সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৪-দলীয় জোটে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) অবস্থান নিয়ে অন্ধকারে আওয়ামী লীগের নেতারা। জাসদ নিয়ে হঠাৎ দলের সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যের পেছনের কারণ খুঁজছেন দলটির নেতারা। এই বক্তব্য দলের, না ব্যক্তিগত, এ ব্যাপারে কোনো ধারণাও করতে পারছেন না তাঁরা। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো বক্তব্য না দেওয়া পর্যন্ত জাসদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অবস্থান ধোঁয়াশাই থাকবে বলে তাঁদের ধারণা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর দুজন সদস্য ও উপদেষ্টা পরিষদের তিনজন সদস্যদের সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা বলেন, সৈয়দ আশরাফ ‘ফাও’ কথা বলেন না। আগ বাড়িয়ে অতিরিক্ত কোনো কথাও বলেন না। হঠাৎ মুখ ফসকে একটা কথা বলে ফেলার মানুষও সৈয়দ আশরাফ নন। তাই তাঁদের ধারণা, এই বক্তব্য কোনো না কোনো ইঙ্গিত বহন করে। হয়তো তাৎক্ষণিক কোনো পরিবর্তন চোখে না পড়লেও জাসদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ অন্য কিছু ভাবছে বলে মনে হচ্ছে। ওই নেতারা বলেন, আপাতত এখন সবাইকে প্রধানমন্ত্রীর দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে। এদিকে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ক্ষেত্র তৈরিতে জাসদকে দায়ী করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ঐক্য বিনষ্ট করবে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির একাংশের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আক্তার।মঙ্গলবার রাজধানীতে এক সমাবেশে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে যখন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, হাসানুল হক ইনু যখন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘেষণা করেছেন, ঠিক সেই মুহূর্ত সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্য জাতীয় ঐক্যকে বিনষ্ট করবে।আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সভায় পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ক্ষেত্র তৈরিতে জাসদ দায়ী করে এ দল থেকে মন্ত্রী বানানোর জন্য আওয়ামী লীগকে আজীবন প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হবে বলে বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।হঠকারী দল জাসদ থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের দেন এই ছাত্র সংগঠনটির সাবেক নেতা আশরাফ। সমাবেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কথায় সমাবেশে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে জাসদের অন্যতম নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আপনি আপনার মন্ত্রীকে থামান, ঐক্য বিনষ্টকারীকে থামান। আপনাকে পরিষ্কার করতে হবে, আপনি ঐক্য চান কি চান না।আপনি মুখে ঐক্যের কথা বলবেন, আর ঐক্য বিনষ্টকারীরা কাঁদা ছুড়াছুড়ি করবে। জাসদ এসব মেনে নিতে পারে না।জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে হত্যার হুমকি দেওয়ার প্রতিবাদে প্রেস ক্লাবের সামনে এই সমাবেশ হয়।ইনুকে হত্যার হুমকিদাতাদের কাপুরুষ আখ্যা দিয়ে সমাবেশে শিরিন বলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে হাসানুল হক ইনু যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, হত্যার হুমকি দিয়ে এই যুদ্ধ স্তব্ধ করা যাবে না।
তবে ১৪-দলীয় জোটের শরিক দলের কয়েকজন নেতা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ঐক্য দরকার। তখন এ ধরনের বক্তব্য জোটে অনৈক্য তৈরি করবে, যা সুবিধাবাদীদের সুযোগ করে দেবে।সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বলেন, জাসদ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারক ও বাহকের শতভাগ ভ-। সরকারে জাসদের একজনকে মন্ত্রী করার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। জাসদই বঙ্গবন্ধুকে হত্যাক্ষেত্র তৈরি করেছিল বলেও অভিযোগ করেন সৈয়দ আশরাফ।মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বিআরটিএ-এর ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, জাসদ নিয়ে তাঁর দল বা সরকারের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দলের সাধারণ সম্পাদকের এটি ব্যক্তিগত মতামত। তাই এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না।জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ উল আলম লেলিন বলেন, দলের মুখপাত্র ও সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া দেওয়া বা সেই বক্তব্য বিশ্লেষণ করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়া শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না।
জাসদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক। এই দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু সরকারের তথ্যমন্ত্রী। তা ছাড়া এর আগে ১৯৯৬ জাসদের আরেক অংশের নেতা আ স ম রবকে মন্ত্রী করে আওয়ামী লীগ।
গত বছর আগস্টে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতীয় শোক দিবসের এক আলোচনায় আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ সেলিম বলেন, জাসদই বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। স্বাধীনতাবিরোধীরা কখনো বঙ্গবন্ধুর ওপর আঘাত হানতে পারত না, যদি গণবাহিনী ও জাসদ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি করে, মানুষ হত্যা করে, এমপি মেরে পরিবেশ সৃষ্টি না করত।
