ড. আতিউর রহমান

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় বৈশ্বিক আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থার ত্র“টিকে দায়ী করেছেন সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। একইসঙ্গে এ ঘটনা তার কোনো ভুল পদক্ষেপের ফলে ঘটেনি বলেও দাবি করেন তিনি।আতিউর রহমানের মতে, এমন সাইবার অপরাধের পেছনে বৈশ্বিক আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থার ত্রুটিকেই অভিযুক্ত করা উচিত। ঢাকায় নিজ বাড়িতে নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎর ড. আতিউর রহমান এসব কথা বলেন।তিনি আরও বলেন, পুরো ব্যবস্থার ব্যর্থতা।আর্থিক কাঠামোর কোনো একটি অংশের ত্র“টির জন্য বাংলাদেশকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।এজন্য সাবেক এই গভর্নর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ককে দোষারোপ করেন, যেখানে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ জমা রাখে।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে নিজ ব্যাংক হিসাব থেকে ৫০০ ডলার তুলতে চাইলেও অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। কিন্তু এখানে কোটি কোটি ডলার চলে যাচ্ছে, আর কোনো প্রশ্নই করা হচ্ছে না। নিউইয়র্ক ফেডের উচিত ছিল তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বা এমন কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা। আতিউর রহমান জানান, এক বছর আগে ব্যাংকের তহবিলের নিরাপত্তা জোরদারের জন্য তিনি একটি সাইবার সিকিউরিটি ফার্ম নিযুক্ত করতে বলেছিলেন। কিন্তু সে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করা হয় চুরির ঘটনার পর। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এ বিলম্ব ঘটেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক, কোম্পানি ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান দুর্বলতাকে সামনে হাজির করেছে। অপরাধীরা এ চুরির ঘটনায় আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত বার্তাকেন্দ্র সুইফটকে ব্যবহার করেছে।সুইফট বার্তার মাধ্যমে অপরাধীরা নিউইয়র্ক ফেড থেকে অর্থ সরিয়ে নিতে সমর্থ হয়। এ ঘটনার পর সুইফটের পক্ষ থেকে একই পদ্ধতিতে বিশ্বের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে অর্থ চুরির একাধিক প্রচেষ্টার কথা জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষেত্রে অপরাধীরা প্রায় ১০০ কোটি ডলার চুরির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পরিচয় ব্যবহার করে। এর মাধ্যমে তারা নিউইয়র্ক ফেড থেকে বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের নির্দেশনা পাঠায়।এ প্রক্রিয়ায় তারা ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনে স্থানান্তরে সমর্থ হয়, যা শেষ পর্যন্ত দেশটির কয়েকটি ক্যাসিনোয় প্রবেশ করে। এ অর্থের অধিকাংশই এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।নিউইয়র্ক ফেডের এক মুখপাত্রের সঙ্গে ড. আতিউরের বক্তব্য সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি চুরির ঘটনাটি প্রতিষ্ঠানটির কম্পিউটারে হ্যাকিংয়ের কারণে ঘটেনি বলে জানিয়েছেন।

কয়েকজন বিশেষজ্ঞর মতে, চুরির ঘটনাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব দুর্বলতার কারণে ঘটেছে। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবহৃত রাউটারটির দাম ছিল মাত্র ১০ ডলার। আর এতে ছিল না কোনো ফায়ারওয়াল ব্যবস্থা।কিন্তু ব্যাংকটির ডিজিটাল নিরাপত্তা দুর্বল ছিল, এমন দাবি খারিজ করে দিয়েছেন ড. আতিউর।

তিনি বলেন, সাইবার নিরাপত্তাকে আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এক বছর আগেই আমি নিরাপত্তার বিষয়টিকে ভবিষ্যৎ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে, এটি এখন উন্নত করা হচ্ছে।আতিউর রহমান আরও জানান, চুরির ঘটনার আগে ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা পরামর্শক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ফায়ারআইয়ের মালিকানাধীন ম্যানডিয়ান্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ঘটনা সংঘটনের আগে ম্যানডিয়ান্ট পুরোপুরি যোগ দিতে পারেনি।

