Sp-Jhenaidahঝিনাইদহ যেন মেস আর ছাত্রাবাসের শহর। শহরে দুই শতাধিক ছাত্রাবাস আর মেস থাকলেও সেখানে কারা থাকে, কেন থাকে, কী করে, কার মেস, ঠিকানা কী, কজন থাকে, কত দিন আছে-এসব ব্যাপারে পুলিশের কাছে কোন তথ্য নেই। জেলা শহরের এমনই একটি মেসে চার মাস আগে উঠেছিল গুলশান হামলার আলোচিত জঙ্গি নিবরাস ইসলাম ও তার সহযোগীরা।

সাইদ ছদ্মনামে নিবরাসসহ দুজনকে মেসে তুলে দিয়েছিল মসজিদের ইমাম ইবি ছাত্র রোকনুজ্জামান রোকন। ন্যাক্কারজনক গুলশান হামলার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রোকনুজ্জামানসহ নিবরাসের সহযোগী সন্দেহে পাঁচজনকে আটকের পর মসজিদের ইমামের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে মসজিদ কমিটি। গতকাল শুক্রবার সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, মসজিদটিতে নতুন একজন ইমাম জুমার নামাজ পড়িয়েছেন। গুলশান হামলার তদন্তকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি দল ঝিনাইদহের এই মেসরূপী জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায়।
তবে এসব ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনও কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করে আসছে। আটক, গ্রেপ্তার, অভিযান বা জঙ্গি নিবরাস সম্পর্কে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়ে আসছে সংবাদকর্মীদের নানা প্রশ্নে।

সরজমিন ঘুরে জানা গেছে, দিনের পর দিন ঝিনাইদহ জেলা শহরের সোনালীপাড়ার মেসে অবস্থানকারী সাইদ নামের ছদ্মবেশী জঙ্গি নিবরাস ইসলামকে কম-বেশি পাড়ার শিশু থেকে যুবক সবাই চিনত। সুদর্শন সাইদ নামধারী জঙ্গি নিবরাস একটি লাল রঙের মোটরসাইকেলে মেস থেকে প্রায়ই শহরে যেত বলে তারা জানিয়েছেন। তার সঙ্গে দু’একজন থাকত। আর প্রায়ই বিকেলের দিকে মেসের পাশে কিশোর-তরুণদের সঙ্গে ফুটবল খেলত, কখনো বা কিশোরদের সঙ্গে সামান্য আড্ডা দিত। নিবরাসের খাদ্য-খাবার আর পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল খুবই সাদামাটা। বাইরে সে মোবাইল ব্যবহার করত না, মসজিদে নামাজ পড়তেও দেখেননি স্থানীয়রা। ঢাকার গুলশানে জঙ্গি হামলার পর গণমাধ্যমে ছবি দেখে কারো কারো চোখে ভেসে ওঠে তাদের পাড়ার সাইদের সেই চেহারা।

তবে ঈদের আগের রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় একটি দল ওই মেসে হানা দেয়ার পর, সাইদ নামটি এলাকার মানুষের মুখে মুখে ব্যাপক আলোচনায় চলে আসে। ছবির সঙ্গে বারবার মেলাতে থাকে সাইদকে, তখন শিশু-কিশোর, তরুণ, যুবক প্রায় সবাই নিশ্চিত হয়ে গেছে তাদের সেই সাদামাটা, সুদর্শন চেহারার যুবকটিই ছিল ভয়ঙ্কর আইএস জঙ্গি নিবরাস ইসলাম।

লেখাপড়ায় অমনোযোগী আর বাবা-মার বখে যাওয়া ছেলে হিসেবে পরিচয় দিয়ে গত ৪ মাস আগে সাইদ ছদ্মনামে ঝিনাইদহ জেলায় শহরের সোনালীপাড়ায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা সার্জেন্ট কওসর আলীর বাসায় মেস ভাড়া নেয় ঘাতক জঙ্গি নিবরাস ইসলাম ও তার সহযোগীরা। নিবরাসকে মেস ঠিক করে দিয়েছিল মেস-সংলগ্ন জামে মসজিদের ইমাম ইবি ছাত্র রোকনুজ্জামান রোকন।

