BD-EARTHUE

এক ভয়াবহ ভূমিকম্প অত্যাসন্ন। আর ৯ মাত্রার সেই ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ঢাকা শহরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তাতে। এই প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের প্রায় ১৪ কোটি মানুষ। IBTimes UK-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে একথা।যে ভূ-গাঠনিক অবস্থানে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে গবেষকরা সতর্ক করছেন।যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের একদল গবেষকের এই গবেষণার তথ্য ১১ জুলাই সোমবার নেচার জিওসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তেমন ভূমিকম্প ঘটলে তা এ অঞ্চলের ১৪ কোটি মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে।

ওই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে রয়টার্স লিখেছে, এখনই বাংলাদেশ বড় ভূমিকম্পে কেঁপে উঠবে এমন কথা বলা না গেলেও দুটি গতিশীল ভূগাঠনিক প্লেট পরস্পরের ওপর চেপে বসতে থাকায় সেখানে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হচ্ছে।গবেষক দলের প্রধান নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ মাইকেল স্টেকলার টমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলেন, ওই ধরনের ভূমিকম্প কবে ঘটতে পারে, সে পূর্বাভাস আরও গবেষণা না করে দেওয়া সম্ভব নয়। ভারতের পূর্ব অংশ ও বাংলাদেশের যে অঞ্চল সম্ভাব্য সেই ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, তার ১০০ কিলেমিটার ব্যাসের মধ্যে প্রায় ১৪ কোটি মানুষের বসবাস।

রয়টার্সের প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ও অন্যতম দরিদ্র এই অঞ্চলে এ ধরনের একটি ভূমিকম্প মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তেমন কোনো ভূমিকম্প হলে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা ভবন, ভারী শিল্প, বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং গ্যাস ক্ষেত্রগুলো ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে বলে গবেষকরা আশঙ্কা করছেন।গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলছেন, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ১৯ কিলোমিটার গভীর পলি জমে বাংলাদেশের যে ভূ-খ- তৈরি হয়েছে, তা সেই ভূমিকম্পের প্রভাবে জেলাটিনের মত কেঁপে উঠতে পারে এবং কিছু কিছু জায়গায় তরলে পরিণত হয়ে গ্রাস করতে পারে ইমারত, রাস্তাঘাট আর মানুষের বসতি।তাদের এই গবেষণায় প্রায় ৬২ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে এই ভূমিকম্পের ঝুঁকির আওতায় বলা হয়েছে।

অধ্যাপক আখতার রয়টার্সকে বলেন, তেমন মাত্রার ভূমিকম্প সত্যিই হলে তার ক্ষয়ক্ষতি এতোটাই ভয়াবহ হবে যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হয়ত বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।২০০৪ সালে যে ফল্ট লাইনের ভূমিকম্পে সৃষ্ট সুনামিতে ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল, সেই একই ফল্ট লাইনে নতুন এই ভূমিকম্পের আশঙ্কা দেখছেন বিজ্ঞানীরা।দশ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি কম্পিউটার মডেল তৈরির মাধ্যমে তারা দেখিয়েছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্ব অংশের ভূ-গাঠনিক প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে সরে গিয়ে মিয়ানমারের পশ্চিম অঞ্চলের ভূ-গাঠনিক প্লেটে চাপ সৃষ্টি করছে, যাতে সৃষ্টি হচ্ছে অস্থিরতা।