এদিকে সুইফট কর্মকর্তারাও এ ঘটনায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে, সংস্থাটির গ্রাহক তাদের নিজস্ব সিস্টেমে হ্যাকিংয়ের ঘটনা শনাক্ত ও তা সংস্থাটিকে জানাতে দেরি করছে। আরেকটি ঘটনায় তো হামলা সম্পর্কে পুরোপুরি জানাতেই ব্যর্থ হয়েছে গ্রাহক।যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের কর্মকর্তাদের সুইফট প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, যেসব ব্যাংক নূন্যতম সাইবার নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে সমর্থ্য নয়, তাদের নেটওয়ার্ক থেকে সরিয়ে ফেলাই উত্তম। বলার অপেক্ষা রাখে না, এমন সিদ্ধান্ত বিশ্বের একটি নির্দিষ্ট অংশকে প্রান্তের দিকে ঠেলে দেবে।

সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন বা সুইফটের মুখপাত্র ড. আতিউরের সাম্প্রতিক মন্তব্য সম্পর্কে কিছু বলতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেছেন, বিস্তৃত আর্থিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত কোনো নির্দিষ্ট গ্রাহকের নিরাপত্তা দুর্বলতা থাকলে তা ওই ব্যবস্থার অন্য গ্রাহকদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর অর্থ হচ্ছে, নিরাপত্তা হালনাগাদকরণের পাশাপাশি তা জোরদারে গোটা খাতেরই এগিয়ে আসা উচিত।ড. আতিউর বলেন, একটি তদন্ত চলমান। আর সম্ভবত বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকে কোনো অবহেলা থেকে থাকবে। কিন্তু তিনি নিজে কোনো ভুল কাজ করেননি বলে দাবি করে আতিউর রহমান বলেন, গভর্নর হিসেবে ছোট-বড় সবকিছুর দিকে নজর রাখা আমার কাজ নয়। হয়তো কারও পাসওয়ার্ড চুরি হয়ে থাকবে। এ ব্যর্থতা সংশ্লিষ্ট বিভাগের; গভর্নরের নয়।

তিনি বলেন, এটি ছিল একটি বড় হামলা। অনেকটা রিখটার স্কেলে ১৫-এর মতো। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জায়গাও বাংলাদেশকে সতর্ক ও সাহায্য করতে পারত। আপনি ভাবতেও পারবেন না, আমি কতটা আহত হয়েছি। ব্যাংকের অভ্যন্তরের কেউ অপরাধীদের সহায়তা করেছে, এমন অভিযোগ সম্পর্কে সাবেক এই গভর্নর বলেন, যদি এমন কোনো অপরাধী থাকে, তবে তাকে ধরুন। কিন্তু কারণ ছাড়া কাউকে অভিযুক্ত করবেন না।

চুরির ঘটনার পর ব্যাংকের বৃহৎ স্বার্থ বিবেচনা করে তিনি পদত্যাগ করেন বলে জানান। একইসঙ্গে এ ঘটনার পর নিজের গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, চুরির ঘটনাটি তিনি সরকারের কাছে এক মাস গোপন রেখেছিলেন। এ সম্পর্কে আতিউর রহমান বলেন, আমি দেশের আর্থিক খাত ও ভাবমূর্তি রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। এটি একটি ভুল হতে পারে। কিন্তু এটি কোনো অপরাধ ছিল না। আমাকে কৌশলগতভাবে এতটা দক্ষ ভাবা উচিত নয়, যাতে আমি ঘটনার শুরু থেকেই জানব যে, কী ঘটতে যাচ্ছে।অর্থ চুরির জন্য অপরাধীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পরিচয় ব্যবহার করে নিউইয়র্ক ফেডে অর্থ স্থানান্তর নির্দেশনা পাঠায়। পুরো চুরির ঘটনায় সময়কে ব্যবহার করা হয় দারুণভাবে। বাংলাদেশে চুরির ঘটনাটি ঘটে বৃহস্পতিবার, দেশটির ছুটির আগের দিন। শনিবার যখন কর্মীরা এ লেনদেন সম্পর্কে জানতে পারেন, তখন তারা নিউইয়র্ক ফেডের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন, যা ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে।

ড. আতিউর দাবি করেন, নিউইয়র্ক ফেড ওই অর্থ স্থানান্তর নির্দেশনাগুলো ঠিকমতো যাচাই করে দেখেনি। ফেডের দিক থেকে ভয়াবহ অদক্ষতার পরিচয় দেয়া হয়েছে। আমরা ই-মেইল, ফ্যাক্স পাঠাচ্ছি, অথচ অন্য প্রান্ত থেকে কেউ সাড়া দিচ্ছে না। আমাদের একটি হটলাইন প্রয়োজন।