26-07-16-Gaibandha_Flood-2

হাওর জনপদ সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে থাকলেও সুখবর নেই উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলার নি¤œাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি।এখনো লোকালয়ে ঢুকছে বানের পানি,ভাসছে গ্রামের পর গ্রাম। ডুবে গেছে অনেক বাড়িঘর , রাস্তাঘাট ও ক্ষেতখামার। তাই কমছে না বানবাসী মানুষের কষ্ট। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাব তো আছেই অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে জীবন জীবিকায়ও। এদিকে, বন্যায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্দা ও সুনামগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জে গত কয়েকদিনে প্রায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই পানির স্রোতের সাথে বাড়ছে নি:স্ব ঘরহারা মানুষের সংখ্যা।

উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলার নি¤œাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে আগামী ৪৮ ঘন্টায় অবনতি অব্যাহত থাকতে পারে। রাজধানী ঢাকার আশপাশের বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকতে পারে।দেশের নদ-নদীর ২০টি স্থানে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মঙ্গলবার একথা বলা হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৯০ পানি মনিটরিং স্টেশনের মধ্যে ৬৫টি স্থানে পানি বৃদ্ধি ও ২০টি স্থানে পানি হ্রাস পেয়েছে। ৩টি স্থানে পানি অপরিবর্তিত রয়েছে এবং ২টি স্থানের তথ্য পাওয়া যায়নি।ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা ও সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।সকাল ৯টা থেকে আগামী ৭২ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।আগামী ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীসমূহের পানি সমতল অপরিবর্তিত থাকতে পারে।আগামী ৪৮ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদী সংলগ্ন কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলাসমূহের নি¤œাঞ্চলে এবং গঙ্গা-পদ্মা নদী সংলগ্ন রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলাসমূহের নি¤œাঞ্চলে বন্যা পরি¯ি’তির অবনতি অব্যাহত থাকতে পারে। অপরদিকে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলাসমূহে নি¤œাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

কুড়িগ্রাম:কুড়িগ্রামে ধরলার নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রে পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সরকারী হিসাব মতে জেলার ৯ উপজেলায় ১লাখ ১০ হাজার ৪শ ৭৬ পরিবারের ৪ লাখ ২৯ হাজার ৪শ ৮৫ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে থাকায় ৯ উপজেলার ৪শ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক ও ৫০ কিলোমিটার পাকা সড়ক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এদিকে সদর উপজেলার কুমরপুর এলাকায় কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী মহাসড়কে পানি ওঠায় ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলাসহ বঙ্গসোনাহাট স্থলবন্দরের সাথে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বাধ ধসে যাওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপুর হাট। ২শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নিমজ্জিত রয়েছে আমন বীজতলা, পাট ও সবজি ক্ষেতসহ বিভিন্ন ফসলের মাঠ। বানভাসীরা ঘর-বাড়ি ছেড়ে পাকা সড়ক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিচ্ছে। বন্যা দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানিসহ খাদ্য সংকটে রয়েছে বানভাসীরা। সংকট দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যেরও। সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ বেশিরভাগ বন্যা কবলিত মানুষদের। সদর উপজেলার মধ্যকুমরপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো. আমিরুল ইসলাম জানান, সোমবার হঠাৎ করে মাদ্রাসার মাঠে ৩ থেকে ৪ ফুট পানি উঠে যাওয়ায় জেলা শিক্ষা অফিসারের সাথে কথা বলে মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।মাদ্রাসার ঘরের মেঝে ও বারান্দা জেগে থাকায় সেখানে বন্যার্তরা আশ্রয় নিচ্ছে। গরু-ছাগল ও পরিবারের লোকজন নিয়ে পাকা সড়কে আশ্রয় নেয়া মমিনুল জানান, বাড়িতে পানি উঠার পরও খুব কষ্ট করে ৫দিন ধরে ছিলাম। পানি অতিরিক্ত মাত্রায় বাড়ার ফলে আর থাকা যাচ্ছে না। তাই পাকা রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছি।
জেলা সিভিল সার্জন সূত্রে জানা গেছে ৯ উপজেলায় ৮৫টি মেডিকেল টিম বন্যার্তদের জন্য কাজ করছে।
জেলা প্রশাসন থেকে ৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ও ১শ ৯২ মেট্রিক টন চাউল ও ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। নতুন করে ৯ উপজেলায় ২শ ৮ মেট্রিক টন চাউল ও ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে যা বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃদ্ধি পেয়েছে তিস্তা ও দুধকুমারের পানিও।