ওই গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা টেকটোনিক প্লেটের ওই সরে যাওয়া জিপিএস এর মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করছেন ২০০৩ সাল থেকে। সেই তথ্য বলছে, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্ব অংশের প্লেট মিয়ানমারের পশ্চিম অঞ্চলের প্লেটকে বছরে ৪৬ মিলিমিটার করে ঠেলছে। অধ্যাপক আখতারকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই প্লেটের সংযোগ স্থলে ভূমিকম্পের শক্তি জমা হচ্ছে অন্তত ৪০০ বছর ধরে। ওই শক্তি একসঙ্গে মুক্তি পেলে তা প্রলয়ঙ্করি ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে।মাইকেল স্টেকলার ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসকে বলেন, এমন একটি বিপদ যে ঘনিয়ে আসছে সে ধারণা গবেষকদের কারও কারও মধ্যে ছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য বা মডেল এতোদিন হাতে ছিল না। আমরা জানি না, ঠিক কবে সেই বিপদ আসবে, কারণ আমরা জানি না শেষ কবে ওই এলাকায় এরকম পরিস্থিতি হয়েছিল। আমরা বলতে পারছি না- এখনই, না ৫০০ বছর পরে সেই ভূমিকম্প হবে। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে দেখতে পাচ্ছি- ওখানে শক্তি জমা হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা এই মর্মে নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছেন যে, বিগত ৪০০ বছর ধরে বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ অঞ্চল বলে বিবেচিত বাংলাদেশের ভূ-স্তরের নিচের সাবডাকশন জোনে টেকটোনিক প্লেটগুলোতে প্রবল চাপ জমা হচ্ছে। আর তা এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে রূপ নিতে চলেছে। অল্পকালের মধ্যেই সেই ভূমিকল্প আঘাত হানবে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায়। ভূকম্পনটি হবে ৯ মাত্রার।বিশেষজ্ঞদের এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে, Nature Geoscience পত্রিকায়। বাংলাদেশের মাটির নিচে এক বড় বিপদ জন্ম নিচ্ছে বলে দীর্ঘদিন ধরেই যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, এই গবেষণা সে আশঙ্কারই প্রতিধ্বনি। ধারণা করা হচ্ছিল, বাংলাদেশ অঞ্চলের নিচের টেকটোনিক প্লেটের পরিসীমাটি ভূ-পৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি জায়গায় ক্রমশ আনুভূমিকভাবে স্থানচ্যুত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা এই সাবডাকশন জোনটির নিচে অবস্থিত টেকটোনিক প্লেটের ওপর গবেষণা চালিয়ে এই মর্মে নিশ্চিত হয়েছেন যে, ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে যে ভূমিকম্প হয়েছিল সেটিও এই বিচ্যুতিরই ফল।তারা বলছেন, এই বিশাল সাবডাকশন জোনটি হচ্ছে মূলত এক অতিকায় টেকটোনিক প্লেট যা কোটি কোটি বছর ধরে উত্তর-পূর্ব দিকে এশিয়াপানে একটু একটু করে সরে আসছে। টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষজনিত বিপুল চাপের কারণেই একদা হিমালয় পর্বতের সৃষ্টি হয়েছিল। এই চাপটি ভূস্তরের নিচে ঘড়ির কাঁটার দিকে আবর্তিত হয়ে বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, সাবডাকশন জোন (Subduction zones) হচ্ছে সেইসব এলাকা যেখানে একটি টেকটোনিক প্লেট অন্য একটি টেকটোনিক প্লেটের উপরে উঠে যায়। এর ফলে সেখানে প্রবল ধাক্কাধাক্কি চলতে থাকে। এরপর এরা যখন হঠাৎই একটি অন্যটির থেকে সবেগে সরে আসে তখনই ভূমিকম্পের সূচনা হয়।বিজ্ঞানীরা ২০০৩ সাল থেকেই জিপিএস-এর সাহায্যে ছোট ছোট ভূ-আন্দোলনের ওপর নজর রাখছিলেন। সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছেন, বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল এবং পূর্ব ভারতের একাংশ ক্রমশ মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের দিকে সরে যাচ্ছে। এই সরে যাওয়ার গতি বছরে ৪৬ মিলিমিটার। এর ফলে যে বিপুল চাপ তৈরি হচ্ছে তা মিয়ানমারের ভূপৃষ্ঠের ওপরের ফল্টে জমা হচ্ছে। আর বাকি যে চাপ তা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দূরত্বকে কমিয়ে আনছে। বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, ‘সাবডাকশন তৈরি হচ্ছে’।

তা হিসাব করে দেখেছেন, এর ফলে ২৪ হাজার বর্গমাইল এলাকায় তার প্রভাব পড়ছে। আর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাও এর আওতাধায় পড়ে।যেখানে দেড়কোটির বেশি মানুষের বসবাস।গবেষক দলটির প্রধান মাইকেল স্টেকলার। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক। তাঁর ভাষায়: আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বহুদিন ধরেই এমন বিপদের আশঙ্কা করে আসছিলাম। কিন্তু আমাদের হাতে পর্যাপ্ত ড্যাটা বা মডেল ছিল না।কিন্তু যদি তা ঘটেই যায় তাহলে এর ফল হবে ভয়াবহ। এই গবেষক দলে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ূন আখতার। তিনি এ বিষয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ এ মুহূর্তে কোনো প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প মোকাবেলার জন্য প্রস্তত নয়। দুর্বল কাঠামোর বাড়িঘর-স্থাপনা, বিপুল জনসংখ্যা আর বিপুল গতিতে চলা অবকাঠামো নির্মাণযজ্ঞই বলে দেয় এমন ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হবে।তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সর্বত্রই জনসংখ্যার ঘনত্ব মাত্রাতিরিক্ত। সবকটি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র, ভারী শিল্প কারখানা, সবক’টি বিদ্যুৎকেন্দ্রই সম্ভাব্য ভূমিকম্পস্থলের খুব কাছে অবস্থিত। ভূমিকম্প হলে এসবকিছুই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। আর ঢাকায় ধ্বংসলীলা যে কি ভয়াবহ হবে তা আমাদের কল্পনারও বাইরে। এটি আর বসবাসযোগ্য থাকবে না।