21-05-16-Cox Bazar_Water Block-4

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু উপকূলজুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে। বৃষ্টির কারণে কিছুটা দুুর্বল হয়ে গেলেও এই ঝড়ে অন্তত ২৬ জন প্রাণ হারিয়েছে। এতে আহত হয়েছে অন্তত ৫০০ মানুষ। ঝড়ের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। রায়ানুর ছোবলে চরফ্যাশনের ১১৯টি পরিবার গৃহহীন হয়ে পরেছে। এসব পরিবারগুলো এখন আত্মীয়স্বজন আর পাড়াপ্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এতে দেশর বিভিন্নস্থানে ঘড়বাড়ির ব্যাপক ক্ষতির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ভেসে গেছে মাছের ঘের, লবণের মাঠ। গাছপালা, কাঁচা ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বিদ্যুত্হীন হয়ে অন্ধকারে ডুবে আছে অনেক এলাকা। রোয়ানুর প্রভাবে শুক্রবার রাত থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়। শনিবার সকাল থেকে বাতাসের গতিবেগ বাড়তে থাকে। দুপুর থেকে ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করে ঘূর্ণিঝড়টি। চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড়ের গতি ঘণ্টায় ছিল ৬২ কিলোমিটার থেকে ৮২ কিলোমিটার। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে, ১৪জন।এ ছাড়া কক্সবাজারে তিন, ভোলায় তিন, নোয়াখালীতে তিন, পটুয়াখালীতে এক, ফেনীতে এক ও লক্ষ্মীপুরে একজনের মৃত্য হয়। ঘর ও গাছচাপা, ঝড়ের সময় নৌকাচাপা ও ডুবে তাদের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ভোলায় কার্গো জাহাজ ও পিরোজপুরে নৌকা ডুবে অনেকেই নিখোঁজ । রোয়ানুর প্রভাবে শুক্রবার রাত থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়। শনিবার সকাল থেকে বাতাসের গতিবেগ বাড়তে থাকে। দুপুর থেকে ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করতে থাকে ঘূর্ণিঝড়টি। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের সঙ্গে সাগর উত্তাল হয়ে জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধ ভেঙে পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিশাল এলাকা তলিয়ে গেছে। বাঁধ ভেঙে অরক্ষিত এলাকায় জলাবদ্ধ অবস্থায় পড়েছে লাখো মানুষ। ফলে যারা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিল তারাও বাড়িতে যেতে পারছে না।

ভোলা: রোয়ানুর ছোবলে চরফ্যাশনের ১১৯টি পরিবার গৃহহীন হয়ে পরেছে। এসব পরিবারগুলো এখন আত্মীয়স্বজন আর পাড়াপ্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া পানির টানে মূল ভূ-খণ্ডের পূর্বাঞ্চলের মাদ্রাজ ও পশ্চিমাঞ্চলের নজরুল নগর ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দুই ইউনিয়নের ৭টি গ্রাম জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে।ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ মান্ত্রণালয় থেকে সোমবার পর্যন্ত ৫ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। যদিও দুর্গত পরিবারগুলোর মধ্যে এ চাল বিতরণ শুরু করা সম্ভব হয়নি।

উপজেলার ত্রাণ অফিস থেকে জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ১১৯টি ঘর ভেঙে গেছে। গৃহহীন এসব পরিবারগুলোর অবস্থান সাগর মোহনার ঢালচর, কুকরী এবং মুজিব নগর ইউনিয়নে। এসব এলাকার ২৫১টি পুকুর ও মাছের ঘের ভেসে গেছে। ভেঙে গেছে ৬ কিমি. কাঁচা রাস্তা। সাগর মোহনার এই তিনটি ইউনিয়নের পাশাপাশি মূল ভূ-খণ্ডের মাদ্রাজ ও নজরুল নগর ইউনিয়নের ৭টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ এখনো জোয়ারের পানিতে দিনরাত প্লাবিত হচ্ছে।ভূ-খণ্ডের পূর্বাঞ্চলের মাদ্রাজ এবং পশ্চিমাঞ্চলের নজরুল নগর ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের ৩টি পয়েন্টের ১৭৫ মিটার এলাকা ভেঙে গেছে। এ কারণে দু’টি ইউনিয়নের হামিদপুর, চর নিউটন, মোহাম্মদপুর, পূর্বমাদ্রাজ, উত্তর কলমী, চর কলমী এবং দক্ষিণ কলমী গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ এখনো দিন-রাত জোয়ারের পানিতে দফায় দফায় প্লাবিত হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়,রোয়ানুর তাণ্ডবে চরফ্যাশনের ২৮ কিমি. বেড়িবাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার মধ্যে কুকরী ইউনিয়নের ১৪ কিমি. বেড়িবাঁধ রয়েছে।এছাড়া চরফ্যাশনের মাদ্রাজ ইউনিয়নে ১৭৫ মিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোয়ানুর প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানির টানে চরফ্যাশনের তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের চলমান কাজের প্রায় ২কিমি. এলাকা নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। এছাড়া উন্নয়ন কাজের ৮০ হাজার জিও ব্যাগ, ৭ হাজার সিমেন্ট ব্যাগ, পাথর ও বালি নদী গর্ভে ভেসে গেছে। এতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের চলমান উন্নয়ন কাজের ১০ কোটি ৩১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে নির্বাহী প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) কাওসার আলম জানিয়েছেন।

