বাংলাদেশ তার ইতিহাসের ভয়াবহতম জঙ্গি হামলার শিকার হলো। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গুলশানের রেস্তোরাঁয় হামলাকারীদের সঙ্গে আন্তর্দেশীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনার বিষয়টি আরও বেশি করে খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা।ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক এলাকায় শুক্রবার ওই হামলা হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে সরকার দেশীয় দুটি গোষ্ঠীকে দায়ী করছিল। এসব সহিংসতা ছিল কোনো ব্যক্তিবিশেষের ওপর হামলার ঘটনা। অধিকাংশ হামলা চালানো হয় চাপাতি ও ধারালো ছুরি দিয়ে। এগুলো কখনোই সমন্বিত গণহত্যা ছিল না।
তাই সন্ত্রাস দমনবিষয়ক কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেস্তোরাঁয় ঝোড়োগতিতে জঙ্গিদের প্রবেশ ও রাতের খাবারের জন্য উপস্থিত হওয়া অতিথিদের জিম্মি করা, দৃশ্যত বিদেশিদের বেছে বেছে হত্যা এবং শেষমেশ বন্দুকযুদ্ধ দিয়ে পরিসমাপ্তি এ দেশে সন্ত্রাসী হামলায় এক নতুন পর্যায়ের আধুনিকতা ও মাত্রাকেই তুলে ধরেছে।বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেছেন, হামলার পেছনে কোন গোষ্ঠী জড়িত তা আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বলতে পারছি না। তবে তারা সুপ্রশিক্ষিত সন্ত্রাসী।
পুলিশের সন্ত্রাস দমন শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, ওই ঘটনার আগে হামলাকারীরা আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) বা আল-কায়েদার কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা পেয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গুলশানের ঘটনা তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যেসব হামলা হয়েছে সেগুলোর অংশ নাকি হামলাগুলোর মাধ্যমে উৎসাহিত হয়ে এটি ঘটানো হয়েছে তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গুলশানে রেস্তোরাঁয় হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস। এমনকি যখন জিম্মি ঘটনা চলছিল, তার মধ্যেই এই গোষ্ঠী রেস্তোরাঁর ভেতরের ভয়াবহ ছবি প্রকাশ করে। হামলাকারী জঙ্গিরাই দৃশ্যত ছবিগুলো পাঠিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত এসব দৃশ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরকারি সূত্র বলেছে, মার্কিন সরকারের কিছু বিশেষজ্ঞ আইএসই যে এ হামলা ঘটিয়েছে, সেই মতের দিকে ঝুঁকছেন। হামলার ঘটনাটিতে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন মার্কিন নাগরিক। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন অন্তত নয়জন ইতালীয় ও সাতজন জাপানি নাগরিক।
আল-কায়েদা নাকি আইএস: মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে কোনো বিদেশি জঙ্গি নেই বলে দীর্ঘদিন ধরেই বলা হচ্ছিল। যদিও কিছুসংখ্যক পশ্চিমা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এ দাবির ব্যাপারে প্রশ্ন তুলছিলেন।
কর্মকর্তারা বলছেন, শুক্রবার রাতের হামলা ও জিম্মি করার ঘটনায় জড়িত সাতজন অস্ত্রধারীর সবাই বাংলাদেশের স্থানীয়। দেশটিতে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ব্লগার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজনের ওপর যে হামলা হয়েছে, তার জন্য দেশীয় দুই প্রধান জঙ্গিগোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়। গুলশানের হামলাকারীরা এদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
দেশীয় এই দুই জঙ্গিগোষ্ঠীর মধ্যে আনসার-আল-ইসলামকে তুলনামূলকভাবে বেশি সংগঠিত ও বিপজ্জনক বলে ধারণা করা হয়। গোষ্ঠীটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এ দেশে আইএসের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করেছে।
বাংলাদেশ, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিকতম হামলার ঘটনাটিতে কোনো বিদেশি জঙ্গি যদি জড়িত না-ও থেকে থাকে, যারাই এটি ঘটিয়েছে, তারা দৃশ্যত বিদেশি সমর্থনপুষ্ট।
এ ব্যাপারে উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, এ হামলায় এমন এক মাত্রার আধুনিকতা রয়েছে, যা সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনার পরিকল্পনা করায় সুপ্রশিক্ষিত লোকজনের যুক্ত থাকার ইঙ্গিত দেয়। আর এমন দক্ষতা আইএস ও আল-কায়েদার রয়েছে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশফাক চৌধুরী জানান, ঘটনাস্থল থেকে চারটি পিস্তল, একটি একে-২২ আধা স্বয়ংক্রিয় বন্দুক, চারটি অবিস্ফোরিত বোমা ও কয়েকটি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
