গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শোকাহত দেশি-বিদেশি নাগরিকেরা। সোমবার সকাল ১০টা ২ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সর্বস্তরের মানুষ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিকসহ বিদেশি নাগরিকেরা। অনুষ্ঠানের শুরুতেই জানানো হয়, জাপানি রীতি অনুয়ায়ী, তাদের নিহত নাগরিকের জন্য রোববার রাত থেকেই সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু হয়েছে।প্রথমে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পক্ষে মঞ্চের সামনে কালো বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে রাষ্ট্রপতি ভুটানে থাকায় তার পক্ষে ফুল দেন বঙ্গভবনে দায়িত্বরত কমান্ডার মিনহাজ আলম।রাষ্ট্রপতির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পায়ে হেঁটে শ্রদ্ধা নিবেদন মঞ্চে গিয়ে ফুল দেওয়ার পর কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি।
শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধানমন্ত্রী আর্মি স্টেডিয়ামে উপস্থিত নিহত ইশরাত,ফারাজ ও অবিন্তার স্বজনদের সমবেদনা জানান।এরপর মঞ্চের সামনে উপস্থিত ভারত, ইতালি, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা।চার কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলে স্টেডিয়াম থেকে বের হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী আবারও নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের সান্ত্বনা দেন।এরপর বেদীতে ফুল দিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ভারত, ইতালি, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতরা।নিহতদের পরিবারের সদস্য, বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিক, আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, এফবিসিসিআই, নিহত পুলিশের পরিবারের সদস্য এবং ঢাকার দুই মেয়র ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষে ইশরাত,ফারাজ ও অবিন্তার পরিবারের সদস্যদের কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়। সেনাবাহিনীর একজন সদস্য এ সময় পরিবারের সদস্যদের হাতে ডেথ সার্টিফিকেট হস্তান্তর করেন।
ক্রদ্ধা নিবেদনের সময় মন্ত্রিসভার সদস্য; প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা; আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতৃবৃন্দ; সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী টওধান; পুলিশ মহাপরিদর্শক; র্যাব মহাপরিচালক এবং উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আর্মি স্টেডিয়ামে যে মঞ্চটি তৈরি করা হয়, সেখানে তিনটি মরদেহ আনা হয়। দুটি কফিন ঢাকা ছিল বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে। আরেকটি ঢাকা ছিল বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা দিয়ে। হামলায় পাঁচ দেশের নাগরিকেরা নিহত হওয়ায় মঞ্চের পেছনে পাঁচটি দেশের পতাকা টাঙানো হয়। মাঝে ছিল বাংলাদেশের পতাকা। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হামলায় নিহত দুই বাংলাদেশি ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও ইশরাত আকন্দ এবং এক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অবিন্তা কবীরের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় অবিন্তার স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সান্ত¡না দেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী নিহত অপর চারটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গেও কথা বলেন। ১০টা ১০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী আর্মি স্টেডিয়াম ত্যাগ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পক্ষে কমান্ডার মিনহাজ নিহত ব্যক্তিদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর ভারতের হাইকমিশনার, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইতালির রাষ্ট্রদূতেরা শ্রদ্ধা জানান। জঙ্গি হামলায় ভারতের একজন, জাপানের সাতজন, ইতালির নয়জন এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক নিহত হয়েছেন। রাষ্ট্রদূতেরা কেউ করজোড়ে, কেউবা মাথা নিচু করে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এরপর বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকেরা এক সঙ্গে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা এবং এরপর নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যরা শ্রদ্ধা জানান। বেলা পৌনে ১১টার দিকে পরিবারের স্বজনেরা মরদেহ নিয়ে চলে যান।
