পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভাপতি পদে সংসদ সদস্যদের থাকার বিধান রহিত করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেয়া রায়ের পর ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি থাকছেন না বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ রায় বহাল রাখেন। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

২০০৯ সালে রাশেদ খান মেনন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ভিকারুননিসা নুন স্কুল এ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওই কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চার বার এডহক কমিটি গঠিত হয়, যার মেয়াদ ছিলো ৬ মাস করে। এরপর এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২ বার বিশেষ কমিটি গঠিত হয়, যার মেয়াদ ছিলো ২ বছর করে। বিশেষ কমিটি ও এডহক কমিটির বৈধতার বিষয়ে রাশেদ খান মেননসহ বিবাদিদের কয়েকবার আইনী নোটিশ প্রেরণ করেন আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। এতেও কাজ না হলে তিনি উচ্চ আদালতে সভাপতি রাশেদ খান মেননসহ স্কুল কমিটির বিরুদ্ধে রিট মামলা করেন। মামলার শুনানি শেষে কয়েকবার এ বিষয়ে আদালত রুল জারি করেন। সে রুলেও সাড়া না দেয়ায় আইনী লড়াই চলে ইউনুছ আলী আকন্দের।

সর্বশেষ গত ১ জুন হাইকোর্ট এ মামলার রুল নিষ্পিত্তি করে ভিকারুননিসার নুন স্কুল এ্যান্ড কলেজের বিশষ কমিটি বাতিল, বিশেষ কমিটি গঠনের ধারা ৫০ বাতিল, এমপিরা প্রত্যেকে ৪টি স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানের ধারা ৫ বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এ আদেশের স্থগিতাদেশ চেয়ে চেম্বার আদালতে যায় ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি ও ভিকারুননিসা কর্তৃপক্ষ। চেম্বার আদালত হাইকোর্টের সে রায় স্থগিত না করে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেয়। আজ শুনানি করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। মেননের আবেদন (লিভ টু আপিল) খারিজ হয়ে যায়।

আপিল বিভাগের এ আদেশের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভাপতি পদে সংসদ সদস্যদের থাকার বিধান রহিত করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল থাকলো। তবে অভিভাবক প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হলে দায়িত্ব পালনে বাধা থাকা থাকবে না এমপিদের। আদালতের এ রায়ের ফলে ভিকারুননিসার গভর্নিং বডির সভাপতির পদে থাকতে পারছেন না মেনন। এ বিষয়ে আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ বলেন, ‘আদালতের আদেশের ফলে গত ১ জুন থেকেই এসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদে এমপিরা আইনগতও নৈতিকভাবে বৈধতা হরিয়েছেন।’

জানা যায, ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালে। ২০০৯ সালে আইন হলে ৫৩ ধারা মতে সকল কমিটি বাতিল করে শুরু হয় এডহক কমিটি ও বিশেষ কমিটি গঠনের মহড়া। ইউনুছ আলী বলেন, ‘ভিকারুননিসায় ৬ বার কমিটি, ৪ বার এডহক কমিটি ও ২ বার বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। প্রথম এডহক কমিটি গঠন হয় ২০১১ সালের ১৪ জুলাই। ২য় এডহক কমিটি গঠন হয় ২০১২ সালে। পরে এ নিয়ে হাইকোর্টে মামলা হয় এবং রুল জারি হয়। ৩য় বিশেষ কমিটি গঠিত ২ বছরের জন্য গঠিত হয়। ৪র্থ এডহক কমিটি গঠিত হয় ২০১৫ সালে (হাইকোর্টের রুল পেন্ডিং থাকাবস্থায়)। ৬ষ্ঠ বিশেষ কমিটি গঠিত হয় ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে (রুল পেন্ডিং থাকাবস্থায়)।’

ইউনুছ আলী আকন্দ বলেন, ‘এরপর ৭ম বিশেষ কমিটি গঠন বাতিলের আবেদন করি। চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারিতে। রুল হয় ১৯ জানুয়ারি।’ এরপর চলতি বছরেই এমপিদের চেয়ারম্যান পদে থাকার ধারা ৫ বিশেষ কমিটি গঠনের ধারা ৫০ এর বৈধতা চ্যালেঞ্চ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন এই আইনজীবী। রুল জারি হয় ৬ এপ্রিল। এরপর ভিকারুননিসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যাক্ষ মঞ্জু আরা বেগমকে ২ বছরের জন্য নিয়োগ দেয় সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এ নিয়োগের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্চ করে হাইকোর্টে রিট করেন ইউনুছ আলী অকন্দ। শুনানি শেষে আদালত মঞ্জু আরার চাকুরি অবৈধ ঘোষণা করেন। কিন্তু হাইকোর্টের এ আদেশ অমান্য করেন মামলার বিবাদিরা- অভিযোগ ইউনুছ আলী আকন্দের। আদেশ অমান্যকারীদের মধ্যে মঞ্জু আরা বেগম ও রাশেদ খান মেনন অন্যতম।

এর আগে ২০১৫ সালে ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ চেম্বার জজ আদালতে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন দেয়ার বিষয়ে মুচলেকা দিয়ে যান। এরপর এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলেও তারা স্কুলে নির্বাচন দেননি। এই আইনজীবী বলেন, ‘এরা বিচারপতির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।’ আজ এ মামলার লিভ টু আপিলের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ ও ভিকারুননিসার পক্ষে অংশ নেন অ্যাটর্নি‌ জেনারেল অপরদিকে আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ।

আদালত থেকে বেরিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রথমে ভিকারুননিসা নূন বিশেষ কমিটি নিয়ে রিট হয়। পরে দ্বিতীয় সম্পূরক রুল ইস্যু হয় কেন বিধির ৫ ও ৫০ বাতিল হবে না। বেসরকারি স্কুল পরিচালনা সংক্রান্ত ২০০৯ সালের যে বিধি এর ৫ ও ৫০ ধারায় সংসদ সদসদের ম্যানেজিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি উল্লেখ আছে। শেষে হাইকোর্ট বিভাগ রুলটি অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করেছেন এবং বিধির ৫ ও ৫০ বাতিল বলে ঘোষণা করেছে।’ তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের এই আদেশের বিরুদ্ধে ভিকারুননিসা নুন স্কুলের পক্ষ থেকে আপিল বিভাগে আবেদন (প্রভেশনাল লিভ পিটিশান) করেছিলাম। আপিল বিভাগ এর ওপর কোনো আদেশ দেননি। হাই কোর্টের রায়সহ লিভ পিটিশান দায়ের করলে তখন বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে জানিয়েছেন আপিল বিভাগ। হাই কোর্টের রাযের কপি পেলে আমরা স্কুলের পক্ষ থেকে নিয়মিত লিভ পিটিশান দায়ের করব।’

এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়টা যতক্ষণ পর্যন্ত স্কুল কতৃপক্ষের কাছে না কমিউনিকেট (পৌছেবে) হবে সে পর্যন্ত তো তার দিক-নির্দেশনাগুলো স্কুলের কাছে অজানা রয়ে যাবে তাই না।?’ হাইকোর্টের রায় বহাল কি না এমন প্রশ্নে মাহবুবে আলম বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়টা উনারা স্থগিত করেননি। উনারা লিভ পিটিশান দায়ের করার পরে রায়টা দেখে এ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বলেছেন।’

গত ১ জুন বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালা-২০০৯-এর ৫/১ এবং ৫০ ধারা বাতিল করে এ রায় দেন বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের বেঞ্চ। আদালত থেকে বেরিয়ে আইনজীবী ইউনুছ আখন্দ জানান, সর্বোচ্চ আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের বিষয়ে নো অর্ডার দিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকবে বলে উল্লেখ করেছেন। এর ফলে এ বিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা স্কুল-কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি থাকতে বা হতে পারবেন না । তিনি বলেন, ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রবিধানমালা ২০০৯-এর ৫ ও ৫০ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিলো। এর মধ্যে ৫ ধারা হচ্ছে এমপিদের সভাপতি পদ ও ৫০ ধারা হচ্ছে বিশেষ কমিটি গঠন নিয়ে। আদালত দু’টি ধারাই বাতিল ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করেছেন।’

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধ্যাদেশের (১৯৬১) আওতায় ‘মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালা-২০০৯ এর ৫ ধারা (গভর্নিংবডির সভাপতি মনোনয়ন) এর

(১) উপ-বিধিতে বলা হয়েছে, ‘কোনো স্থানীয় নির্বাচিত সংসদ সদস্য তার নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত বোর্ড কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এমন সংখ্যক উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতির দ্বায়িত্ব গ্রহণ করতে পারবেন’।

(২) উপ-বিধান ১ এর অধীন সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের জন্য স্থানীয় নির্বাচিত সংসদ সদস্য, তার নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত যেসব উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তার উল্লেখসহ লিখিতভাবে এ প্রবিধানমালার অধীন বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করবেন এবং এ অভিপ্রায়পত্র সংশ্লিষ্ট বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানগুলোর সভাপতি হিসেবে তার মনোনয়ন হিসেবে গণ্য হবে।

৫০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিশেষ ধরনের গভর্নিং বডি বা ম্যানেজিং কমিটি- বিশেষ পরিস্থিতিতে বোর্ড এবং সরকারের পূর্বানুমোদক্রমে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কোনো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ ধরনের গভর্নিং বডি বা ক্ষেত্রমতে ম্যানেজিং কমিটি করা যাবে’। তবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইসরাত জাহান সেদিন জানিয়েছিলেন, আদালত ম্যানেজিং কমিটিতে ইচ্ছা পোষণ করে সংসদ সদস্যদের সভাপতি হওয়ার বিধান এবং বিশেষ কমিটির বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করেছেন। এর ফলে এখন সংসদ সদস্যরা ইচ্ছে করলেই কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারবেন না। সভাপতি হতে হলে তাদের নির্বাচনের মাধ্যমে আসতে হবে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষ কমিটি করা যাবে না।

পরে ৮ জুন হাইকোর্টের ওই রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালতে আবেদন করেন রাষ্ট্রপক্ষ ও ভিকারুন্নিসা নুন স্কুলের গবর্নিং বডির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। ওইদিন স্থগিতাদেশ না দিয়ে আবেদনটি ১২ জুন শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন চেম্বার বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। এর আগে গত ১৩ এপ্রিল ওই রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব পালন এবং নির্বাচন ছাড়া কমিটি গঠন কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না-তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

এদিকে আজ এ মামলার শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্রপক্ষ ও ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পক্ষে শুনানি করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন ইউনুছ আলী আকন্দ। তিনি বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল সংবিধানের ৬৪ অনুচ্ছেদ লঙঘন করেছেন। উভয়পক্ষে শুনানি করে। অ্যাটর্নি জোরেল বার কাউন্সিলের বিধিমালাও ভঙ্গ করেছেন বলে অভিযোগ করেন এই আইনজীবী।’