সে সময় আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ৪০ বছর আগে জাসদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ওই বিতর্ক ওঠার ১০ মাস পর আবারও এই বিতর্ক সামনে আনলেন স্বয়ং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। প্রথমবার বিতর্ক শুরু হলে ওই সময় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কথা বললেও চুপ ছিলেন সৈয়দ আশরাফ। তাই এবার নিজেই বিষয়টি সামনে আনায় দলটির নেতারা মনে করছেন, এর পেছনে অবশ্যই কোনো কারণ আছে।
আজ মঙ্গলবার সংসদে আসা আওয়ামী লীগের কয়েকজন সাংসদ বলেছেন, সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্যের পর তাঁদের সঙ্গে অন্য বিষয় নিয়ে আশরাফের সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু বক্তব্যের ব্যাপারে তাঁরা জানতে চাননি। আশরাফও এ নিয়ে কথা বলেননি।
বিভেদ চায় না জাসদ ও অন্য শরিকেরা: জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সমাবেশে জাসদের (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ যখন সম্পন্ন কাজ করছি, প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে তথ্যমন্ত্রী যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তখন এই ধরনের কাদা-ছোড়াছুড়ি আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করবে; মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে দুর্বল করবে।
জাসদ আরেক অংশের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, সৈয়দ আশরাফের হঠাৎ এমন বক্তব্য শুনে আমরা বিস্মিত হয়েছি। তিনি যা বলেছেন, তা সত্য নয়, বিভ্রান্তিকর। তাঁর বক্তব্যে সত্যকে আড়াল করা হয়েছে।বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদের মতপার্থক্য থাকতে পারে, আমাদেরও আছে। মতপার্থক্য মেনে নিয়েই জোট করা হয়েছে। যখন গুপ্তহত্যা চলছে, জঙ্গিবাদের তৎপরতা চলছে, সেই সময় ঐক্য আরও বাড়া দরকার। সৈয়দ আশরাফের এই সময় জাসদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই, এটা সময়োচিত হয়নি।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসম মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের মন্তব্য ব্যক্তিগত বলে জানিয়েছেন সড়ক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, এ বিষয়ে দলীয় বা সরকারি ফোরামে কোনো সিন্ধান্ত হয়নি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে থামাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নেতারা। তাঁরা বলেছেন, এ ধরনের কাদা- ছোড়াছুড়ি ১৪-দলীয় জোটের ঐক্য বিনষ্ট করবে।দল গঠনের পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) কয়েক দফা ভাঙনের কবলে পড়ে। সম্প্রতি নেতৃত্বের কোন্দলে জাসদ আবারও ভাঙে। এক অংশের সভাপতি হাসানুল হক ইনু সরকারের তথ্যমন্ত্রী। আরেক অংশের কয়েকজন সাংসদ রয়েছেন সংসদে। দুটি অংশই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের বৈঠকে অংশ নেয় এবং একসঙ্গে কর্মসূচি পালন করে।সমাবেশে জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ যখন সম্পন্ন কাজ করছি, প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে তথ্যমন্ত্রী যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তখন এই ধরনের কাদা- ছোড়াছুড়ি আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করবে, মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে দুর্বল করবে। বরং আসুন, জঙ্গি মোকাবিলা ও নাগরিকের নিরাপদ জীবনের জন্য গুপ্তহত্যা বন্ধ করতে ১৪ দলকে আরও শক্তিশালী করি।
জাসদের নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন সৈয়দ আশরাফের উদ্দেশে বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে বলছি, আপনি থামান, আপনার এই মন্ত্রীকে থামান। এই সংকটে তিনি যে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিচ্ছেন, যে অনৈক্যের সৃষ্টি করছেন, অবিলম্বে তাঁর মুখ বন্ধ করুন। আর সৈয়দ আশরাফকে বলব, আপনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দিকে মনোযোগ দিন। আপনি কীভাবে মন্ত্রিত্ব চালান আমরা জানি, দেশবাসী জানে। আমরা তা বলতে পারি। কারণ, আমরা মহাজোটের অংশ। জনপ্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, সেখানে মনোযোগ দিন।
শেখ হাসিনার উদ্দেশে আনোয়ার হোসেন বলেন, পরিষ্কারভাবে আপনাদের বলে দিতে হবে, ঐক্য চান কি চান না। ১৪ দলের ঐক্য থাকবে কি থাকবে না? একদিকে আমাদের সভাপতি ও ১৪ দলের অন্যতম নেতার নামে বিষোদ্গার করবেন, আর অন্যদিকে জঙ্গি ঠেকাবেন, এটা হতে পারে না। আমরা মহাজোট সরকারি আছি, ১৪ দলে আছি। কিন্তু আমাদের নিজস্ব অবস্থান আছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আছে, সংবিধান আছে, জাতির জনক আছেন আমাদের সামনে। সেই বিবেচনা করেই চলি। আর ভুল করবেন না।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর জাসদের সমন্বয়ক মীর হোসাইন আখতার। সমাবেশ শেষে একটি মিছিলও বের করে জাসদ। মিছিলটি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে পুরানা পল্টন হয়ে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে গিয়ে শেষ হয়।