রেস্তোরাঁয় সাধারণ মানুষকে হামলার নিশানা বানানোর ঘটনা দৃশ্যত জেএমবির কর্মকান্ডের সঙ্গে বেশি উপযুক্ত। গোষ্ঠীটি তাঁর হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছে অমুসলিম,এমনকি দরিদ্র রিকশাচালক বা মুদি দোকানিকেও।বিপরীতে,আনসার-আল-ইসলাম বিশেষত তাদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছেকথিত ইসলামবিরোধী কর্মকা-ে নিয়োজিত ব্যক্তিদের। যেমন ব্লগার ও সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কর্মীদের। গোষ্ঠীটি এ-ও বলেছে, তারা লক্ষ্যহীন বা এলোমেলো হামলা চালাবে না।
বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমনবিষয়ক কর্মকর্তারা বলছেন, আনসার-আল-ইসলাম সংগঠনটি আল-কায়েদার আদর্শ ও পদ্ধতি অনুসরণ করে। তাদের দলে সাবেক কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তাঁদের এই ভূমিকা সংগঠনটিকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
তবে বিদেশি ও স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে আল-কায়েদা এবং আইএস বা এ দুই সংগঠনের প্রতিনিধিত্বকারী স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ার হুমকিও দেখছেন।
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে যেখানেই সন্ত্রাসী হামলা হয়, তার কিছুক্ষণ পরেই সেই হামলার দায় স্বীকার করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। আর এ খবর জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েবসাইট সাইট ইনটেলিজেন্স থেকে।এর আগেও দেশে লেখক-প্রকাশক, ব্লগারসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গুরু ও বিদেশি হত্যার পর দায় স্বীকার করেছিল আইএস। এর ‘লিংক’ খুঁজছে বাংলাদেশ পুলিশ।
পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, সেই লিংক আপের বিষয়টি আমরা এখনও শনাক্ত করতে পারিনি। তবে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। কারা এই দায় স্বীকার করে থাকে।গুলশানে জঙ্গি হামলার এক সপ্তাহ না কাটতেই বৃহস্পতিবার (৭ জুলাই) ফের বোমা বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে কিশোরগঞ্জ। উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ঈদ জামাতের মাঠের কাছে শোলাকিয়ায় এ হামলা চালায় জঙ্গিরা। গুলশানে হামলার দায় আইএস স্বীকার করলেও শোলাকিয়ায় হামলার দায় এখনও কোনো জঙ্গি সংগঠন স্বীকার করেনি।শনিবার (৯ জুলাই) বেলা সাড়ে ১২টার দিকে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক।
পরে তিনি পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের গোলাগুলি চলাকালে ঘরের ভেতর নিহত ঝর্না রানি ভৌমিকের পরিবারের সদস্যদের কাছে যান। দুঃখ প্রকাশ করে তাদের সান্ত¡না দেন পুলিশ প্রধান। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকার গুলশানে যারা হামলা করেছে, তারাই শোলাকিয়ায় হামলা চালিয়েছে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ঈদগাহ মাঠের মুসল্লিদের উপর হামলা করা এবং তাদের হত্যা করা।
তিনি বলেন, ঈদের জামাতে যারা বোমা মেরে মানুষকে হত্যা করে তারা ইসলামের শক্রু, মানবতার শত্র“। এরা জেএমজির সদস্য এবং তালিকাভুক্ত জঙ্গি। শোলাকিয়ায় পুলিশের গুলিতে আহত আটক হামলাকারী শফিউল ইসলাম জিজ্ঞাসাবাদে ওইসব তথ্য পুলিশকে জানিয়েছে।
আইএস প্রসঙ্গে পুলিশ প্রধান আরও বলেন, গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলাকারীরা একই গোষ্ঠীর। তারা জেএমবির সদস্য। তারা কেউ আইএসের নয়। শোলাকিয়ার হামলায় পুলিশের কোনো ব্যর্থতা নেই উল্লেখ করে আইজিপি বলেন, পুলিশ আহত হয়েও পুরো দুই ঘণ্টা গোলাগুলি করে, হামলাকারীদের প্রতিহত করে। এক্ষেত্রে পুলিশ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। শোলাকিয়ায় জঙ্গিদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোলাগুলিতে দুই পুলিশ সদস্য, হামলাকারী জঙ্গি ও এক নারী নিহত হন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। এদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। শোলাকিয়া মাঠের আড়াইশ মিটারের মধ্যে আজিমুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ফটকের কাছে নিরাপত্তার দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ওপর এই হামলার ঘটনা ঘটে। ঈদের সকালে বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির ঘটনায় শোলাকিয়া মাঠের জামাতে অংশ নিতে জড়ো হওয়া লাখো মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়।১ জুলাই গুলশানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনায় বহু হতাহতের পর এবার প্রধান সব ঈদ জামাতেই বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। এর ভেতরেই দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাতে ফের হামলা চালায় জঙ্গিরা।
