sonalibankhack-thenewscompany

তিন বছর আগে ভুয়া সুইফট মেসেজের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের আড়াই লাখ ডলার হাতিয়ে নেওয়ার সেই প্রায় ভুলে যাওয়া ঘটনার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির কোনো যোগাযোগ আছে কি না- পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।সোনালী ব্যাংক হ্যাক করে অর্থ চুরির সেই ঘটনার পেছনে কারা ছিল, তা জানতে পারেনি পুলিশ। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেই অর্থ উদ্ধারও করতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি তদন্ত করতে গিয়ে একই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালি ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। সুইফটের কোড ব্যবহার করে সরকারি বাণিজ্যিক এ ব্যাংক থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মূদ্রায় ১ কোটি ৯৬ লাখ প্রায়) তুলে দেয় দুর্বৃত্তরা। ২০১৩ সালে এ চুরি হলেও তা এতদিন ছিল ফাইলবন্দি।২০১৩ সালের অর্থচুরির ঘটনা ২০১৪ সালের ফেব্র“য়ারিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তখনকার সচিব এম আসলাম আলম সোনালী ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে প্রকাশ করেন। তবে ঠিক কীভাবে এই চুরি হয়েছিল তা জানাননি তিনি। ফলে বিষয়টি নিয়ে ততটা আলোচনা হয়নি তখন। বিশ্বজুড়ে আলোড়িত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি তদন্তে নেমে ফের আলোচনায় আসে সোনালি ব্যাংকের এ জালিয়াতি। দেশের কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সুইফট কোড ব্যবহার করে টাকা তুলে নেয়ার এটাই প্রথম ঘটনা ছিল।

রিজার্ভ চুরি তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বুধবার (২৫ মে) এ খবর প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। রিপোর্টে বলা হয়, রিজার্ভ চুরির মতোই সুইফট ম্যাসেজিং প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে অর্থ পরিশোধের ভুয়া অনুরোধ পাঠানো হয়েছিল। এ টাকা তুরস্কের একাধিক ব্যাংকে পাঠানোর আদেশ দেয়া হয়। সে অনুয়ায়ী, টাকা চলে যায় তুরস্কের ব্যাংকে। সেখান থেকে সে টাকা তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা।সুইফট কোর্ড ব্যবহার করে এ পর্যন্ত বিশ্বের তিন দেশের তিন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা জানাজানি হয়। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ইকুয়েডরের বাংকো দেল অসট্রো, ২০১৪ সালে ডিসেম্বরে ভিয়েতনামের থেইন হং ব্যাংক, ২০১৫ সালের ৫ ফেব্র“য়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক খেকে বিপুল অংকের টাকা তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা।প্রতিবেদনে বলা হয়, চুরির সংঘটনের পর পরই সুইফটকে অবহিত করেছে সোনালি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটির পক্ষ থেকে এ নিয়ে সোনালি ব্যাংককে এ পর্যন্ত অভিযোগের কোনো ফলোআপ জানানো হয়নি। ফলে চুরির তিন বছরেরও ওই টাকা উদ্ধার হয়নি। এমনকি বিপুল অংকের এ টাকা উদ্ধারে কোন উদ্যোগও নেয়নি সোনালি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।রাষ্ট্রায়ত্ত এ বাণিজ্যিক ব্যাংকের তথ্য প্রযুক্তি বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সুইফটের কোড ব্যবহার করে সোনালি ব্যাংকের টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। দুর্বৃত্তরা ব্যাংকের একটি কম্পিউটারে সফটওয়্যার সংযোগ করে টাকা তোলার গোপন সুইফট কোড সংগ্রহ করে। পরে ওই কোড ব্যবহার করে টাকা হস্তান্তরে ভুয়া আদেশ পাঠিয়ে তুরস্কে টাকা পাঠায়।

বিপুল অংকের এ টাকা চুরির পর এতে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এমনকি ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও আনা হয়নি।