কক্সবাজার: ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারী ঝাউ বাগানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রবল ঢেউয়ের ভেঙে ও উপড়ে গেছে প্রায় ৩ শতাধিক ঝাউ গাছ। এতে ভেঙে শ্রীহীন হয়ে পড়েছে সৈকত পাড়ের বিশাল ঝাউ বাগান।স্থানীয়রা জানান, রোয়ানুর প্রভাবে সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধিতে ঢেউয়ের ধাক্কায় সৈকতের ঝাউগাছের গোড়া থেকে বালি সরে গিয়ে এসব গাছ উপড়ে গেছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে জোয়ারের পানির ঢেউয়ে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে এসব গাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। ফলে ধীরে ধীরে বিলীন হতে বসেছে সাগর তীরের সৌন্দর্য বাড়ানো ঝাউ বাগান।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সৈকতের ডায়াবেটিক পয়েন্ট, সমিতি পাড়া,নাজিরারটেক, শৈবালসহ বিভিন্ন পয়েন্টে সাগরের বালিয়াড়িতে উপড়ে পড়েছে অনেক ঝাউগাছ। বনবিভাগের লোকজন উপড়ে পড়া ঝাউগাছগুলো সরাতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।কক্সবাজার সদর রেঞ্জের বন কর্মকর্তা তাপস কুমার দেব জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে নাজিরারটেক থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় ৩ শতাধিক গাছ উপড়ে ও ভেঙে পড়েছে। এছাড়াও ঢাল পালা ভেঙে ঝাউ বাগানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ডায়াবেটিক পয়েন্ট ও মাদরাসা পয়েন্টের বাগান সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এসব গাছ বন কর্মী সংগ্রহ করা হচ্ছে।

বাঁশখালী: ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু’র আঘাত পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতির সরেজমিন পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে ত্রাণ ও অর্থ বিতরণের জন্য বাঁশখালীতে অবস্থান করছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। এসময় মন্ত্রী ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করবেন।ত্রাণমন্ত্রীর সাথে ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ, জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন ও বিভাগীয় কমিশনার রুহুল আমীন প্রমুখ।দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রীর এ সফরে ঘূর্ণিঝড়ে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা আহতদের প্রত্যেককে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়া হবে বলে জানা গেছে।এদিকে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু’র আঘাত পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রকাশ করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। বাঁশখালীর ৯ জনসহ চট্টগ্রামে মোট ১২ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি চট্টগ্রামের ১০৪টি ইউনিয়নে ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৪টি ওয়ার্ডসহ মোট ১০ উপজেলায় ১০৪ টি ইউনিয়নের ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৮১ হাজার ৪১১ জন আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৪ লাখ ১ হাজার ৬৭৫ জন মানুষ।মোট ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১ লাখ ৩০ হাজার ৯৭টি। এর মধ্যে ১৯ হাজার ৪৩৭টি পরিবার সম্পূর্ণ ও ৮৩ হাজার ৬৬০টি পরিবার আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের সংখ্যা ২০ হাজার ৮৯২টি আর আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের সংখ্যা ২৫ হাজার ৭৬৬টি।রোয়ানু’র কারণে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের পরিমাণ ১৫৪ আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ৫৪১ একর ফসল। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সৃষ্ট পানিতে মারা গেছে ৮০টি গবাদি পশু ও ৪০ হাজার ৫৫০টি হাঁস-মুরগি।এছাড়া ৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ১২টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আংশিক এবং ৪৭ কিলোমিটার রাস্তা সম্পূর্ণ এবং ১৪৪ একর সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ ও ৬৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানান জেলা প্রশাসক।বাঁশখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামশুজ্জামান বলেন, ‘বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামে প্রবেশ করা জোয়ারের পানি এখনো নেমে যায়নি। এতে ২৫ গ্রামের প্রায় দেড় লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয় কেন্দ্রে আসা মানুষদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৫হাজার পরিবারকে চিড়া, গুঁড়, দেয়াশলাই ও মোমবাতি দেয়া হয়েছে।খানখানাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু সিদ্দিক বলেন, বাঁশখালীর ৪১ হাজার পরিবার এখন পানিবন্দী অবস্থায় আছে। এর মধ্যে ২০ হাজার মানুষে ঘড়বাড়ি আংশিক ও ১০ হাজার ঘড়বাড়ি একেবারে ধ্বংস হয়েগেছে। ১১৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত ১০ হাজার মানুষ। ৪০ হাজার মানুষ গতকাল থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অধিকাংশ মানুষই ত্রাণ বঞ্চিত হচ্ছেন।’

