন করা হয়। যথাসময়ে বৃষ্টিও হচ্ছিল। বৃষ্টির পানি জমাট বাধায় অধিকাংশ জমিতে কৃষক যথাসময়েই ধানের চারা লাগিয়েছিল। কিন্ত দীর্ঘদিনের অতি বৃষ্টি আর জোয়ারে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীর উপচে পড়া পানি এখন আবাদী জমিতে। গত কয়েক দিনে জেলার অধিকাংশ উপজেলার এসব জমির ধানের চারা এখন পানিতে ডুবে গেছে। কৃষিবিদদের ধারণা, ৪/৫ দিন ধানের চারা পানির নিচে তলিয়ে থাকলে সব চারাই পঁচে নষ্ট হয়ে যাবে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে কৃষক। এদিকে অনেক চারা উৎপন্ন করতে দেরি হওয়া জমিতে চারা রোপন করতে পারেনি। তবে তাদের চারা উৎপাদিত জমিও পানিতে তলিয়ে গেছে। আবাদী জমির ওপর থেকে পানি সরে গেলেও চারার অভাবে কৃষক পূণরায় জমিতে চারা লাগাতে পারবে না। এমনটাই ধারণা করছে স্থানীয় কৃষকেরা।যমুনার পানি বিপদ সিমার ৯১ সে:মি ওপর দিয়ে প্রভাবিহ হওয়ায় উপচে পড়া পানিতে ভূঞাপুর, গোপালপুর ও নাগরপুরের আবাদী জমি তলিয়ে গেছে। আবার ধলেশ্বরী নদীর উপচে পড়া পানিতে তলিয়ে গেছে নাগরপুর ও দেলদুয়ার উপজেলার অধিকাংশ আবাদি জমি। এদিকে বাসাইল উপজেলার ঝিনাই নদীর উপচে পড়া পানিতে প্লাবিত হয়েছে উপজেলার আবাদি জমি।এ বিষয়ে কথা হয় দেলদুয়ারের চাষী আনোয়ার হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, আমি ২০ বিঘা জমিতে রোপা আমন আবাদ শুরু করেছি। অধিকাংশ জমিতে চারা লাগানো শেষ। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে পানি বেড়ে তার জমির ধান ডুবে গেছে। এভাবে পানি থাকলে ধানের সব চারাই পঁচে যাবে। এবং বড় অংকের অর্থনৈতিক ক্ষতিও হবে তার।রোপ আমন ধান চাষী শামসুল হক বলেন, এমনিতেই বাজারে ধানের দাম কম হওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। শ্রমিকের মজুরি ও সারের মূল্যসহ উৎপান খরচে ধান বিক্রি করতে হয়। এরপরও একই জমিতে দুই আবাদ হওয়ায় কৃষক বেঁচে আছে। কিন্ত আকস্মিকভাবে জমির ধানের চারা ডুবে যাওয়ায় কৃষকের ক্ষতি উঠিয়ে নেওয়া কোন উপায় থাকবে না।
বাসাইল উজেলার ঝিনাই নদী তীরের আমিনুর বলেন, নদী ভাঙনের ফলে আমার ২০ শতাংশ জায়গা নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। এছাড়া পানিতে তলিয়ে গেছে রোপা আমনের সব জমি।টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০১৫-১৬ মৌসুমে টাঙ্গাইলের বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় এক লাখ ৬৬ হাজার ৬২১ হেক্টর জমিতে। আবাদ করা হয় এক লাখ ৬৮ হাজার ৭৬৯ হেক্টর জমিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দুই হাজার ১৪৮ হেক্টর বেশি। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ছয় লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন। যেহেতু বোরো আবাদি জমির বেশীরভাগ অংশেই রোপা আমন ধান উৎপাদন হয় সেহেতু বোরো আবাদের সম পরিমান জমির রোপা আমনের ক্ষতি হবে।
অন্যদিকে, আগামী ৪ আগষ্ট জেলার সবগুলো সরকারি প্রাথামিক বিদ্যালয়সহ কেসরকারি কিন্ডার গার্টেন স্কুলে একযোগে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা নেয়ার কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে শিক্ষা অফিস পরীক্ষার সময় সূচী তৈরি করেছে। পরীক্ষার পূর্বে গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও বানের পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। কোন কোন বিদ্যালয়ে মাঠে জলাবদ্ধতার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। মফস্বল এলাকাগুলোতে সড়ক ভাঙা ও সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে পারছে না এসব এলাকার শিক্ষার্থীরা। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে অনেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
জেলার ভূঞাপুর,কালিহাতী,গোপালপুর, নাগরপুর ও দেলদুয়ার উপজেলার ষাট শতাংশ বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস জলাবদ্ধ। এসব বিদ্যালয়ের পাঠদান কর্মসূচী বন্ধ রয়েছে।