এদিকে, ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা তাঁদের ও বাংলাদেশে অবস্থানরত তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। এ কথা জানিয়ে নিরাপত্তা জোরদারের জন্য তাঁরা বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে এক ব্রিফিংয়ে তাঁরা এ অবস্থান তুলে ধরেন।গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় দেশি বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে হত্যার পর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের জন্য এই ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমর্থন করবে বলে আশা প্রকাশ করেন। তিনি দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে তিনি কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করেন।
ব্রিফিং শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কূটনীতিকদের কেউই আলোচনার বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি। তবে পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ব্রিফিংয়ের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদকে একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে অভিহিত করেন।তিনি কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করে বলেন, সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের শিকড় খুঁজে বের করবে। নিরাপত্তাবাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে। দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
জানতে চাইলে কূটনৈতিক কোরের ডিন ও মিসরের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মাহমুদ ইজ্জাত বলেন, কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতেরা তাঁদের নিজেদের, দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মীদের পাশাপাশি তাঁদের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন।এ জন্য কূটনৈতিক এলাকার পাশাপাশি বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে। এ জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতসহ কয়েকজন কূটনীতিক প্রয়োজনে বাংলাদেশে সহায়তা দেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন। বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাষ্ট্রদূতদের কাছ থেকে সন্ত্রাসবাদ দমনে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে বিষয়ে পরামর্শ চান।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য এক কূটনীতিক বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত আন সিয়ং দো বাংলাদেশে ব্যবসা ও চাকরি সুবাদে অবস্থান করা কোরিয়ার নাগরিকদের নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং তাঁদের নিরাপত্তা চান। ডি কে হং নামে যে কোরিয় নাগরিক হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর পাশে থাকতেন এবং গোটা ঘটনাটি ভিডিও করেছে, তাঁর নিরাপত্তার বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
হং আর্টিজান রেস্তোরাঁর পাশের বাড়িতে থাকতেন এবং শুক্রবার সারা রাত এবং শনিবার সকালে অপারেশন থান্ডার বোল্ট নামের অভিযানটি ভিডিও করেন এবং পরে এই ভিডিও সামাজিক যোগযোগের মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত আন সিয়ং দো খুদে বার্তায় জানান, তিনি তাঁর দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেন, এখন সময় এসেছে সন্ত্রাসবাদ দমনে সবাই একসঙ্গে কাজ করার এবং এ জন্য তাঁরা সরকারকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছেন।গুলশান ঘটনায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও এক রাষ্ট্রদূত ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন তোলেন বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে কূটনৈতিক কোরের ডিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর্মি স্টেডিয়াম ছেড়ে যাওয়ার পরে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা শ্রদ্ধা জানানোর পর দেখতে পান হঠাৎ করে গ্যালারি থেকে দর্শকেরা লাফ দিয়ে মাঠে ঢুকে পড়ে এবং কয়েকজন রাষ্ট্রদূত বিচলিত হয়ে পড়েন।জাপানের রাষ্ট্রদূত এ ঘটনার জন্য শোক প্রকাশ করেন এবং বাংলাদেশে দুই দিনের শোক দিবস ঘোষণার জন্য ধন্যবাদ দেন।
