6_21

গুলশান হামলায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততার বিষয়টি এখন অনেকটা স্পষ্ট। নানা কারণে তিনি চলে এসেছেন সন্দেহের মূল কেন্দ্রে। বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেও নিজেকে আর জঙ্গি কানেকশন থেকে মুক্ত বলে প্রমাণ করতে পারছেন না। ঘটনার সময় একইসঙ্গে নিরাপদে থাকা কানাডা প্রবাসী শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসিব খানও ফেঁসে গেছেন। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণের কারণেই তারা তদন্তের জালে আটকা পড়েছেন। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ওই রেস্তোরাঁয় গেলেও হাসনাত করিম আক্রান্ত হওয়া তো দূরের কথা তাকে জঙ্গিদের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবেই দেখা গেছে। এমনকি এই হত্যাকাণ্ডের পর দুই বিদেশী মহিলার স্মার্টফোন দেখা যায় হাসনাত করিমের হাতে। জঙ্গিদের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি ফোনসেট থেকে ‘উইকার ও থ্রিমা’ নামক মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করে দেন। আর এই অ্যাপসের মাধ্যমে জঙ্গিরা বিদেশীদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ছবি ও ভিডিওচিত্র মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক একটি উগ্রপন্থী সংগঠনের মুখপত্র ‘আমাক’ নিউজ এজেন্সির কাছে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে ওইসব ছবি ও ভিডিও চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা সাইট ইন্টিলিজেন্সের স্বত্বাধিকারী রিটা কাৎসের কাছে।

এছাড়া কিলিং মিশন শেষে হাসনাত করিম ও তাহমিদকে জঙ্গি নিবরাস ইসলামের সঙ্গে অস্ত্র হাতে রেস্তোরাঁটির ছাদে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিমায় কথা বলতে দেখা গেছে। রেস্তোরাঁটির ভেতর ও বাইরে থাকা কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ও জঙ্গিদের ধারণ করা মোবাইলের ভিডিও থেকে এসব তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার সরকারের শীর্ষপর্যায়ের এক বৈঠকে গুলশান হামলার সর্বশেষ অগ্রগতি সবিস্তারে তুলে ধরা হয়। সেখানে আলোচনা প্রসঙ্গে গুলশান হামলার সময় পুলিশের দায়িত্ব পালন ও সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তারা বলেন, হামলার সময় গুলশান জোনের একজন পদস্থ কর্মকর্তাকে ৫ রাউন্ড গুলি করার পর অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কারণ, তার কাছে ওই সময় আর কোনো গুলি ছিল না। এছাড়া দুর্ভাগ্যের বিষয়, কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই পুলিশ প্রথমে অপারেশনে নামে। সূত্র জানায়, গুলশান হামলার আদ্যোপান্ত এখন গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে দশ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে রেকর্ড হওয়া একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে।

এই দীর্ঘ ফুটেজের একটি খণ্ডিত অংশ মঙ্গলবার র‌্যাব অফিসিয়ালি প্রকাশ করে। তবে এর বাইরে থাকা ফুটেজে আরও গুরুত্বপূর্ণ অনেক ক্লু রয়েছে। বিশেষ করে জঙ্গিরা কিলিং মিশনের সময় খুনের শিকার বিদেশীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে যেসব ভিডিওচিত্র ধারণ করে সেখান থেকে তদন্তে বড় অগ্রগতি হওয়ার মতো তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তের স্বার্থে আইনশৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এসব তথ্য-প্রমাণ এখন প্রকাশ করা হচ্ছে না। এই ভিডিওচিত্রের বিষয়ে সূত্রটি জানায়, পাঁচ সদস্যের জঙ্গি দল গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করার সময় প্রথমেই একটি গ্রেনেড চার্জ করে। রাত ৮টা ৪৬ মিনিটে এটি মূল ফটকের সামনে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলে রেস্তোরাঁটির ভেতর-বাইরে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। অনেকে কোনো কিছু না বুঝে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করেন। এরপর কোনো সময় না দিয়েই সন্ত্রাসীরা রেস্তোরাঁর মধ্যে ঢুকেই গুলি শুরু করে। এ সময় প্রথমে তারা বিদেশীদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। রেস্তোরাঁর গোলাকার আকৃতির একটি কক্ষে খাবার টেবিলে বসে থাকা জাপানি এবং ইতালিয়ান নাগরিকরা প্রথমে হত্যার শিকার হন। এরপর রেস্তোরাঁর ডানপাশে পৃথক টেবিলে বসে থাকা শিল্পপতি লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ আয়াজ হোসেন, তার বন্ধু ল্যাভেন্ডার সুপারশপের মালিক এহসানুল কবিরের মেয়ে অবিন্তা কবির এবং ভারতীয় নাগরিক তারশী জৈনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই গোলাগুলির সময় রেস্তোরাঁটির দক্ষিণ গেট দিয়ে দেশী-বিদেশী ২০ থেকে ২৫ জন বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন।