গাইবান্ধা: গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও ঘাঘটের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি ১৯ দশমিক ৮২ সেন্টিমিটার, ঘাঘট ২১ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার, করতোয়া ২০ দশমিক ১৪ সেন্টিমিটার ও তিস্তা ২৫ দশমিক ১৩ সেন্টিমিটার হলে বিপদসীমা ধরা হয়।ফুলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর ম-ল জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও ঘাঘটের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলা সদর, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার অন্তত ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বন্যা কবলিত এলাকায় নদী ভাঙনের তীব্রতাও বেড়েছে। জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান জানায়, এ পর্যন্ত বন্যা কবলিত মানুষদের মধ্যে ২শ’ মেট্রিক টন চাল, নগদ দুই লাখ টাকা ও পাঁচ লাখ টাকার শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

জামালপুর: জামালপুরের ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বন্যার কারণে প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল আলিম জানিয়েছেন এ পর্যন্ত ১৫৯টি প্রাথমিক স্কুলে বন্যার পানি উঠেছে। ফলে এসব স্কুলে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।এছাড়া মাধ্যমিক পর্যায়ে আরো ৫০টি স্কুল বন্ধ রয়েছে বলে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান নিশ্চিত করেছেন।বন্যায় জামালপুরের চার উপজেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।এদিকে, জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গেজ রিডার আব্দুল মান্নান জানান, মঙ্গলবার যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্ট বিপদসীমার ৯২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।জামালপুরের জেলা প্রশাসক শাহাবুদ্দিন খান জানান, বন্যার্তদের সাহায্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত দুই লাখ টাকা, ৫৭ টন চাল ও ১১০ বান্ডিল ঢেউটিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে বরাদ্দ আরো বৃদ্ধি করা হবে।

ধুনট (বগুড়া): বগুড়ার ধুনট উপজেলায় বন্যা দুর্গত এলাকার সাতটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ করে দিয়েছেন শিক্ষা কর্মকর্তা (টিও)।সকাল থেকে ধুনট উপজেলার ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের পানিবন্দি এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ধুনট উপজেলার পুকুরিয়া, কৈয়াগাড়ি, শিমুলবাড়ি, রাধানগর, বৈশাখী, আটাচর ও শহড়াবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

ধুনট উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (টিও) কামরুল হাসান জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনার পানি বেড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পূর্ব দিকে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এলাকার ১১টি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার পরিবার। এতে বিদ্যালয়গুলোতে পানি প্রবেশ কারায় চেয়ার, বেঞ্চ তলিয়ে গেছে। বিদ্যালয়ে পাঠদানের কোনো পরিবেশ নেই। এ কারণে সাতটি বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সহকারী প্রকৌশলী হারুনর রশিদ জানান, যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটছে। গত ১২ ঘণ্টায় ১৫ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

বরিশাল: বরিশাল শহরতলীর চরবাড়িয়া গ্রামে কীর্তনখোলা নদীর ভাঙনে পাঁচটি বসতঘর বিলীন হয়ে গেছে।মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে এ ভাঙন শুরু হয়।ভাঙন কবলিত এলাকার রিপন হাওলাদার বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারো বর্ষা মৌসুমে কীর্তনখোলা নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে।যার ধারাবাহিকতায় আজ ভোরে ফকির বাড়ির লালু ফকির, বেলাল ফকির, সরোয়ার ফকিরসহ আরো দু’জনের পাঁচটি বসতঘর কীর্তনখোলার গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।এখন আশপাশের বসতঘরগুলো সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে বলে জানান তিনি। এছাড়া ওই এলাকার সড়ক নদীতে বিলীন হওয়ায় বরিশালের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।