চট্টগ্রাম : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু’র আঘাত পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রকাশ করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। বাঁশখালীর ৯ জনসহ চট্টগ্রামে মোট ১২ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি চট্টগ্রামের ১০৪টি ইউনিয়নে ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু’র আঘাতে ক্ষয়ক্ষতি ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পর্যালোচনা বিষয়ক এক সভায় ত্রাণমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এ তথ্য তুলে ধরেন জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন। রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সেমিনার কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সদ্য আঘাত হানা ঘূর্ণীঝড় রোয়ানুতে ক্ষয়ক্ষতির জন্য দুর্বলতাকে দায়ী করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বেচ্ছাসেবক, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং দলীয় নেতাকর্মীদের তৎপরতার কারণে ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

রোববার সন্ধ্যা ৭টায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় ত্রাণমন্ত্রী এ অভিযোগ করেন। এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো সাধারণত পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় যথাযত তদারকি করলে ক্ষয়ক্ষতি আরো কমানো যেতো বলেও উল্লেখ করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, উপকূলীয় বিভিন্ন জেলা উপজেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডরে বেড়িবাঁধ নিমাণ করে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ এলাকাতেই বেড়িবাঁধ থাকলে সেগুলো দুর্বল হওয়ার কারণে তা ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। তাদের গাফিলতির জন্যই এসব প্রাণহানিসহ বেশকিছু ক্ষতি সাধিত হয়েছে।উপস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীর উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, আপনার অতি দ্রুত ক্ষতিগ্রস্থ এসব বেড়িবাঁধ সংস্কার করুন। জলবায়ুর প্রভাবে এই ধরণের দুর্যোগ সামনে আরও আসবে, সেটি মোকাবেলায় আমাদের সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। আপনার বেড়িবাঁধ যদি হয় পাঁচ ফুট, আর জলোচ্ছাস হবে আট ফুট। তখনতো পানি বেড়িবাঁধ টপকে লোকালয়ে ঢুকবেই। এজন্য জলবায়ুর প্রভাবজনিত সমস্যার কথাগুলো মাথায় রেখেই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে।এরআগে সীতাকুণ্ড উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের গাফেলতি ও অবহেলার অভিযোগ তুলে মন্ত্রীর দৃষ্টি আর্কষণ করেন।

ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা আহতদের প্রত্যেককে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে তাৎক্ষণিক সহায় দেয়া হবে। এরপর বিভিন্ন সেক্টর খাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সেটি প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট নিজ নিজ মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দিলে আমার মন্ত্রণালয় থেকে সেই অনুপাতে সহায়তা দেয়া হবে।প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের কথা উল্লেখ করে ত্রাণমন্ত্রী বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে থাকার পরও প্রতিটি সময়ে এই দুর্যোগের খবর রেখেছেন। তিনি করণীয় সম্পর্কে আমাকে নির্দেশনা দিয়েছেন। দেশে আসার পর তার স্পষ্ট নির্দেশনা হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্থ একজনও যাতে না খেয়ে থেকে সরকারি সহযোগিতা বঞ্চিত না হয়। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের পাশে আছি, থাকব।উল্লেখ্য, গত শুক্রবার দুপুরে রোয়ানুর আঘাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ৯জনসহ চট্টগ্রামে মোট ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া প্রায় চার লাখ পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং ২৫ হাজার ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, মারা গেছে গবাদি পশু ও হাস-মুরগী। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ফসলী জমি ও বীজতলার।ঝড়ের কারণে চট্টগ্রামে বিমানবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। শাহজালাল বিমানবন্দরের স্বাভাবিক ফ্লাইট ওঠানামা বিঘিœত হয়

