‘সরকারি খুতবা’ প্রত্যাখ্যান হেফাজতেরচট্টগ্রাম ইসলামিক ফাউন্ডেশন আহুত দেশব্যাপী জুমার নামাযের খুতবা প্রত্যাখ্যান করেছে ঈমান-আক্বীদাভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এ খুতবাকে ধর্মীয় বিষয়ে সরকারের অবৈধ হস্তক্ষেপ উল্লেখ করে বিষয়টির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে সংগঠনটি। রোববার (১৭ জুলাই) সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের এক বৈঠকে শেষে সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। একই সঙ্গে আগামী ২৯ জুলাই ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে সন্ত্রাসবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নামায ইসলামের মৌলিক ইবাদত। নামায-রোযাসহ ইসলামের ইবাদত-বন্দেগীকে দলীয়করণ ও সরকারিকরণ করা যাবে না। দেশের উলামা-মাশায়েখ ও দলমত নির্বিশেষে সকল মুসলিম জনতা ইবাদত-বন্দেগীতে সরকারের অবৈধ ও অন্যায় হস্তক্ষেপ, নিয়ন্ত্রণারোপ কখনোই বরদাস্ত করবে না বলেও সরকারের প্রতি বৈঠকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ হয়। সংগঠনটি মসজিদের খতীবগণের প্রতি আদর্শ ও শান্তিপূর্ণ মানুষ, সমাজ ও দেশগঠনমূলক পবিত্র কোরআনের আয়াত ও হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে ইসলামের শুরু থেকে চলে আসা নিয়মে খুতবাদানের আহ্বান জানিয়েছে।

সম্প্রতি দেশে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা, গুম, খুনের আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক দেশের মসজিদসমূহে জুমার বয়ান ও খুতবা নির্দিষ্ট করে দেয়ার বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কার্যালয় দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসায় রোববার এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সন্ত্রাসী হামলা, খুন, গুমসহ সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি এবং মানুষের মৌলিক ও ন্যায্য অধিকার হরণের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলার বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীসহ দেশের আলেম সমাজের আরো বেশী ভূমিকা রাখার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

এই লক্ষ্যে মানুষের দ্বারে দ্বারে শান্তির ধর্ম ইসলামের সঠিক শিক্ষা পৌঁছে দিতে আরো বেশি তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, ধর্মহীন শিক্ষানীতি চালু হওয়ার পর থেকে স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা সঠিক ইসলামী জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যে কারণে দেশের দুশমনরা সন্ত্রাসী কাজে ইসলামের জিহাদের অপব্যাখ্যা করে তাদেরকে বিভ্রান্ত করে ব্যবহার করতে চাচ্ছে।

এই অপব্যাখ্যা প্রতিহত করতে আলেমদেরকে স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো বেশি ধর্মীয় সভা-সেমিনার আয়োজনে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, এসব সভা-সেমিনারে পবিত্র কোরআন-হাদীসের আলোকে ইসলামের সুন্দর বাণীসমূহ এবং ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক দেশ ও সমাজ গঠনের বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি সমাজে সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, খুনাখুনি, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ ও অমুসলিম নাগরিকদের ওপর অন্যায়-অত্যাচারের বিষয়ে ইসলামের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারির বিষয়ে পবিত্র কোরআনের আয়াত ও হাদীসসমূহ তুলে ধরে বক্তব্য রাখতে হবে।

বৈঠকে উলামায়ে কেরাম, মসজিদের ইমাম-খতীবগণকে সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণায় সহযোগিতা করার জন্যে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, দেশ ও সমাজ থেকে সন্ত্রাস ও সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার নির্মূলে সরকার যদি প্রকৃতই আন্তরিক হয়ে থাকে, তবে তাদের কাজে প্রতিবন্ধকতা নয়, বরং অবশ্যই সহযোগিতা করবে। বৈঠকে হেফাজতের ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর কমিটিকে সন্ত্রাসবিরোধী ব্যাপক জনমত গঠনের লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের জোরালো প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়।

