‘বিদেশ যাচ্ছি’ বলে পাঁচ দিন আগে ঢাকার বাড়ি ছেড়েছিলেন গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম, যাকে মাদারীপুরে শিক্ষককে কুপিয়ে জখমের পর ঘটনাস্থলে আটক করে জনতা। গত এক বছরে লেখক, প্রকাশক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, অধ্যাপকদের যেভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেই কায়দায়ই বুধবার হামলা হয়েছিল মাদারীপুরের সরকারি নাজিমউদ্দিন কলেজেন গণিতের শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর উপর।
রিপনের সঙ্গে কারও শত্রুতা না থাকা এবং হামলার ধরন দেখে এটাকেও ‘টার্গেট কিলিং’য়ের চেষ্টা মনে করছেন গোয়েন্দারা। তবে ঢাকার উত্তরার দক্ষিণ খানে ফাহিমের বাড়ির প্রতিবেশী ও শিক্ষকরা বলছেন, নিভৃতচারী নামাজি এই তরুণ যে উগ্রপন্থায় জড়িয়ে পড়তে পারেন, তাকে দেখে তা তাদের মাথায় কখনও আসেনি। এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ফাহিম গত ১১ জুন সকালের পর থেকে নিখোঁজ বলে দক্ষিণ খান থানায় তার বাবা গোলাম ফারুকের করা এক সাধারণ ডায়েরি থেকে জানা যায়।
দক্ষিণ খান থানার এসআই আবুল কালাম আজাদ ওই জিডি উদ্ধৃত করে বৃহস্পতিবার দৈনিকবার্তাকে বলেন, “ফাহিম তার বাবার মোবাইল ফোনে এসএমএস করে বলেছিল- বিদেশ চলে গেলাম, এছাড়া কোনো উপায় ছিল না। বেঁচে থাকলে আবারও দেখা হবে।”
ফাহিমের বাবা ফারুক একটি গার্মেন্টের কর্মকর্তা, মা কামরুন নাহার গৃহিনী। এক ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়ে দক্ষিণ খানের ফায়েদাবাদ এলাকার একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন তারা। পুলিশ কর্মকর্তা আজাদ বলেন, জিডির পর থেকে পুলিশ ফাহিমের সন্ধানে কাজ করে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই বুধবার মাদারীপুরে তার গ্রেপ্তার হওয়ার খবর আসে। তবে কেন ফাহিম মাদারীপুর গেলেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য কেউ দিতে পারেননি।
১৮ বছরের ফাহিম উত্তরা হাই স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। তবে রসায়ন বিজ্ঞানের পরীক্ষা না দিয়েই অন্তর্ধাণ হন তিনি। ফাহিমের শ্রেণিশিক্ষক প্রভাষক আফরিন আক্তার দৈনিকবার্তা কে বলেন, “ছেলেটা খুব মেধাবী ছিল। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পাবে বলে মনে হচ্ছিল।
“রসায়ন পরীক্ষার দিন ওর মা আমাকে ফোনে জানিয়েছিল, ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে পত্রিকায় ওর ছবি দেখে প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি, ফাহিম এত খারাপ কিছু করতে পারে।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই তরুণের আচরণ কেমন ছিল- জানতে চাইলে শিক্ষক আফরিন বলেন, “ক্লাস ও পরীক্ষায় নিয়মিত ছিল। কারও সঙ্গে কখনও কোনো বিবাদ ছিল বলে জানতাম না। খুব চুপচাপ থাকত।”
ফাহিম হিযবুত তাহরীরের মতো নিষিদ্ধ কোনো সংগঠনে জড়িত ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোতে জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জড়িত থাকার তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে থাকলেও সম্প্রতি হিযবুত তাহরীরের গোপন প্রচার দেখা যাচ্ছে নানা স্থানে। তবে ফাহিম কোনো উগ্রপন্থি সংগঠন করতে পারে, সে রকম সন্দেহ কখনও হয়নি বলে জানান তার শিক্ষক আফরিন। বৃহস্পতিবার ফাহিমের বাসায় গেলে তার ফ্ল্যাটের ভেতরে কয়েকটি পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেলেও কেউ সাড়া দেননি। কড়া নাড়ার পর ভেতরে থেকে ‘কে’ প্রশ্নে ‘সাংবাদিক’ উত্তর দেওয়ার আধা ঘণ্টায়ও কেউ দরজা খোলেননি।
ওই সময় বাড়ির সামনে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস ছিল। গাড়ির চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিকবার্তা কে বলেন, “মাদারীপুর সদর থানার ওসি ও ডিবি পুলিশ পুরো বাড়ি তল্লাশি করছেন।” তারা ফাহিমের ব্যবহার করা কম্পিউটারটি নিয়ে গেছে।”
মাদারীপুরে হামলায় তিন যুবক ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়। অন্যদের ধরতে আটক ফাহিমকে নিয়ে অভিযান চলছে বলে মাদারীপুর সদর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুখদেব রায় সকালেই জানিয়েছিলেন। ফাহিম সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিবেশী মঞ্জুরুল বলেন, “ছেলেটা কখনও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলত না, মাথা নিচু করে চলাফেরা করত। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়ত।
“দেড় বছর হল ওরা এখানে, কিন্তু ওর কোনো বন্ধুকে বাসায় আসতে দেখিনি। এলাকায়ও তেমন বের হত বলে শুনিনি।”
ফাহিমের পাশের ফ্লাটের বাসিন্দা রেবা চৌধুরী বলেন, “ফাহিমের ছবি পত্রিকায় দেখার পর ওকে চিনতে পারি। ধারণাই ছিল না, পাশের বাসাতেই এমন কেউ থাকতে পারে।” এদিকে মাদারীপুরে হামলার শিকার শিক্ষক রিপন চক্রবর্তী এখন আশঙ্কামুক্ত বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।