পদ্মায় স্রোত আরও বেড়েছে। সাথে বেড়েছে কাজের গতিও। প্রকৃতির তালেই এগিয়ে চলেছে সেতুর কাজ। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই রাতদিন চলছে এ কাজ। নদী ভাঙ্গন রোধেও নেয়া হচ্ছে নানা সর্তকতা। মাওয়া প্রান্তের উজানে স্রোতের কারণে নদী ভাঙ্গন দেখা দিতে পারে এমন শঙ্কা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। তাই পদ্মাসেতু কৃর্তপক্ষ মাওয়া পুরনো ফেরিঘাট থেকে কান্দিপাড়া পর্যন্ত ১৩শ’ মিটার এলাকায় নদী ভাঙ্গন রোধে জিও ব্যাগ ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। এই বাবদ প্রায় ৩৯২ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দেয়া হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানের এই এলাকায় প্রায় ১ লাখ জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। তবে এটি প্রয়োজনের তুলনায় কম বলে অনেকে মনে করছেন। দেশের বৃহত্তর এবং মর্যাদাপূর্ণ পদ্মা সেতু প্রকল্পটি সুরক্ষায় নদী ভাঙ্গন রোধে কার্যকরী ব্যবস্থা জরুরী। কারণ বৈচিত্র্যময় পদ্মাকে পোষ মানিয়ে নিতে না পারলে সমস্যা সৃষ্টি হবে। এদিকে মাওয়া প্রান্তে পদ্মাসেতুর নদী শাসনের ডাম্পিং চলবে ৩০ মে পর্যন্ত। মূল পদ্মা বহমান এখন মাওয়া দিয়ে। তাই প্রবল স্রোতের কারণে নদী শাসনের কাজ অপেক্ষাকৃত কম স্রোতের কাওড়াকান্দি এবং কাঠালবাড়ি এলাকায় চলছে।
প্রথম দাফায় প্রায় সাড়ে ১৩ কিলোমিটার নদী শাসনের পরিকল্পনা ছিল মাওয়া প্রান্তে। তবে এটি কমিয়ে পরে দেড় কিলোমিটার করা হয়। তবে অপর প্রান্তের জাজিরায় সাড়ে ১২ কিলোমিটার এলাকায় নদী শাসন বহাল আছে। তবে ভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে হলেও নদী ভাঙ্গনরোধে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে দায়িত্বশীল এক প্রকৌশলী মনে করছেন। মাওয়া থেকে জসলদিয়া, কান্দিপাড়া ও কবুতরখোলা পর্যন্ত এই নদী শাসন জরুরী। জসলদিয়া বাজারের সামনে নদী ভাঙ্গণ দেখা দিয়েছে। এতে জসলদিয়া গ্রামের মাঝি বাড়ির একাংশ বিলীন হয়েছে। হুমকীর মুখে রয়েছে জসলদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, ডাকঘর, কমিউনিটি ক্লিনিক, জসলিদিয়া পদ্মাসেতু পূনবাসন কেন্দ্র ও ওয়াসার জসলদিয়া পানি শোধনাগারসহ বাড়ি-ঘর ফসলী জমি এবং বহু সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
পদ্মাসেতুর মূল পাইল ড্রাইফ হচ্ছে না সিদ্ধান্তের কারণে। টেস্ট পাইল ও ট্রায়াল পাইলের রেজাল্ড অনুযায়ী কনসাল্টেন্টরা ডিজাইন তৈরি করছে। এই ডিজাইন হওয়ার পরপরই ৩৮ নম্বর পিলারে পাইল ড্রাইভ হবে। শুধু সিদ্ধান্তে অপেক্ষায় রয়েছে। তবে শিগগিরই এই সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে। এরপরই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষামতার হ্যামারটি বিশাল পাইলগুলো প্রবেশ করাবে মাটির তলদেশে। এ পর্যন্ত ১১টি মূল পাইল স্থাপন হয়েছে। মূল সেতুর ২৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তবে টার্গেট অনুযায়ী ৩ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে। নানা চ্যালেঞ্জের কারণেই এমনটি হয়েছে। তবে এটি ওভারকাম করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে উচ্চ ক্ষমতার হ্যামারটি আসার পরই মূল সেতুর কাজে বাড়তি গতি আসবে।
