কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে মামলার তদন্ত সংস্থা কুমিল্লা সিআইডি। সোমবার (১৩ জুন) দুপুর সোয়া ১২টার দিকে কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুনতাহিম বিল্লাহর আদালতে এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কুমিল্লা সিআইডির পরিদর্শক গাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।গত ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসের ভিতরে একটি জঙ্গল থেকে তনুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ৪ এপ্রিল তনুর প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর লাশের দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রথম ময়নাতদন্তের মতো এ দফায়ও তনুর মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে পারেনি মেডিকেল বোর্ড।প্রায় আড়াই মাস কালক্ষেপণের পর গতকাল রোববার সিআইডিকে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দিয়েছেন এ জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান কামদা প্রসাদ সাহা। এ বিষয়ে তিনি রোববার দুপুরে তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, ১০ দিন পর কবর থেকে তোলা লাশ বিকৃত (ডিকম্পোজড) হয়ে যাওয়ায় মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা যায়নি। পারিপার্শ্বিক নানা অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে পুলিশের আরও অধিক তদন্তের মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে হবে।এর আগে ডিএনএ পরীক্ষার বরাত দিয়ে মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি বলেছিল, তনুকে হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু গতকাল জমা দেওয়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ধর্ষণের কথা উল্লেখ নেই। এতে বলা হয়েছে মৃত্যুর আগে‘যৌন সংসর্গ’ হয়েছিল।তনুর মা আনোয়ারা বেগম ময়নাতদন্তের এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডাক্তাররা মিথ্যা কথা বলেছে। তনুর পিঠে আঘাতের চিহ্ন ছিল। মাথার পেছন দিক ও নাক থেঁতলানো ছিল। কবর থেকে যখন ওর লাশ তোলা হয়, তখন সেটি ফোলা ছিল। তেমন কোনো বিকৃতি হয়নি। আনোয়ারা বেগমের প্রশ্ন, সুস্থ, সুন্দর মেয়েটি কি কোনো কারণ ছাড়াই মারা গেল? ওরে কি জিনে মেরেছে?
দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনকে ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করার দৃষ্টান্ত বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, তনুর হত্যা ও প্রথম ময়নাতদন্ত নিয়ে জনমনে নানা সন্দেহ ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে সেই সন্দেহ দূর হয়নি। মনে হচ্ছে, স্বেচ্ছায় হোক কিংবা হুমকি বা চাপের মুখে আমরা সত্য প্রকাশে কুণ্ঠিত হচ্ছি। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।
গত ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতর থেকে তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন লাশের প্রথম ময়নাতদন্ত করেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের একজন চিকিৎসক। ওই ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ওই প্রতিবেদনে তনুর মাথার জখমের কথা গোপন করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। পরে পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত মেডিকেল বোর্ড গঠন করে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করার নির্দেশ দেন।
এরপর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান কামদা প্রসাদ সাহার নেতৃত্বে তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের অপর দুই সদস্য হলেন একই কলেজের গাইনি বিভাগের প্রধান করুণা রানী কর্মকার ও ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক মো. ওমর ফারুক। ৩০ মার্চ কবর থেকে তনুর লাশ তোলার পর তাঁরা দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করেন। এরপর প্রতিবেদন দিতে কালক্ষেপণ করা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়।
দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের সময় তনুর শরীরের কিছু নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সেসব নমুনা ও তনুর পরনের কাপড় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। পরে সিআইডি জানায়, ডিএনএ ফরেনসিক পরীক্ষায় তনুকে ধর্ষণের আলামত মিলেছে। তাতে পৃথক তিন ব্যক্তির বীর্য পাওয়া গেছে। ওই তিন ব্যক্তির ডিএনএ প্রোফাইলও তৈরি করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন গত মঙ্গলবার মেডিকেল বোর্ডকে দেয় সিআইডি।
লাশ বিকৃত হওয়ার কারণে যদি মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা সম্ভব না হয়ে থাকে, যৌন সংসর্গের বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত হলেন? এ প্রশ্নের জবাবে কামদা প্রসাদ প্রথম আলোকে বলেন, ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন দেখে তাঁরা এটা নিশ্চিত হয়েছেন।
কিন্তু সিআইডি তো বলেছে, ডিএনএ প্রতিবেদনে ধর্ষণের আলামত মিলেছেÑএ কথা স্মরণ করিয়ে দিলে কামদা প্রসাদ বলেন, মেডিকেল টার্মে ধর্ষণ বলে কিছু নেই। এটা আইনি ব্যাখ্যা। ডাক্তারেরা ধর্ষণ বলে না। ডাক্তারেরা বলে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স (যৌন সংসর্গ)। আমরা কখনো ধর্ষণ বলি না।এই ব্যাখ্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রধান হাবিবুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ধর্ষণের ঘটনা হলে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে জোরপূর্বক যৌন সংসর্গ’ লেখা হয়ে থাকে।
তনুর ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে যৌন সংসর্গের যে কথা বলা হয়েছে, সেটা ধর্ষণ কি নাÑসাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে কামদা প্রসাদ বলেন, সেটা আপনারা বুঝে নিন।দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের এই অস্পষ্টতাকে খুবই হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ। তিনি গত রাতে বলেন, এতে চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, যৌন সংসর্গ আর ধর্ষণ বা বলাৎকার সম্পূর্ণ ভিন্ন। ধর্ষণ অপরাধ। ডাক্তারি ভাষা আর আইনি ভাষার বিতর্কে আমরা যেতে চাই না। আমরা চাই সত্য উদ্ঘাটন ও ন্যায়বিচার। ডাক্তারদের প্রতি অনুরোধ, নিজ পেশার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সত্য উদ্ঘাটন করুন।