সোনালি ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক প্রদীপ কুমার দত্ত বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, দুর্বৃত্তরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এ পর্যন্ত চুরির কোনো টাকা উদ্ধার সম্ভব হয়নি।’উল্লেখ্য, গত ৫ ফেব্র“য়ারি নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে গচ্ছিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট থেকে সুইফট সিস্টেমে প্রতারণামূলক নির্দেশনা পাঠিয়ে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা। এর ৮১ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হয় ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকের মাকাতি সিটির জুপিটার শাখার ক্যাসিনো জাংকেট কিম অংয়ের অ্যাকাউন্টে। পরে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে চলে আরো চার ব্যবসায়ীর অ্যাকাউন্টে।বাকি ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাঠানো হয় শ্রীলংকার সেচ্ছাসেবী সংগঠন শালিকা ফাউন্ডেশনের অ্যাকাউন্টে। প্রাপকের নামের বানানে ভুল থাকায় ওই টাকার পেমেন্ট আটকে দেয় ব্যাংক কর্মকর্তারা। পরে সেটি ফিরিয়েও আনা হয়।ঘটনার এক বছর পর ২০১৪ সালের ফেব্র“য়ারিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তখনকার সচিব এম আসলাম আলম সোনালী ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে ওই ঘটনা প্রকাশ করার আগ পর্যন্ত বিষয়টি বাংলাদেশের মানুষের কাছেও অজানা ছিল।

রয়টার্সেরএক প্রতিবেদনে বলা হয়, সোনালী ব্যাংকের ঘটনাতেও সুইফট ম্যাসেজিং প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে অর্থ পরিশোধের ভুয়া অনুরোধ পাঠিয়ে সারা হয়েছিল চুরি। বাংলাদেশের বাইরে এ বিষয়টি নিয়ে সে সময় তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। ফেব্র“য়ারিতে একই কায়দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে বিশ্বের অন্যতম বৃহত সাইবার চুরির ঘটনাটি ঘটার আগে সোনালী ব্যাংকের মামলা একপ্রকার হিমঘরেই ছিল। সোনালী ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানিয়েছে, ২০১৩ সালের সেই চুরির বিষয়টি সুইফট কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও তুরস্কের এক অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলা সেই টাকা আর উদ্ধার করা যায়নি।সোনালী ব্যাংকের আইটি ব্যবস্থাপনায় যুক্ত এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স লিখেছে, ওই ঘটনায় হ্যাকাররা ব্যাংকের কোনো একটি কম্পিউটারে কি লগার সফটঅয়্যার বসিয়ে পাসওয়ার্ড চুরি করে। পরে সেই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেই ভুয়া সুইফট মেসেজ পাঠানো হয়।বিষয়টি ধরা পড়ার পর অর্থ লেনদেনের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে থাকা দুই কর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছিল। কিন্তু পরে আর তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি, ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল দুজনকেই।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত রয়টার্সকে বলেছেন, সেই হ্যাকিংয়ে জড়িতরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। চুরি যাওয়া টাকা উদ্ধারের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। আসলে ঠিক কী ঘটেছিল, তাও আমরা জানতে পারিনি, বলেন তিনি।রয়টার্স জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির কৌশলের সঙ্গে মিল থাকায় এ ঘটনার তদন্তে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা সোনালী ব্যাংকের ঘটনাটি নতুন করে খতিয়ে দেখতে শুরু করেন। দুই ঘটনার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি না, সে বিষয়টিও তারা বোঝার চেষ্টা করছেন।পুলিশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, এটা ইন্টারেস্টিং। এটা আমাদের দেখতে হবে।এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরি নিয়ে বিশ্বজুড়ে তোলপাড়ের মধ্যে নতুন করে আলোচনায় ইকুয়েডরের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। দেশটির বাংকো দেল অস্ট্রো থেকে ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট) ম্যাসেজিং সিস্টেম ব্যবহার করে ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তুলে নেয় জালিয়াত চক্র। বাংকো দেল অস্ট্রো থেকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ১০ দিনের ব্যবধানে ১২টি আদেশে এ টাকা তুলে নেয়া হয়। চুরির ৯ মিলিয়ন পাঠানো হয় হংকংয়ের বিভিন্ন ব্যাংকে। বাকি ৩ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হয় লস অ্যাঞ্জেলস ও দুবাইয়ের একাধিক ব্যাংকে। এর মধ্যে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লস অ্যাঞ্জেলস এবং ১ মিলিয়ন দুবাইয়ের একটি ব্যাংকে।