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা সম্প্রতি জানান, অগ্রগতি আশানুরূপ। কখনও কখনও টার্গেটের পেছনে বা আবার আগে হতেই পারে। এতে কোন সমস্যা হবে না বলে তারা মনে করছেন। টার্গেট রয়েছে ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর নাগাদ শেষ হবে পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ের সেতুটি ঘিরে তাই নতুন নতুন সম্ভবনা দেখা দিচ্ছে। এই সেতুর পাশেই পদ্মার চরে অলিম্পিক ভিলেজ করার পরিকল্পনা এগিয়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক মানের এ অলিম্পিক ভিলেজের হংকং ও সিংঙ্গাপুর আদলের শহরের তৈরিরও পরিকল্পনা চলছে। চলছে পদ্মাসেতু প্রকল্প এলাকার পরিবেশ সংরণের জন্য প্রাণী জাদুঘর করার কাজ। এই জাদুঘরের পাশাপাশি একটি প্রজাপতি পার্কও স্থাপন করা হবে। প্রকল্প এলাকার জীববৈচিত্র ঠিক রাখতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগ। এরই মধ্যে সেতু কর্তৃপক্ষ ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগের মধ্যে এ স¤পর্কিত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। স¤পন্ন হয়েছে একটি জরিপও। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাণী জাদুঘর ও প্রজাপতি পার্ক স্থাপনে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্যে এই প্রাণী জাদুঘর ও পার্কটি হবে দৃষ্টিনন্দন। এটি পদ্মাসেতু প্রকল্পেরই একটি অংশ। এর বাস্তবায়নে সময় ধরা হয়েছে পাঁচ বছর। জাদুঘর ও প্রজাপতি পার্কের জন্য ইতোমধ্যে স্থান নির্ধারণ হয়েছে। এর আগে গাজীপুরের ভাওয়ালে ন্যাশনাল পার্কের প্রজাপতি পার্কের আদলেই এ প্রজাপতি পার্ক স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া এর আগে যমুনা ব্রিজ নির্মাণের সময় ওই এলাকায় একটি প্রাণী জাদুঘর স্থাপন করা হয়। কিন্তু সেটির কলেবর ছোট। এবার পদ্মাসেতু প্রকল্প এলাকায় দেশের সর্ববৃহৎ প্রাণী জাদুঘর এবং প্রজাপতি পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে।
পদ্মাসেতু নির্মাণে বাস্তবে যে কত রকমের কাজ চলছে তা এলাকায় এলেই আচ করা যায়। অনেক কাজ এখনও দৃশ্যমান হয়নি। নির্মাণকাজের সঙ্গে স¤পৃক্ত কর্মকর্তারা জানান, স্বপ্নের পদ্মাসেতু নির্মাণে দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন দেশী-বিদেশী প্রকৌশলীরা। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য দ্বিতলবিশিষ্ট এই সেতু শুধুর দেশের দক্ষিণ ও পঞ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা নয় গোটা দেশের ভাগ্য বদলে দিবে এমন আশা নিয়েই শ্রমিকরা এখানে কাজ করছে। আর দক্ষিণ-পঞ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে আরও আধুনিক শিল্পকারখানা গড়ে উঠার অপরা সম্ভবনা দৃশ্যমান হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক উদ্যোক্তা এই সেতুকে ঘিরে নানা পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। পিলারের ওপর বসবে সেতুর স্ল্যাব ও ট্রাস। চীনে স্ল্যাব ও ট্রাস বানানোর কাজও এগিয়ে চলছে। পিলার বানানোর কাজ শেষ হলে স্ল্যাব ও ট্রাস জুড়ে দেয়া হবে। তাই প্রথমেই সেতুর ৪২টি পিলার তৈরি করা হচ্ছে। সাথে পুরোদমে চলছে ভয়াডকের কাজও। চার লেনবিশিষ্ট মূলর চওড়ায় ২২ মিটার। সেতুটিতে মোট ৪১টি স্প্যান (অংশ) থাকছে, যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। স্প্যান বড় হওয়ার কারণে রিইনফোর্সড কংক্রিট দিয়ে তৈরি না করে ওজন কমাতে এই সেতুটির মূল অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে স্টিল দিয়ে। তীব্র বায়ুপ্রবাহ ও ভূমিক¤পজনিত ধাক্কা মোকাবেলায় বেছে নেওয়া হয়েছে ওয়ারেন ট্রাস ফর্ম। পুরো সেতুটির ভার বহন করার জন্য থাকছে ৪২টি পিয়ার (পিলার), যার প্রতিটির নিচে থাকছে গড়ে প্রায় ৬টি পাইল।