ঝিনাইদহ যেন ছাত্রাবাসের শহর :

সরজমিন ঝিনাইদহ জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রমতে জানা গেছে, জেলা শহরে দুই শতাধিক ছাত্রাবাস ও মেস আছে। এসব মেসে অবস্থানকারীদের বড় একটি অংশ ঝিনাইদহ-সংলগ্ন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে অনেকেই ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে জড়িত, এদের মধ্যে কেউ মসজিদে ইমামতি, মাদ্রাসায়, কিন্ডারগার্টেনে, বে-সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা, টিউশনিসহ নানা পেশায় যুক্ত। এসবের পাশাপাশি অনেক ছাত্র, শিক্ষার্থী বাসাভাড়া করে শহরে অবস্থান করছে। কিন্তুু কে কী করে তার কোনো হিসাব নেই পুলিশের কাছে। জঙ্গি নিবরাস ইসলাম ও তার সহযোগীরা অবস্থানকারী শহরের ৩নং পানির ট্যাঙ্কি এলাকার সোনালী-খোন্দকার পাড়াতেও ৪-৫টি মেস রয়েছে।

ঝিনাইদহ সদর থানার নবাগত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হরেন্দ্রনাথ সরকার জানান, দু’একদিনের মধ্যেই এসব মেস, ছাত্রাবাসের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তাদের হাতে আসবে, পুলিশের পক্ষ থেকে কাজ শুরু হয়েছে।প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার ছয় জঙ্গির মধ্যে অন্যতম নিবরাস ইসলাম হামলার আগে চার মাস ধরে ঝিনাইদহ শহরে অবস্থান করছিল। এ চার মাস ধরে ভয়ঙ্কর জঙ্গি নিবরাস ছোট্ট শহর ঝিনাইদহে কোথায় কী করছিল, কী ছিল তার মিশন ?

কারা আসা-যাওয়া করত এসব নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর কৌতূহল ক্রমেই বাড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এ কয়েক মাসের মধ্যেই ঝিনাইদহে ঘটে যায় পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী হত্যাসহ বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ড। যার দায় স্বীকার করে আইএস জঙ্গি সংগঠন। গুলশান হামলার কয়েক দিন আগে ২৮ জুন মেস ছেড়ে চলে যায় আইএস জঙ্গি নিবরাস ইসলাম ও তার সহযোগীরা।

“ঝিনাইদহে মেস ভাড়া দিতে হলে পুলিশের অনুমতি লাগবে”-এসপি ঝিনাইদহ !

ঝিনাইদহে এখন থেকে মেস ভাড়া দিতে হলে পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। কারা মেসে থাকবে তাও ঠিক করে দেবে পুলিশ। এমন তথ্য জানিয়েছেন ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আলতাফ হোসেন।পুলিশ সুপার আলতাফ দাবি করেন, তাঁর জেলায় জঙ্গিদের কোনো আস্তানা নেই। এমনকি জেলা শহরের সোনালীপাড়ার (খোন্দকার পাড়া) অবসরপ্রাপ্ত সেনা সার্জেন্ট কাওছার আলীর বাড়িতে নিহত জঙ্গি নিবরাস ইসলাম ও তার কথিত খালাতো ভাই আবির রহমান ছিল এমন কোনো তথ্যও নেই তাঁদের কাছে। বেসরকারী একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাতকারে এই কথা জানান এসপি আলতাফ হোসেন।

সাক্ষাৎকারে এসপি ঝিনাইদহের কাওছার আলীর মেস থেকে ঢাকার গুলশানে হামলা চালানোর বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, যেদিন ঢাকায় হামলার ঘটনা ঘটেছে সে দিনই ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কালীচরনপুর ইউনিয়নের মধুপুর-কাষ্টসাগরা গ্রামের রাধা-মদন-গোপাল মঠের সেবায়েত শ্যামল নন্দ দাস খুন হন। একই দিনে নিবরাস ইসলাম দুই ঘটনায় অংশ নিয়েছে এমন খবর বিভ্রান্তিকর। পুলিশের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া জঙ্গিরা এখানে অবস্থান করেছে এমন কোনো তথ্য প্রমাণ আজো আমরা পাননি। তবে বিষয়টি নিবিড়ভাবে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