অন্যদিকে,গত শুক্রবার হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা এবং জিম্মি সংকটের সমাধান আরও দ্রুত করা কি সম্ভব ছিল? সেখানে কমান্ডোরা কি আরও আগে অভিযান চালাতে পারতেন? ঝটিকা অভিযান আরও আগে চালালে হতাহতের সংখ্যা কি কমানো যেত? এসব প্রশ্নই এখন ঘুরেফিরে সবার মনে আসছে। গত শনিবার সকালে ঘটনাস্থলে পুলিশপ্রধানের (আইজি) গাড়ির গতি রোধ করে একজন বাবা তাঁর মেয়ের খবর জানতে চেয়েছিলেন। জিম্মি হয়ে ছিলেন এ রকম আরও অনেকের স্বজনেরা বেদনাভরা বুক নিয়ে যখন ঘরে ফিরেছেন, তাঁদের মনে ওই প্রশ্নগুলো বারবার ফিরে এসেছে। এখনো তাঁরা এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন।জিম্মি সংকটের বিস্তারিত, হতাহতদের সংখ্যা ও পরিচয় এবং হামলাকারীদের বিষয়ে আমরা প্রথম ও একমাত্র যে সরকারি ভাষ্য পাই, সেটি হচ্ছে আন্তবাহিনী গণসংযোগ অধিদপ্তর আয়োজিত শনিবার দুপুরের সংবাদ সম্মেলন। কোনো প্রশ্নের সুযোগ না থাকায় একটি লিখিত বিবৃতির বাইরে আর কোনো তথ্য এখনো সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
কর্তৃপক্ষীয় ভাষ্য বলছে, ১ জুলাই রাত প্রায় পৌণে নয়টায় রাজধানীর গুলশান-২ এর রোড নং ৭৯স্থ হলি আর্টিজান বেকারী নামক একটি রেষ্টুরেন্টে দুষ্কৃতিকারীরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে প্রবেশ করে এবং রেষ্টুরেন্টের সকলকে জিম্মি করে।’ ওই বিবরণ অনুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে শনিবার সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে অপারেশন শুরু হয় এবং ৮টা ৩০ মিনিটে তার সফল সমাপ্তি ঘটে। জিম্মি পরিস্থিতি নিরসনের অভিযান পরিচালনার আগের প্রায় ১২ ঘণ্টায় কী কী ঘটেছে, তার একটা ধারণা অবশ্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সম্প্রচার ও প্রকাশিত সংবাদ থেকে পাওয়া যায়।হামলার গোড়ার দিকে সেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ একটি উদ্যোগ নেয় এবং ঘটনার গুরুত্ব বুঝে ওঠার আগেই তাঁদের দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাÑরবিউল করিম ও সালাউদ্দিন নিহত হন। আহত হন আরও ৩৫ সদস্য। পুলিশের এই প্রাথমিক সাড়ায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নও (র্যাব) শরিক ছিল এবং তাদেরও কয়েকজন আহত হন।
টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ঘটনাস্থল থেকে এগুলো সরাসরি সম্প্রচার করতে থাকার একপর্যায়ে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ওই এলাকায় নিরাপত্তাবেষ্টনী মেনে চলার এবং সরাসরি সম্প্রচার বন্ধের আহ্বান জানান। তবে সম্প্রচারগুলোতে পুলিশ ও র্যাবের কোনো কোনো সদস্যের আচরণে স্পষ্টতই পেশাদারত্বের অভাব দেখা গেছে। ফ্ল্যাপজ্যাকেট ও হেলমেট না পরে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে যাওয়া জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোন ধরনের প্রস্তুতির চিত্র তুলে ধরে কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই তা ভেবে দেখবে। বেনজীর আহমেদ একই সময়ে শান্তির্পূণভাবে সংকট নিরসনের লক্ষ্যে হামলাকারীদের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। জিম্মিদের মুক্ত করার লক্ষ্যে জঙ্গিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু এবং নানা ধরনের শর্তের বিষয়ে নানান গুজব রটলেও কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে নিশ্চিত করা হয় যে কোনো ধরনের যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, যেখানে আলোচনা শুরুই হয়নি, সেখানে কেন জিম্মিমুক্তির অভিযানে প্রায় ১২ ঘণ্টা অপেক্ষা করা হলো? আলোচনার মাধ্যমে জিম্মিদের মুক্ত করার কোনো দৃষ্টান্ত বা অভিজ্ঞতা কি আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর বর্তমান নেতৃত্বের আছে? তাহলে সময় অপচয়ের ব্যাখ্যা কী?