হেফাজত কেন্দ্রীয় নেতাদের বৈঠকে সম্প্রতি ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক দেশের জামে মসজিদসমূহে পাঠানো বিতর্কিত ও ভুলে ভরা খুতবা প্রত্যাখান করে বলা হয়, এক সময় তারা নামাযের সূরা-ক্বিরাতেও বিধি-নিষেধ আরোপ করতে চাইবে। ইবাদত-বন্দেগীতে হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ আরোপের হঠকারিতা দেশের মুসলমানরা মেনে নিবে না। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও তার ডিজি’র নানা ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডে এমনিতেই দেশের মুসলমানরা চরম ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে ইবাদতে হস্তক্ষেপ করে মুসলমানদেরকে ভয়ানক বিক্ষুব্ধ করে তোলার বিধ্বংসী মিশন বন্ধ করার আহ্বান জানান হেফাজত নেতারা।

হেফাজত নেতারা বলেন, পবিত্র জুমার খুতবা ওয়াজিব ইবাদত। মসজিদের খতীবগণ নামাযের আগে আরবি ভাষায় পবিত্র কোরআনের আয়াত, রাসূল (সা.)এর হাদীস সন্নিবেশিত খুতবা দিয়ে আসছেন ইসলামের শুরু থেকেই। খুতবার পূর্বে কোন কোন মসজিদে কোরআন-হাদীসের আলোকে খতীব সাহেবগণ অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মুসল্লিগণের উদ্দেশ্যে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে শৃঙ্খলা মতে চলা, যে কোন অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত থাকা এবং নামায-রোযাসহ ইসলামের বিধি-বিধান সঠিকভাবে পালনের নিয়ম-কানুন নিয়ে শিক্ষামূলক বয়ান রাখেন। খতীব সাহেবগণ খুতবা পূর্ববর্তী বয়ান প্রকাশ্যেই দিয়ে থাকেন, যা সকল মুসল্লিই শুনেন।

বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনের নেতারা আরো বলেন, মুসল্লিদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি নানা পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকল দলমতের মানুষ থাকেন, মসজিদ কমিটির লোক থাকেন। সুতরাং খতীব সাহেবদের কোন বিভ্রান্তিমূলক বয়ান পেশের সুযোগই নেই। দেশ ও জনগণের স্বার্থে এ পর্যায়ে সরকার চাইলে মসজিদের খতীবগণকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ইসলামের আলোকে বয়ান উপস্থাপনের জন্যে অনুরোধ করতে পারেন। আর সরকারের জনস্বার্থমূলক অনুরোধে খতীবসাহেবগণ অবশ্যই সহযোগিতা করবেন।

কিন্তু খুতবা লিখে দিয়ে তা পড়তে বাধ্য করা, মসজিদসমূহ নজরদারির প্রচারণা এগুলো সুষ্ঠু চিন্তা নয়। কোন অমুসলিম দেশেও এতটা ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাব দেখা যায় না। তারা বলেন, এই যে হঠাৎ করে মসজিদের ইমাম-খতীব ও ওয়াজ-মাহফিল নজরদারির ব্যাপক প্রচারণা, সরকারিভাবে খুতবা নির্ধারণ, এতে তো বিশ্ববাসীর মনে এমন ভাবনা জাগতেই পারে যে, বাংলাদেশের লাখ লাখ মসজিদের খতীব জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণের কাজে জড়িত। হেফাজত নেতারা মুসলমানদের নানাভাবে বার বার বিক্ষুব্ধ করে তোলার মিশন পরিত্যাগের জন্যে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ইসলাম উচ্ছেদ নয়, বরং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে পদক্ষেপ নিন।

বৈঠকে হেফাজতের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী, নায়েবে আমীর ও ঢাকা মহানগরীর আহ্বায়ক আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী, যুগ্মমহাসচিব মাওলানা মুঈনুদ্দীন রুহী, প্রচার সম্পাদক মাওলানা আনাস মাদানী, সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী, আমীরের প্রেস সচিব মাওলানা মুনির আহমদ, কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা মুজিবুর রহমান পেশোয়ারী, মাওলানা হাকীম আব্দুল করীম খান, মাওলানা উবায়দুর রহমান খান, মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী, মুফতী আব্দুস সাত্তার, মুফতী আজহারুল ইসলাম ও মাওলানা শরীফুল্লাহ প্রমুখ।