নোয়াখালী : চার থেকে পাঁচ ফুট সামুদ্রিক জোয়ারে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সাতটি ইউনিয়নের ২৫টি গ্রাম ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ফেরার পথে শনিবার বিকেলে দ্বীপ উপজেলার হরনী চান্দনী ইউনিয়নের বয়ারচর এলাকার মা-মেয়েসহ দুজন এবং জাহাজমারা ইউনিয়নের চর হেরা গ্রামের অন্য এক নারীর সলিলসমাধি ঘটে। নিহতরা হচ্ছে হরনী চান্দনী ইউনিয়নের বয়ারচর এলাকার আরীর হাট ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল কাশেমের স্ত্রী মিনারা বেগম (৩৫) তাঁর শিশুকন্যা মরিয়ম (১০) ও জাহাজমারা ইউনিয়নের চর হেয়া গ্রামের সালাউদ্দিনের স্ত্রী মাসুদা বেগম (৫০)।শনিবার ভোররাত থেকে রোয়ানুর প্রভাবে সৃষ্ট প্রবল জোয়ারের পানিতে উপজেলার নিম্নাঞ্চলসমূহ প্লাবিত হয়। এ ছাড়া জোয়ারের তোড়ে হাতিয়ার বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে আবার কোথাও বেড়িবাঁধ উপচে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ওই এলাকার ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

জোয়ারের তোড়ে পানিবন্দি গ্রামগুলো হলো সোনাদিয়া ইউনিয়নের মাইজচরা গ্রাম, পশ্চিম সোনাদিয়া গ্রাম, পশ্চিম মাইজচরা গ্রাম, চরঈশ্বর ইউনিয়নের তালুকদার গ্রাম, কালুহাজির গ্রাম,পণ্ডিত গ্রাম, আফাজিয়া, সুখচর ইউনিয়নের চর আমানউল্লা গ্রাম, রামচরণ বাজার, কামাল বাজার, চেয়ারম্যান বাজার, বৌ-বাজার, দাসপাড়া, কাহার গ্রাম, দরগা গ্রাম, বাদশা মিয়াগো গ্রাম, কাদির সর্দার গ্রাম ও মালিশাগো গ্রাম, তমরদ্দি ইউনিয়নের আঠারবেকী, জোবায়েরা, বেজুগালিয়া, জোড়খালী, কোরালিয়া, মদনখালী। এর মধ্যে হাতিয়ায় প্রায় ৩০ হাজার এবং কোম্পানীগঞ্জে ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। হাতিয়ার বিভিন্ন স্থনে বেড়িবাঁধ ভেঙে ও জোয়ারের পানি উপচে পড়ায় কার্যত এসব এলাকার মানুষ এখন দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত করছে।

নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম জানান, বেড়িবাঁধ উপচে এবং কয়েকটি স্থনে বেড়িবাঁধ ভাঙা থাকায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। তবে কী পরিমাণ বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা পরে জানাতে পারবেন বলে জানান।পটুয়াখালী : পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় কয়েক হাজার গাছ উপড়ে পড়েছে, বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ৫০০ বসতঘর, বসতঘরে গাছচাপা পড়ে নিহত হয়েছে একজন। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। শুক্রবার রাত থেকে বিদুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে জেলার সাত উপজেলায়। অস্বাভাবিক জোয়ার ও ভারি বর্ষণের ফলে নদী ও সাগরের পানির তোড়ে বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজের বাসিন্দা মো. রফিকুল ইসলাম হাওলাদার জানান, শুক্রবার রাতে জোয়ারের পানির তোড়ে রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের বৌ-বাজার এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কলাপাড়া উপজেলার চম্পাপুর ইউপির দেবপুরের ইউপি সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা জানান, চম্পাপুর ইউপির ৫৪ নম্বর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দক্ষিণ দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন বেড়িবাঁধ ভেঙে ওই এলাকার প্রায় দুই হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ওই এলাকায় বেশ কিছু মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।এ ছাড়া মহিপুর ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান মুন্সি জানান, মহিপুরের ৪৭/১ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের নিজামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন বাঁধের ১৫ ফুট এবং নিজামপুর স্লুইসগেট-সংলগ্ন বাঁধের ১৩ ফুট ভেঙে ওই এলাকার প্রায় তিন হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদ-নদীর পানি তিন থেকে চার ফুট বৃদ্ধি পেয়ে জেলার গলাচিপা, কলাপাড়া, রাঙ্গাবালী, দশমিনা ও বাউফল উপজেলার চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।দুমকি-বাউফল সড়কের বিভিন্ন স্থানে গাছ উপড়ে পড়ে যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে নির্মাণাধীন দুমকির পাগলা ব্রিজের পূর্ব পাশের সংযোগ সড়ক ধসে পড়েছে। একই কারণে পটুয়াখালী সেতুর দক্ষিণ পাড়ের সংযোগ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বাগেরহাট : প্রচণ্ড ঢেউয়ের আঘাতে বাগেরহাটের শরণখোলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের একাংশ ভেঙে পড়ে ।বৃষ্টি আর প্রচণ্ড ঢেউয়ের আঘাতে শনিবার সকালে শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের বলেশ্বর নদের তাফালবাড়ী এলাকায় বেড়িবাঁধের একাংশ ভেঙে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বাঁধের কোনো কোনো এলাকায় সিমেন্ট-বালু দিয়ে তৈরি করা ব্লক সরে গেছে। যেকোনো সময় ঝুঁকিপূর্ণ ওই বাঁধ ভেঙে গ্রামে পানি ঢুকে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুক্রবার থেকে দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের কারণে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে গেছে। সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে জোয়ারের সময় পানি ঢুকে পড়লেও ভাটার সময় নেমে গেছে।এদিকে রোয়ানু উপকূল অতিক্রম করায় বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া নারী-পুরুষ শনিবার বিকেল থেকে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে শুরু করেছে।