গণমাধ্যমে প্রচার করা খবরের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আলতাফ হোসেন বলেন, ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার জন্য প্রমাণহীন তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে।’ কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলায় নিহত জঙ্গি আবির রহমান ঝিনাইদহে ছিল না এমন দাবি করে পুলিশ সুপার বলেন, ‘বিষয়টি সাজানো।’ অন্য এক প্রশ্নের জবাবে এসপি বলেন, ‘পাশেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়-যে কারণে ছাত্রশিবিরের আধিপত্য এখানে বেশি। বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে ডাটাব্যাজ তৈরি করা হচ্ছে।

এখন থেকে মেস ভাড়া দিতে হলে পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। কারা মেসে থাকবে তাও ঠিক করে দেবে পুলিশ।’ জেলা শহরের আলোচিত সোনালীপাড়ায় (খোন্দকারপাড়া) অবসরপ্রাপ্ত সেনা সার্জেন্ট কাওছার আলীসহ পাঁচজন এখন কোথায় আছেন এমন প্রশ্ন করা হলে আলতাফ হোসেন বলেন, বিষয়টি জানা নেই তাঁর। বাড়িটিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের খবরও জানেন না বলেও দাবি করেন ঝিনাইদহ পুলিশের সর্বোচ্চ এই কর্মকর্তা।

এসপি আলতাফ হোসেন বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এ জেলায় এক সময় চরমপন্থীদের অভয়ারণ্য ছিল। এখন নেই। ২০১৩-১৪ সালে জামায়াত-শিবির মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এখন পরিবেশ ভালো দাবি করে এসপি বলেন, চলতি বছরের এ পর্যন্ত জেলায় চারটি আলোচিত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। সব ঘটনা আন্তরিকতার সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। এসব হত্যার সঙ্গে স্থানীয় ছাত্রশিবিরের নেতারা জড়িত। অন্য দিকে এ পর্যন্ত জেলার চারজন যুবক নিখোঁজ রয়েছে বলে সবশেষ জানিয়েছে পুলিশ। তারা জঙ্গিদের দলে যোগ দিয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। এদিকে পুলিশ সুপার ঝিনাইদহে দু’জন জঙ্গী থাকার খবর অস্বীকার করলেও যে বাড়িতে নিবরাস ও আবির রহমান ছদ্ম নামে ছিলেন তারা ছবি দেখে নিশ্চিত হয়ে সংবাদকর্মীদের জানিয়েছেন।

এ ছাড়া সোনালীপাড়ার যুবক সমাজ যারা নিবরাস ইসলামের সাথে ফুটবল খেলেছেন তারও বিষয়টি স্বীকার করেন। তারা নিবরাসকে সাঈদ ও আবিরকে শাওন বলে জানতেন। মুলত তাদের বরাত দিয়ে মিডিয়ায় এ খবর প্রচারিত হয়। তাছাড়া সোনালীপাড়ার ভাড়া বাসার মালিকের স্ত্রী বিলকিস নাহার এ ঘটনার পর তার স্বামী ও দুই সন্তানসহ ৫ জনতে তুলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে যওয়ার কথাও গনমাধ্যমকে জানান। আর গন মাধ্যমে ছাত্রাবাসে জঙ্গী থাকার খবর প্রকাশিত হওয়ায় ঝিনাইদহের প্রায় ২০০ ছাত্রবাসে পুলিশ অভিযান চালিয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করছে।

হয়রানীর ভয়ে অনেক ছাত্র মেস ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বলেও জানা গেছে। বাড়ির কাছ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও ঝিনাইদহ শহরে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হওয়ায় শহরের ছাত্রাবাসে থেকে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা করছেন। এখন এ সব ছাত্রাবাসে নিয়মিত পুলিশ নজরদারী করছে। রাতে ঝিনাইদহ শহরে ব্যাপক ভাবে পুলিশ টহল দিচ্ছে।