বন্যায় প্লাবিত স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষার সময় সূচী নিয়ে বিপাকে রয়েছে। একদিকে প্লাবিত ক্যাম্পাস আর যাতায়াতের অসুবিধা অন্যদিকে বর্ষার কারণে বাড়িতে পড়ার পরিবেশ না থাকায় অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষার কোমলমতি শিশুদের প্রস্তুতি ও অংশগ্রহণ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে সচেতন অভিভাবকরা। বন্যার বিষয়টি বিবেচনা করে পরিক্ষার সময় সূচী অন্তত ১৫দিন পিছানোর দাবি জানান অভিভাবকরা। এদিকে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরিক্ষা নেওয়া জলাবদ্ধ ক্যাম্পাস ব্যতিত অন্য স্কুলগুলোতেও পরিক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরিক্ষা একযোগেই নিতে হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা কর্মকর্তারা।
এসকল বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, বন্যার পানির কারেণে পাঠদান বিঘিœত হচ্ছে। অনেকে ক্লাসে আসতে পারছে না। আবার অনেক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এসময়ে পরীক্ষা নিলে কতোটুক ফলপ্রসু হবে তা নিয়ে শিক্ষকদের সন্দেহে রয়েছে।দেলদুয়ার উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভপতি মো. শওকত আকবর জানান, দেলদুয়ারের ষাট শতাংশ বিদ্যালয়ে জলাবদ্ধতার কারণে পাঠ দান বিঘিœত হচ্ছে। এছাড়া সড়ক ভাঙা ও সড়কে জলাবদ্ধতার কারণে আরো বিশ শতাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে পারছে না। এসময়ে পরীক্ষা নিলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক সকলকেই বিপাকে পড়তে হবে।কয়েকটি উপজেলার প্রাথমিক সহকারি শিক্ষা অফিসার জানান, বন্যার বিষয়টি বিবেচনা করে পরীক্ষা সাত দিন পিছানো হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত পরিক্ষা পিছানোর বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।জেলা প্রাথমিক সহকারি শিক্ষা অফিসার মো. বায়েজিদ খান জানান,আগামী ৪ আগষ্ট অর্ধবার্ষিকী (দ্বিতীয় সাময়িক) পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে। বিভিন্ন উপজেলা থেকে ক্যাম্পাস প্লাবনের সংবাদ আসছে। তবে এখন পর্যন্ত পরীক্ষা পিছানোর বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
শরীয়তপুর: উজানের বন্যার পানি নেমে আসায় শরীয়তপুর জেলার প্রধান প্রধান নদনদীর পানি বৃদ্ধির ফলে পদ্মা নদীর পানি বিপদ সীমার ৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জাজিরা ও নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে জনদুর্ভোগ চরমভাবে বেড়ে গেছে।সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উজানে বন্যার পানি নেমে আসায় এবং টানা বর্ষণের ফলে শরীয়তপুর জেলার প্রধান প্রধান নদনদী পদ্মা মেঘনা কীর্তিনাশা ও আড়িয়াল নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরেশ্বর পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি ৩০ সে.মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিশেষ করে জাজিরা উপজেলার নাওডোবা, কুন্ডেরচর, পালেরচর, বড়কান্দি, বিলাসপুর নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর, চরআত্রা নওয়াপাড়া ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাচিকাটা ইউনিয়নের প্রায় ২০টি গ্রামে নিচু স্থানের বাড়ি ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ১ লাখ মানুষ।এসব এলাকায় অধিকাংশ স্কুল বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাড়ি ঘরের লোকজন ঘরের ভিতরে মাচায় অথবা চৌকির উপর বসবাস করছেন। বাঁশের সাকো দিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে চলাফেরা করছে। আলগা চুলায় রান্না করে কোনো রকম খাওয়া দাওয়া করে বেঁচে আছেন। বাথরুম ডুবে যাওয়ার কারণে পায়খানা প্র¯্রাব করা খুবই সমস্যা হচ্ছে। নলকূপগুলো ডুবে যাওয়ার কারণে বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কলার ভেলা বা নৌকা ছাড়া তাদের চলাফেরার কোনো উপায় নেই।