তবে একজন ইতালিয়ান নাগরিক বের হতে পারেননি। দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি জঙ্গিদের সামনে পড়ে গেলে তাকেও তারা হত্যা করে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা একজন বাংলাদেশী নাগরিকের পরিচয় জানতে চায় জঙ্গিরা। পরিচয় পাওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এদিকে জঙ্গি সন্ত্রাসীরা খুনের পৈশাচিকতা প্রকাশ করতে গুলি করার পরও বিদেশীদের ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উপর্যুপরি কুপিয়ে খুনের এক বীভৎসতা তৈরি করে। বিশেষ করে তারা খুনের শিকার নারীদের ওপর বেশিমাত্রায় পৈশাচিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। একপর্যায়ে দেখা যায়, তারা খুনের শিকার ইতালিয়ান নাগরিক ক্লদিয়া মারিয়া দান্তনার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন সেটটি তুলে নেয়। একই সময় জিম্মিদের মধ্যে জীবিত শ্রীলংকার নাগরিক প্যাপথা সায়মার স্মার্টফোন সেটটি নিয়ে নেয় জঙ্গিরা। এরপর এ দুটি ফোন সেট হাসনাত করিমের হাতে দিয়ে কী যেন বলে জঙ্গিরা। এ বিষয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা হাসনাত করিমের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, জঙ্গিরা তাকে উইকার ও থ্রিমা নামে দুটি অ্যাপস ডাউনলোড করে দিতে বলেছিল। তিনি প্রাণভয়ে ওই দুটি অ্যাপস নামিয়ে দেন। তবে হোটেলটিতে জিম্মি থাকাবস্থায় ভোর পর্যন্ত হাসনাত করিমকে মোবাইল ফোন সেট ব্যবহার করতে দেখা গেছে। সিসিটিভি ফুটেজে এর প্রমাণ রয়েছে।

হাসনাত করিম গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, জঙ্গিরা তার ডাউনলোড করে দেয়া অ্যাপস ব্যবহার করে সাইট ইন্টিলিজেন্সসহ বিভিন্ন স্থানে ছবি ও ভিডিও চিত্র পাঠিয়েছে। কিন্তু এতবড় হত্যাকাণ্ডের মধ্যে তাকে সপরিবারে জীবিত রাখা এবং পুরো সময় তাকে কেন স্বাভাবিক দেখা গেছে, সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি অনেক প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাচ্ছেন। তবে নানা কৌশলে খুব ঠাণ্ডা মাথায় তিনি গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ ফেস করতে চাইলেও বারবার ধরা পড়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে রেস্তোরাঁটিতে হাসনাত করিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলতে দেখা গেছে তাহমিদ হাসিব খানকে। যিনি কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টোর শিক্ষার্থী। এমনকি একপর্যায়ে হাসনাত করিম, তাহমিদ খান ও নিহত জঙ্গি নিবরাসকে একসঙ্গে হোটেলটির ছাদে দেখা যায়। সেখানে তাহমিদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রও ছিল। কথা বলার সময় তাদের প্রত্যেককে হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়।

সিসিটিভি ফুটেজে এমন দৃশ্য দেখার পর জঙ্গি হামলার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত, ১ জুলাই গুলশানে স্প্যানিশ হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা করে জঙ্গিরা। এতে ২০ জিম্মি ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হন। এছাড়া পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’-এ নিহত হয় ৬ জঙ্গি। তারা হচ্ছে নিবরাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্ব¡ল, মীর সামিহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ও শরীয়তপুরের সাইফুল ইসলাম চৌকিদার। এছাড়া সন্দেহভাজন জঙ্গি জাকির হোসেন শাওন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ জুলাই হাসপাতালে মারা যায়।