এ ধরনের অভিযানে প্রাণহানি, বিশেষ করে জিম্মিদের জন্য ঝুঁকিটা অনেক বেশি। আবার জিম্মিদের মধ্যে বিদেশিদের সংখ্যাধিক্য থাকার কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, সেই সিদ্ধান্ত নিতেই কি কালক্ষেপণ হলো? জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় আমলাতান্ত্রিকতা অথবা দীর্ঘসূত্রতা অথবা এই দুইয়ের যোগফল আরও বড় বিপদের কারণ হতে পারে।সরকারি ভাষ্যে আমরা জেনেছি যে উদ্ধার অভিযানের আগেই ২০ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যার ধরন ছিল ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে খুন। অন্য কথায়, কুপিয়ে বা জবাই করে হত্যা। ওই ভাষ্যে আমরা আরও জেনেছি যে নিহতদের মধ্যে ১৭ জন বিদেশি এবং ৩ জন বাংলাদেশি (বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক মার্কিন নাগরিক)। অভিযান পরিচালনাকারীরা এসব হত্যার কথা কখন জানতে পেরেছেনÑঅভিযানের আগে, নাকি পরে? এতজনকে কুপিয়ে বা জবাই করে হত্যার ব্যাপারটি মুহূর্তের বা কয়েক মিনিটের বিষয় নয়Ñযেমনটি ঘটে আগ্নেয়াস্ত্রে। তাহলে দীর্ঘ সময় ধরে এই হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার সুযোগ তাদের কেন দেওয়া হলো? আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে বলে বলা হয়। মুঠোফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে সিমের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন অপরাধ দমনে সহায়ক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের কথিত সংবাদ সংস্থা আমাক রাতেই জানিয়েছে, তারা ২৪ জনকে হত্যা করেছে। ওই হত্যার দাবি প্রকাশের দুই ঘণ্টা পর নিহতদের ছবি প্রকাশ করে তারা। বহুল সমালোচিত সাইট ইন্টেলিজেন্সের টুইটের সময় মিলিয়ে দেখা যায়, আমাদের উদ্ধার অভিযানটি চালানো হয়েছে ওই সব ছবি প্রকাশের প্রায় দেড় ঘণ্টা পর। তাহলে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কথিত মিডিয়া মনিটরিং ইউনিটগুলো কী কাজ করল? সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ইউনিট, স্পেশালাইজড উইপন্স অ্যান্ড ট্যাকটিকস (সোয়াট) টিম, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা শাখার মধ্যে কোথাও কি সমন্বয়ের ঘাটতি ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর আত্মানুসন্ধানের জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন আমাদের সবার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য। সন্তানহারা অভিভাবক কিংবা যেসব বিদেশি মারা গেলেন, তাঁদের স্বজনদেরও সান্ত¡নার জন্য এসব প্রশ্নের জবাব প্রয়োজন।