লক্ষ্মীপুর : রামগতি উপজেলার চরগাজী ইউপি চেয়ারম্যান তাওহীদুল ইসলাম সুমন জানান, জোয়ারের পানিতে ওই ইউনিয়নের চরলক্ষ্মী গ্রামে চার শতাধিক ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। রামগতির চর আব্দুল্লাহ, চর গজারিয়া, মৌলভীচর, কমলনগরের চর ফলকন ও সদরের চর রমনী মোহন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।সদর উপজেলার তেয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের শহর কসবা গ্রামে গাছ ভেঙে পড়ে আনোয়ার উল্লাহ (৫২) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়। জেলার অন্যান্য স্থানে আহত হয়েছে অন্তত তিনজন। ভেঙে পড়েছে দুই শতাধিক গাছপালা।

পিরোজপুর : জেলার বলেশ্বর, কঁচা ও সন্ধ্যা নদীতে জোয়ারে পানি চার থেকে পাঁচ ফুট বেড়েছে। মঠবাড়িয়ার নিম্নাঞ্চল দুই থেকে তিন ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। মঠবাড়িয়ার মাঝের চরের বেড়িবাঁধের বেশ কিছু অংশ পানির তোড়ে ভেঙে গেছে।বলেশ্বরের জলোচ্ছ্বাসে খেতাচিড়া, ভাইজোড়া, কচুবাড়িয়া, নিজামিয়া, ভোলমারা, উলুবাড়িয়া, মাছুয়া, মধ্য তুষখালী, জানখালী, তুষখালী এলাকা প্লাবিত হওয়ায় জেলেপল্লীর লোকজন আতঙ্কে আছে। মাঝের চর ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের ওয়্যারলেস অপারেটর আব্দুল হালিম জানান, চরের ২০০টি পরিবারকে শুক্রবার রাতেই আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে।সদর উপজেলার বাদুরা গ্রামের মত্স্যজীবী কল্যাণ সমিতির সম্পাদক মো. মোস্তফা আকন জানান, তাঁর সমিতির সদস্য মনির গাজীর এমভি রিপা নামের একটি মাছ ধরার ট্রলার ১৪ জন জেলেসহ নিখোঁজ । তাদের ৯ জনের বাড়ি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের বেতবুনিয়া গ্রামে। একজনের বাড়ি পটুয়াখালীর মহিপুরে। অন্যদের বাড়ি পিরোজপুরের জিয়ানগর ও সদর উপজেলায়। জেলা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানিয়েছে, মঠবাড়িয়া উপজেলায় তিনটি কাঁচাঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।

বরগুনা : পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় দুই থেকে তিন ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ারে জেলার সদর, তালতলী ও পাথরঘাটা উপজেলার চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের সোনাতলা গ্রাম, পাথরঘাটা উপজেলার রুইতা এবং তালতলী উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের তিনটি বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় জোয়ারের পানি ঢুকে বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন উপজেলায় সহস্রাধিক গাছপালা ভেঙে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলি জমি, পাঁচ শতাধিক মাছের ঘের এবং তিন শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি।তারা এখন ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে হাজারো পরিবার।