বহুল আলোচিত পানামা পেপার্সের দ্বিতীয় কিস্তিতে বাংলাদেশের অন্তত ১৮ জনের নাম এসেছে, যারা বিদেশি ঠিকানা ব্যবহার করে শেল কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার হয়েছেন। দি ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) সোমবার বিশ্বের ২১টি অঞ্চলের তিন লাখের বেশি অফশোর কোম্পানির তথ্যের একটি ডেটা বেইজ প্রকাশ করেছে।পানামা পেপারস কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়া ৫২ বাংলাদেশী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত করবে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।মঙ্গলবার দুদক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা জানান সংস্থাটির সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল।কর ফাঁকি দেয়াসহ টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এই মুহূর্তে বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।
তবে ফাঁস হওয়া তথ্যের সত্যতা নিরুপণে দুদকের তদন্ত দল জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে জানান তিনি।যাদের নাম এসেছে, তারা আইন ভেঙে সম্পদ গড়েছেন- এমনটা বলছে না আইসিআইজে। তবে অর্থ পাচার করতে কিংবা কর ফাঁকি দিতে আইনের ফাঁক-ফোঁকর খুঁজেছেন অনেকেই।আইসিআইজে বলছে, জনস্বার্থে এই তালিকা প্রকাশ করেছে তারা।এর আগে ২০১৩ সালের এপ্রিলে আইসিআইজে অফশোর ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ২৫ লাখ নথি প্রকাশ করেছিল ‘অফশোর লিকস’ নামে।
পানামা পেপার্স ও অফশোর লিকস মিলিয়ে এসেছে অর্ধ শতাধিক বাংলাদেশির নাম, যাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা কাজী জাফরউল্যাহ ও নীলুফার জাফর উল্যাহও রয়েছেন।পানামার ল’ ফার্ম মোস্যাক ফনসেকার বিপুল সংখ্যক নথি গত মাসে ফাঁসের পর বিশ্বজুড়ে তা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। এতে অনেক রাষ্ট্রনেতারও অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে অর্থ পাচারের চিত্র প্রকাশ পায়। যে কোম্পানিগুলোর নাম এসেছে, সেগুলোর মধ্যে ২ লাখ প্রতিষ্ঠান ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কোনো না কোনো সময় মোস্যাক ফনসেকার গ্রাহক ছিলেন।বাকি ১ লাখের বেশি কোম্পানি ফনসেকার মতোই সেবাদাতা অন্য দুটি প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক। সোমবার প্রকাশিত পানামা পেপার্সের তালিকায় বাংলাদেশের অন্তত ১৮ জনের নাম এসেছে, যাদের কারও কারও নাম অফশোর লিকসেও ছিল।এবারের তালিকায় আছেন সিটিসেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহবুব চৌধুরী, যিনি আগে গ্রামীণফোনের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তাও ছিলেন।
তালিকায় রয়েছে আইজিডাব্লিউ অপারেটর সেল টেলিকমের কফিল এইচ এস মুয়ীদ,এক্সেসটেলের মালিক জাইন ওমর, কিউবির অংশীদার আফজালুর রহমান। মেহবুব চৌধুরী ও কফিল এইচ এস মুয়ীদ কোপার্নিকাস ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডার। এই ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার জন্য মেহবুব চীনা এবং মুয়ীদ উরুগুয়ের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন।