গবাদি পশু নিয়ে আরো বেশি বিপাকে পড়েছে এখানকার মানুষেরা। গো খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। শত শত একর জমির বীজতলা ও আউশ আমন ধান তলিয়ে গেছে। বন্যার পানি অব্যাহত ভাবে বৃদ্ধি পেলে এর ভয়াবহতা আরো দেখা দেবে। এসব এলাকায় বন্যার পাশাপাশি নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়ে বাড়ি ঘর সরিয়ে নিচ্ছে এলাকার লোকজন।এদিকে এ পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো ত্রাণ সাহায্য সহযোগিতা তো দূরের কথা কেউ ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতেও আসেনি। তবে বেসরকারি সংস্থা এসডিএস ইতোমধ্যে তাদের সকল কর্মীদের ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে।পালেচর রাঢ়ি কান্দি গ্রামের সামাদ সেক বলেন, ‘৭ থেকে ৮দিন ধরে বন্যার পানিতে বাড়ি ঘর তলিয়ে গেছে। চলাফেরা, খাওয়া দাওয়া খুবই কষ্ট হচ্ছে।রাঢ়ি কান্দির মিনারা বেগম ও ধলু সরদার বলেন, বন্যার পানিতে পানির কল ও পায়খানা ডুবে গেছে। এতে আমাদের খুবই অসুবিধা হচ্ছে। অনেক দূর থেকে কলের পানি ভেলায় করে এনে খাই। ঘরের ভিতরে মাচায় বা চৌকিতে আলগা চুলায় পাক করে কোনো রকম খেয়ে বেঁচে আছি। আমাদের কেউ কোনো খোঁজ খবর নেয়নি।স্কুলছাত্রী ডালিয়া বলেন, স্কুল বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। স্কুলে যাওয়ার রাস্তাও তলিয়ে গেছে। আমরা এখন স্কুলে যেতে পারছিনা। তাই স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে।’জাজিরা বিলাসপুর ইউনিয়নের কাজিয়ারচর গ্রামের মেছের মাস্টার জানান, বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। আমাদের বাপ দাদার ভিটে মাটি ছেড়ে অন্যত্র ঘরবাড়ি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ভাই ব্রাদার কে কোথায় যাবে থাকবে বুঝে উঠতে পারছিনা।শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল হোসাইন খান জানান, বন্যার খবর পেয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে তালিকা তৈরির জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ: শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি ফেরি চলাচল এখনও স্বাভাবিক হয়নি। প্রবল ¯্রােতের কারণে ফেরিগুলো স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারছে না। গত ১০ দিনের এই অচলাবস্থার করণে নানা দুর্ভোগে পড়েছে যাত্রী সাধারণ। পণ্যবাহী ট্রাকগুলো দিনের পর দিন অপেক্ষা করছে। শিশুলিয়া প্রান্তে ১৫০টি ট্রাকসহ দু’পারে অন্তত ৩শ’ যান পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে।
এসব তথ্য দিয়ে বিআইডব্লিউটিসির সহকারী ম্যানেজার শেখর চন্দ্র রায় জানান, বহরে ১৭টি ফেরির মধ্যে এখন চলাচল করছে ১২টি ফেরি। তবে রাতে চলছে মাত্র ৮টি ফেরি। লৌহজং ট্রানিংয়ে তীব্র ¯্রােতের সাথে ফেরিকে লড়াই করে টেনে নেয়ার জন্য বিআইডব্লিউটিএ’র উচ্চ ক্ষমতার টাক ব্যবহার করা হচ্ছে। যে ফেরিগুলো চলাচল করছে তাও সময় লাগছে প্রায় দেড়গুণ। এই সীমিত ফেরি চলাচলের কারণে নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বাস ও ছোট যানকে প্রাধান্য দেয়ায় পণ্যবাহী ট্রাকগুলো আটকা পড়ছে বেশী। এদিকে এখানে পদ্মার পানি বৃদ্ধি পেয়ে পল্টুন জলমগ্ন হচ্ছে। তবে সুরকি ফেলে চলাচল উপযোগী রাখা হয়েছে। শিমুলিয়ায় ৩টি ঘাটাই সচল থাকলেও কাওড়াকান্দিতে বন্যার কারণে ২টি ঘাট সচল রয়েছে। তবে জলমগ্ন ২ নম্বর ঘাটটি মেরামত চলছে।মুন্সীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নি¤œাঞ্চলের আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার পরিবার।লৌহজং উপজেলা কলমা ইউনিয়নে ডহরী,শামুরবাড়ি, কনকশার, যশলদিয়া, কান্দিপাড়া, টঙ্গীবাড়ি হাসাইল, বানারী, পাঁচনখোলা, নগরযোয়ার, পাঁচগাঁও, কামারখাড়া ও শ্রীনগর উপজেলার কবুতরখোলাসহ পদ্মা তীরের গ্রাম এবং চার এলাকায় গ্রামগুলো এখন বন্যাকবলিত।পদ্মা ভাগ্যকূল পয়েন্টে বিপদ সীমার ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল আউয়াল জানান, পদ্মার এই পয়েন্টে ২৪ ঘন্টায় ৭ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। এতে অনেক শিক্ষালয় জলমগ্ন হয়েছে।