জালিয়াতির এক বছর পর আদালতে মামলার সূত্রে আলোচনায় আসে বিষয়টি। চুরির এ টাকা গ্রহণ এবং বিলি-বণ্টনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হংকং ও যুক্তরাষ্ট্রে মামলা করেছে ইবাংকো দেল অস্ট্রো কর্তৃপক্ষ।মামলার আর্জিতে ব্যাংকটি বলেছে, ২০১৫ সালে জানুয়ারিতে এক ডজনেরও বেশি পেমেন্ট আদেশে ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা। হংকংয়ে নিবন্ধিত ২৩ কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এ টাকা ৯ মিলিয়ন ডলার পাঠায় জালিয়াত চক্র, যেসব কোম্পানির অধিকাংশের সেখানে দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই।এদিকে হংকংয়ে করা মামলায় দেশটির হাইকোর্টের বিচারক কনরাড সিগ্রোয়াত গত ডিসেম্বরে শুনানিতে বলেছেন, অ্যাকাউন্টে টাকা এসেছে এমন ৪ জনের ব্যবসার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথবা তাদের ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ড সক্রিয় নয়। পরে ওই চার অ্যাকাউন্টের লেনদেনের উপর স্থগিতাদেশ দেয় আদালত।

মামলার পর হংকং পুলিশ চুরি নিয়ে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে কি না সেটি পরিষ্কার নয়। এ সম্পর্কে পুলিশ বিভাগের মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ইকুয়েডরের অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ও মামলার তদন্ত নিয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। মার্কিন তদন্ত সংস্থা এফবিআই এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাংকো দেল অস্ট্রো কর্তৃপক্ষও এ নিয়ে কথা বলেনি।এ নিয়ে গত এক বছরে বিশ্বজুড়ে ব্যাংক জালিয়াতির এটি চতুর্থ ঘটনা প্রকাশ পেল। জালিয়াতরা ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট)ম্যাসেজিং সিস্টেম ব্যবহার করে এসব অপরাধ সংঘঠন করেছে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালি ব্যাংক থেকে ২০১৩ সালে ২,৫০,০০০ মার্কিন ডলার, ইকুয়েডরের বাংকো দেল অস্ট্রো থেকে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ১২ মিলিয়ন মার্কিন তুলে নেয় জালিয়াত চক্র। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে জালিয়াত চক্র ভিয়েতনামের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেও টাকা তুলে নেয়ার চেষ্টা চালায়। ওই চেষ্টা সফল হয়েছিল কি না তা স্পষ্ট করা হয়নি। হলে কত টাকা চুরি হয়েছে তাও অস্পষ্ট। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৫ ফেব্র“য়ারি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট থেকে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা।ব্যাংক জালিয়াতির এসব ঘটনায় সুইফট ম্যাসেজিং সিস্টেম ব্যবহার করেছে জালিয়াত চক্র। ব্রাসেলসভিত্তিক এ সংস্থার প্রযুক্তিতে যুক্ত রয়েছে বিশ্বের প্রায় ১১ হাজার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট থেকে চুরি, যা বিশ্বে এ যাবৎকালের ব্যাংক চুরির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা হিসেবে অভিহিত হয়ে আসছে, তা নিয়ে তদন্ত করছে মার্কিন ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এবং বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা।