07-06-16-Mayor Sayed Khokan Visit_Chokhbazar Iftar Hat-2মুসলিম উম্মার শ্রেষ্ঠ মাস রমজান। সিয়াম সাধনার মাস এটি। বিশ্ব মুসল্লিদের কাছে সংযমেরও মাস এটি। সারাদিন রোজা রাখার পর সন্ধ্যায় ইফতার নিয়ে থাকে বিশেষ আয়োজন। আর সেই আয়োজনের পসরা একদিকে যেমন ঘরোয়া পরিবেশে বিকেল থেকেই প্রস্তুত হতে থাকে অন্যদিকে বাইরের হোটেল- রেস্তোরাঁগুলোতেও বিভিন্ন আইটেমের ইফতার সাজিয়ে রাখা হয়। শুধু স্বাদেই নয়, এগুলো যেন চোখেও মুগ্ধতা ছড়ায়। মঙ্গলবার রাজধানীর পুরান ঢাকায় বরাবরের মতোই এবারও রমজানের প্রথম দিনের চোখে পড়লো ইফতারের নানা আয়োজনের চিত্র। চকবাজার এলাকায় একবার না ঘুরে গেলে বাস্তব দৃশ্যটা বুঝা যায় না। মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চকবাজার মুঘল আমলের শাহী মসজিদের সামনের পুরো রাস্তা দখল করে নিয়েছে এলাকায় সিজনাল ব্যবসায়ীরা। তারা প্রতি রমজান মাসে এ সড়ক বন্ধ করে ইফতার সামগ্রী বিক্রি করে থাকে।

জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহী চকবাজার এলাকায় ইফতারি নিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন আসে। তবে এই ইফতার বাজারের বেশির ভাগ ক্রেতা আশে পাশে এলাকার বাসিন্দারাই। এই বাজার থেকে ইফতার না নিলে যেন কেমন অপূর্ণতা থেকে যায় তাদের মধ্যে। স্থানীয় বাসিন্ধা হাজী ইসমাইল হোসেন জানান, ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইফতারির জমজমাট বাজার বসে চকবাজারের শাহি মসজিদের সামনের সড়কে। শাহ বা রাজাদের আমল থেকেই শুরু হয়েছে এই ইফতারির বাজার। দেশের দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই এই বাজারে ইফতার নিতে আসে। এবারও নতুন সাজে সেজেছে ইফতারির বাজার। এই বাজারের ইফতারের কদর দিন দিন বাড়ছে বলে জানান তিনি।

অস্থায়ী ব্যবসায়ী জানে আলম বলেন, আমার বাপ-দাদারা এই বাজারে ইফতারি বিক্রি করেছে। সেই সুবাদে আমি এখন বাজারে ২০ বছর ধরে ইফতারি সামগ্রী বিক্রি করি। সারা দেশে আমাদের চকবাজারের ইফতারির সুনাম আছে। তাই মানুষ এ বাজার থেকে ইফতারি নিতে আসে।তিনি বলেন, ‘আমরা একমাস ব্যবসা করি। যা আমাদের সারা বছর চলে। তবে রমজান মাসে অনেক সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দুই একজন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়। এতে সবার বদনাম হয়।’

ইফতার কিনতে আসা কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, আসলে বাসায় তৈরি করার চেয়ে চকবাজার থেকে ইফতার কিনে নিতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করেন তারা। এটা একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে গেছে। ইফতার কেনার জন্য প্রত্যেকের আলাদা বাজেটই থাকে। তাছাড়া প্ল্যান পরিকল্পনাও থাকে কবে কোন আইটেম দিয়ে ইফতার করা হবে।

ইফতার কিনতে এসেছেন নাজিরা বাজারের এমরান হোসেন। তিনি বলেন, আসলে এখানকার শাহী জিলাপির জন্য এসেছি। ইফতার আইটেমে শাহী জিলাপী হলে তার মজাটাই আলাদা। বিভিন্ন ইফতার সামগ্রীর আইটেমের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী বড় বাপের পোলায় খায়’, পেঁয়াজু, শাহি জিলাপি, সুতি কাবাব, জালি কাবাব, টিকিয়া, মুরগি, খাসির রোস্ট আরো বাহারি নামের ও স্বাদের কাবাব উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রয়েছে বেগুনি, আলুর চপ, ডিমের চপ, ছোলা ও ঘুগনি।

দুপুরের পর থেকে বাজারে বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে। চলবে ইফতারের পর পর্যন্ত। চকবাজারে এবার ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০টি দোকান ইফতার সামগ্রী বিক্রি করছে। এদিকে, প্রথম রোজার প্রথম ইফতারি বলে কথা। পুরান ঢাকার চকবাজারের ৭০ সার্কুলার রোডের সকল ব্যস্ততা তাই ইফতারিকে ঘিরে। মাথার ওপর বৃষ্টির বাগড়াও থামাতে পারেনি এ ব্যস্ততাকে। চকবাজারের অন্য সড়কের দোকানিদের তেমন ব্যস্ততা নই।নামমাত্র খোলা রয়েছে তাদের দোকানগুলো। তেমন কোনো বেচা-কেনা নেই। বেশকিছু দোকানে শাটারও লাগানো।

কিন্তু সার্কুলার রোড ইফতারি বেচা-কেনাকে কেন্দ্র করে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। হাজারও মানুষের জটলা। লম্বায় হাফ কিলোমিটার সড়কে কতো পদের ইফতারি তার কোনো হিসেব নেই।ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন সেখানে আসার কারণে জটলার মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। একে অন্যের সঙ্গে কথা বলার কোনো সময় নেই। তবে ইফতারি বিক্রেতারা ক্রেতাদেরকে আকর্ষণ করতে চিৎকার করে যাচ্ছেন- ‘নার্সি কাবাব ৩০ টাকা, শাহী জিলাপি কেজি ১৮০ টাকা। সড়কের ঠিক মাঝখানে বিক্রেতা জুয়েল ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে বলে যাচ্ছেন, বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙ্গায় ভইরা লইয়া যায়, ধনী-গরিব সবাই খায়, মজা পাইয়া লইয়া যায়’।

জুয়েল জানান, প্রায় ১৫ পদের ইফতার সামগ্রী দিয়ে তৈরি ইফতারির বিশেষ আইটেম বড় বাপের পোলায় খায়। এটি তৈরিতে ডিম, গরুর মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনা মরিচ, গরুর কলিজা, মুরগির মাংসের কুচি, মুরগির গিলা কলিজা, সূতি কাবাব, মাংসের কিমা, চিড়া, ডাবলি, বুটের ডাল, মিষ্টি কুমড়াসহ ১৫ পদের খাবার আইটেম ও ২৪ ধরনের মসলার প্রয়োজন হয়। খানদানি এই আইটেম প্রতি কেজি ৪০০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা আফজাল (৬৫)। গত ৪০ বছর ধওে বড় বাপের পোলায় খায়’ বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, সুধু(শুধু) আমি না। আমারা বাপে কুনু মাহাজনেও খানদানি ইফতারি বিক্রি করছে। চোখ জুড়ানো ও স্বাদে-গুণে অনন্য রকমারি ইফতারির পদ দেখতে হলে এই সার্কুলার সড়কের কোনো জুড়ি নেই। কতো আইটেমের ইফতারি বিক্রি হয় এখানের ব্যবসায়ীরাও সঠিকভাবে বলতে পারবেন না। যে কারণে অনেক কাছে ইফতারি কেনার জন্য প্রিয় সড়ক চক বাজার ৭০ নম্বর সার্কুলার সড়ক। সড়কটির নাম তাই ‘ইফতারি পণ্যের হাট’ দিলেও মন্দ হবে না।

আজিমপুর বটতলা ছাপড়া মসজিদ এলাকার বাসিন্দা কাওসার আজম। দই বড়া, শাহী জিলাপি, পনির ও মুরগিসহ প্রায় ৭০০ টাকার ইফতার কিনেছেন তিনি। কাওসার বলেন,চকবাজারের সার্কুলার সড়কে বড় হয়েছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে বছর দুয়েক আগে থেকে আজিমপুরে বসবাস করছি। প্রতি রমজানেই পরিবারের সবার জন্য চকবাজারের ইফতারি নিয়ে যাই। বিশেষ করে শাহী জিলাপি ও বড় বাপের পোলায় খায় সবার পছন্দ।

এখানে প্রতি লিটার পেস্তা বাদামের শরবত ২০০ টাকা, দই বড়া ৪০০ টাকা, শাহী বোরহানি ১২০ টাকা ও ফালুদা ১৫০ টাকা, প্রতিটি নার্গিস টিকা ৩০ টাকা, বিফ পরোটা ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকা, শাহী চিকেন পরোটা ৪০ টাকা ও প্লেইন পরোটা ২০ টাকা এবং প্রতি কেজি শাহী জিলাপি ১৮০ টাকা, সূতি কাবাব (খাসি) ৬০০ টাকা, সূতি কাবাব (গরু) ৫৫০ টাকা, কোয়েল পাখির ঝাল ফ্রাই ৯০ টাকা, চিকেন ঝাল ফ্রাই ৩০০ টাকা, খাসির লেগ ঝাল ফ্রাই ৫৫০ টাকা ও খাসির গ্রিল ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।এমনকি শসা, বড়া, টমেটো, আইসক্রিম, ঝোলা ও বিভিন্ন পদের খেঁজুরও মিলছে এ সড়কে। একদিকে বৃষ্টি, অন্যদিকে সড়কের কাদা-পানি। তারপরও ইফতারির সময় যতোই ঘনিয়ে আসছে, মানুষের ঢল ততোই বাড়ছে। ইফতারির পণ্যগুলো রোদ ও বৃষ্টি থেকে রক্ষায় সড়কজুড়ে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে পলিথিন ও সামিয়ানা।