আর্মি স্টেডিয়ামে নিহত ১৭ বিদেশির মরদেহ আনা হয়নি। তাঁদের মরদেহ সিএমএইচের হিমঘরে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে হস্তান্তর করা হবে।রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর দুপুর ১২টা পর্যন্ত সর্বস্তরের সাধারণ জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মঞ্চ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ১৪ দল, ১১ দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।মৃতদেহ ময়নাতদন্তের পর রোববারই হস্তান্তর করা হবেÑএই আশায় স্বজনেরা সকাল থেকেই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) অপেক্ষা করতে শুরু করেন। পরে সিএমএইচ থেকে তাঁদের আজ সকাল ১০টায় আর্মি স্টেডিয়ামে আসতে অনুরোধ জানানো হয়। জানানো হয় সেখানেই মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।
গুলশানে জঙ্গি হামলার রক্তাক্ত সমাপ্তি হয়েছে। তবে এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি জাতি। সরকার দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। রোববার ভোর থেকে ঢাকাসহ সারা দেশের অফিস-আদালতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার মাধ্যমে শোক পালন শুরু হয়। আজও শোক পালন করছে জাতি।শোকের আবহে ফুল দিয়ে গুলশানে ক্যাফেতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের পতি শ্রদ্ধা জানাল বাংলাদেশ।নিহতদের স্মরণে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোকের দ্বিতীয় দিন সোমবার সকাল ১০টায় ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে শ্রদ্ধা নিবেদনের এই আনুষ্ঠানিকতা হয়।রাষ্ট্র প্রধান ও সরকার প্রধান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সর্বস্তরের নাগরিক ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্মরণ করেন গুলশানের সেই নৃশংস হামলায় নিহত ১৭ বিদেশি নাগরিক ও ৩ বাংলাদেশিকে; শ্রদ্ধা জানান ফুল হাতে।
পুরো বাংলাদেশকে স্তম্ভিত করে দেওয়া সেই জঙ্গি হামলার ঘটনার পর দুই দিন পেরিয়ে গেলেও আর্মি স্টেডিয়ামের বাতাস যেন ভারি হয়ে ছিল শোকে। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনদের কান্না চাপা চোখমুখ বলছিল তাদের অব্যক্ত বেদনার কথা। স্টেডিয়ামের পশ্চিম প্রান্তে করা মঞ্চে রাখা হয় তিন বাংলাদেশির কফিন, যারা নিজের দেশের জঙ্গিদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন।
তিন বাংলাদেশির মধ্যে ইশরাত আখন্দ এবং ফারাজ হোসেনের কফিন বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে ঢাকা ছিলো। দ্বৈত নাগরিক হওয়ায় অবিন্তা কবীরের কফিনে ছিল বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তাদের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়স্বজনদের কাছে। গত শুক্রবার রাতে গুলশান ২ নম্বরের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় একদল অস্ত্রধারী জঙ্গি; দেশি বিদেশি অন্তত ৩৩ জন সেখানে জিম্মি হন।
প্রায় ১২ ঘণ্টা পর কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ওই রেস্তোরাঁর নিয়ন্ত্রণ নেয় সশস্ত্রবাহিনী। ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও ২০ জনের লাশ পাওয়া যায় জবাই করা অবস্থায়।নিহতদের মধ্যে নয়জন ইতালির, সাতজন জাপানি ও একজন ভারতের নাগরিক। বাকি তিনজন বাংলাদেশি, যাদের মধ্যে একজনের যুক্তরাষ্ট্রেরও নাগরিকত্ব ছিল।
নিহত বাকিদের কফিন স্টেডিয়ামে রাখা না হলেও মঞ্চের পেছনে বাঁ থেকে ভারত, ইতালি, বাংলাদেশ, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকায় স্মরণ করা হয় তাদের সবাইকে।মঞ্চের সামনে কালো কাপড়ের ওপর সাদা হরফে লেখা ছিলো,‘হলি আর্টিজান বেকারিতে নিহতদের জন্য বাংলাদেশের মানুষ গভীরভাবে শোকাহত। মৃতদেহ হস্তান্তরের পর বেলা ১২টা পর্যন্ত এই শ্রদ্ধা অনুষ্ঠানে সর্বস্তরের জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল এ সময় বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। দলের জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, রুহুল কবির রিজভী, মাহবুবউদ্দিন খোকন, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, আনহ আখতার হোসেন ও শায়রুল কবীর খান এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন।ইতালির নয়জন: নাদিয়া বেনেদিত্তো, ভিনসেনজো দ আলেস্ত্রো,ক্লদিও মারিয়া দান্তোনা, সিমোনা মন্টি, মারিয়া রিবোলি, আডেলে পুগলিসি, ক্লদিও চাপেলি, ক্রিস্টিয়ান রোসিস ও মারকো তোনডাট।
সাত জাপানি: স্বজনদের অনুরোধে তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। সাত জাপানির মধ্যে ছয়জন মেট্রোরেল প্রকল্পের সমীক্ষা কাজে নিয়োজিত ছিলেন।একজন ভারতীয়: তারিশি জৈন।তিন বাংলাদেশি: ইশরাত আখন্দ, অবিন্তা কবীর ও ফারাজ হোসেন।দুই পুলিশ: রেস্তোরাঁয় হামলার পরপরই সেখানে আটকেপড়াদের উদ্ধারে গিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি সালাউদ্দীন হামলাকারীদের বোমার স্প্লিন্টারে নিহত হন।ওই ঘটনার পর শনিবার রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের উপর আস্থা রাখুন। ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব আমরা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র ঠেকাতে জনগণকে সক্রিয় হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।