কোপার্নিকাস ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড আবার মোস্যাক ফনসেকার সিঙ্গাপুর শাখার একটি ইন্টারমেডিয়ারি কোম্পানি। অর্থাৎ, মোস্যাক ফনসেকা কার হয়ে ওই কোম্পানি খুলেছে, এই নথি থেকে তা জানার উপায় নেই।এ তথ্য ভাণ্ডার থেকে বাংলাদেশের আর যাদের নাম জানা গেছে, তাদের অধিকাংশেরই পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।এর মধ্যে আছেন মল্লিক সুধীর, মো. ইউসুফ রায়হান রেজা, বেনজির আহমেদ, ইসরাক আহমেদের, নভেরা চৌধুরী, বিলকিস ফাতিমা,ফরহাদ গনি মোহাম্মদ, মো. আবুল বাশার, নিজাম এম সেলিম, মোহাম্মদ মোকসেদুল ইসলাম, মো. মোতাজ্জারুল ইসলাম, সরকার জীবন কুমার, মো. মোতাজ্জারুল ইসলাম ও মো. সেলিমুজ্জামান।এর বাইরে রজার বার্ব, ‘দি বিয়ারার’, পেসিনা স্টেফানো, রুডি বেন-জামিন নাম ব্যবহার করে শেল কোম্পানিতে যুক্ত হওয়া অন্তত চারজনের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ পেয়েছে আইসিআইজে।
এদের মধ্যে রজার বার্ব দি কমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড নামের এক কোম্পানির শেয়ার মালিক। এক্সেসটেলের মালিক জাইন ওমরের নামেও ওই কোম্পানির শেয়ার আছে।‘দি বিয়ারার’ হলেন রিমোট এস এ নামের এক কোম্পানির একজন শেয়ার হোল্ডার, যিনি আসলে অন্য কোনো ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করছেন। ওই নাম আসা দুটি নথির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ রয়েছে বলে আইসিআইজের তথ্য। পেসিনা স্টেফানো ও রুডি বেন-জামিনের নামও এসেছে একইভাবে, রেভিন কেপিট্যাল করপোরেশন ও ওবোল্টি গ্লোবাল লিমিটেড নামের দুই কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার হিসেবে।এছাড়া বাংলাদেশের অন্তত ১৪টি ঠিকানা এসেছে পানামা পেপর্সে, যেগুলো ব্যবহার করে বিদেশি ব্যক্তিদের নামে অফশোর কোম্পানির শেয়ার কেনা হয়েছে।আইসিআইজের আগের প্রকাশিত অফশোর লিকস ডেটা বেইজে বাংলাদেশিদের তালিকায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাফর উল্যাহ ও নীলুফারের নাম রয়েছে।জাফর উল্যাহ ও নীলুফারকে ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইল্যান্ডে নিবন্ধিত পাথফাইন্ডার ফিন্যান্স এবং হ্যানসিটিক লিমিটেডের পরিচালক বা অংশীদার হিসেবে দেখানো হয়েছে। ওই তালিকায় রয়েছে বাংলাট্র্যাকের মালিক আমিনুল হক, তার ছেলে নাজিম আসাদুল হক ও তারিক একরামুল হকের নাম। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খানের সম্বন্ধী ব্যবসায়ী আজমাত মঈনও এর মধ্যে রয়েছেন।
অফশোর লিকসের তথ্য ভাণ্ডারে বাংলাদেশের আরও যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন- দিলীপ কুমার মোদি, কাজী রায়হান জাফর, মাহতাবউদ্দিন চৌধুরী, সৈয়দা সামিনা মির্জা, উম্মে রুবানা, সালমা হক, আসমা মোনেম, এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেম, সৈয়দ সেরাজুল হক ও এফ এম জুবাইদুল হক।এছাড়া ক্যাপ্টেন এম এম জাউল, মোহাম্মদ শহীদ মাসুদ, খাজা শাহাদত উল্লাহ, মোহাম্মদ ফয়সাল করিম খান, মোহাম্মদ শহীদ মাসুদ, জুলফিকার হায়দার, মির্জা এম ইয়াহিয়া, মো. নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, এফ এম জুবাইদুল হক, এ এফ এম রহমাতুল বারী, খাজা শাহাদাত উল্লাহ নামগুলোও ওই তালিকায় রয়েছে।এদিকে সোমবার রাতে কর ফাঁকির আইনি প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকারের ফাঁস হওয়া আরও দুই লাখের বেশি গোপন নথি প্রকাশ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)। পানামা পেপারস নামে পরিচিতি পাওয়া গোপন নথির এটি ছিল দ্বিতীয় কিস্তি।