পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের তুলাতুলি এলাকায় লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও তৃতীয় দিনেও পুরোপুরিভাবে নেভাতে পারেনি বনবিভাগ ও ফায়ার সার্ভিস। ওই এলাকার বিভিন্ন স্থানে এখনো ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে আগুন জ্বলে উঠছে। ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এলাকাটি দূর্গম হওয়ায় এবং পানির সুব্যবস্থা না থাকায় সবাইকে আগুন নেভাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এই আগুন পুরোপুরি কখন নেভানো যাবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। তবে সুন্দরবনে লাগা আগুন এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রয়েছে বলে দাবী করেছে বন বিভাগ। নাশকতাকারীরা এবার কয়েক কিলোমিটারের এলাকা জুড়ে অন্তত ২০ টি স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়ায় সেখানকার বনে টেকা দায় হয়ে পড়েছে বন্য প্রাণিকূলের। একরের পর একর বনাঞ্চলের সাথে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। শুক্রবার দুপুরে সুন্দরবনে লাগা আগুনে পুড়ে মরে থাকতে দেখা গেছে একটি কচ্ছপ। পোড়া এই কচ্ছপের চিত্র দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি আগুন নিভানোর কাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও। নাম প্রকাশ না করা শর্তে কয়েকজন কর্মী বলেন, আগুনে গুইসাপসহ ছোট বড় সাপ পুড়ে মারা গেছে যা তারা দেখেছেন এবং বন কর্মকর্তাদের নির্দেশে দূরে ফেলে দিয়েছেন।
এদিকে সুন্দরবনে আগুন লাগার কারনে শুক্রবার সকাল থেকে গোটা পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ জুড়ে জেলে, বাওয়ালী, মৌয়ালদের পাশ পারমিট দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে বন বিভাগ। তবে বিদেশী পর্যটকরা অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারবেন। এরআগে বৃহষ্পতিবার শুধুমাত্র চাঁদপাই রেঞ্জে সকল ধরনের পাশ পারমিট বন্ধ করে দেয়া হয়। এর একদিন পরই গোটা পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ জুড়ে এই র্নিদেশ দেয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত জেলে বাওয়ালী, মেীয়াল ও সাধারন মানুষের প্রবেশাধিকার সম্পূর্ন নিষিদ্ধ করে রেড এলার্ড জারি করেছে বন বিভাগ। এ দুটি রেঞ্জ জুড়ে টহল দিচ্ছে র্যাব ও কোস্টগার্ড সদস্যরা। শুক্রবার দুপুরে বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মো. জহির উদ্দিন আহমেদ নাশকতার আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘটনাস্থল পরিদর্শনে করেছেন। পরিদর্শন শেষে মো. জহির উদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার কারণে ইতিমধ্যে তিন জন বনকর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। যাদের অবহেলায় সুন্দরবনে নাশকতা হচ্ছে সেসব বিভাগীয় কর্মীদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল বিভাগের সাথে যোগাযোগ রাখছি। সুন্দরবন সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে কোন দ্বিধা করা হবে না। তিনি আরো বলেন, দফায় দফায় সুন্দরবনে আগুন লাগার কারনে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের দুটি রেঞ্জে শরণখোলা এবং চাঁদপাইয়ে সব ধরনের পাশপারমিট বন্ধ করে রেড এলার্ড জারি করা হয়েছে। তবে বিদেশ থেকে আসা পর্যটকরা সুন্দরবনে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন। বর্তমানে যারা পাশ
তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনে এবারে দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনের ধরনটা একটু ভিন্ন। এই দুর্বৃত্তরা তুলাতুলি এলাকার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ২০ টি স্থানে আগুন দিয়েছে। যা আমাদের সনাক্ত করতে সময় লেগেছে। যার কারনে আগুন নিভাতে সময় লাগছে। আগুন নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রয়েছে। তবে এখনই ফায়ার সার্ভিসকে সুন্দরবন থেকে সরিয়ে নেয়া হবে না। তারা সুন্দরবন বিভাগের সঙ্গে আগুন লাগার এলাকায় থেকে পর্যবেক্ষণ করবে। তবে ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা কয়দিন সুন্দরবনে থাকবে তা তিনি নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি।
বাগেরহাট ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক মানিকুজ্জামান মানিক বলেন, বুধবার সন্ধ্যা থেকে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট বিরতিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ঘটনাস্থলের দুই কিলোমিটার দূর থেকে আমরা পানি এনে আগুন নেভানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। দমকল কর্মীরা প্রখর তাপদাহে অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে। এজন্য খুলনা ফায়ার সার্ভিস থেকে ১২ জনের একটি দল শুক্রবার সকালে সুন্দরবনে এসে কাজে যোগ দিয়েছে। তাছাড়া তীব্র বাতাসের কারনে আগুন নেভানোর কাজ বিঘিœত হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় এখনো ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে আগুন জ্বলে উঠছে। একারনে যেখানে আমরা ধোঁয়া দেখছি সেখানেই পানি ছিটাচ্ছি। পুরোপুরি আগুন কখন নিভাতে পারবো তা বলতে পারছি না।
এদিকে পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশন’র চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম সুন্দরবনে আগুন লাগার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সুন্দরবনে বারবার আগুন লাগার ঘটনা প্রমাণ হয়েছে, সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা সুন্দরবন সুরক্ষায় মোটেও আন্তরিক নয়। সুন্দরবনে শুধু অগ্নিকান্ডই নয়, প্রতিনিয়ত বিষ দিয়ে মাছ ধরা, বাঘ-হরিণ শিকার ও গাছ পাচারসহ নানা ধরণের অপরাধমুলক কর্মকান্ড চলছে যার অধিকাংশই দৃশ্যমান নয়। বন সন্নিহিত লোকালয় শরণখোলা ও মোড়েলগঞ্জের শাসকদলের কতিপয় জনপ্রতিনিধি এবং তাদের আশ্রিত র্দূবৃত্তদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, সুন্দরবন রক্ষায় বনে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করা প্রয়োজন। বর্তমানে বন জুড়ে যা হচ্ছে সবই অবৈধ, বেআইনি ও পরিকল্পিত। তাই সুন্দরবন সুরক্ষয়া সরকারকেই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবী জানান তিনি।
সুন্দরবনের আগুনের নেপথ্যে: সুন্দরবনসহ উপকূলের অপরাধ জগতের হাল নাগাদ খোঁজখবর রাখেন এমন একাধিক সূত্র বলছে, দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া অনেক সময় এক শ্রেনীর অসাধু বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোড়েলগঞ্জ উপজেলায় শাসকদলের কয়েকজন প্রভাবশালী ইউপি চেয়ারম্যান তাদের দস্যূবাহনী দিয়ে সুন্দরবনের ১৮/২০টি বিল কথিত ইজারার নামে অবৈধ্য মাছ চাষ করতে পরিকল্পিত ভাবে বনে আগুন ধরিয়ে দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। ১২ এপ্রিল রাতে এবং ১৮ এপ্রিল সকালে ও সর্বশেষ ২৮ এপ্রিল ভোরে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী বনে ৩টি আগুনের ঘটনাটি নিয়ে এবার এমনই অভিযোগ তুলেছে খোদ পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো.সাইদুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন, ১২ এপ্রিল রাতে ও ১৮ এপ্রিল সকালে সুন্দরবনে দেয়া আগুনের ঘটনায় বন বিভাগ আদালত এবং শরণখোলা থানায় পৃথক দুটি মামলায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে। ওই দুটি নাশকতার আগুনের ঘটনায় শরনখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহজাহান হাওলাদার ওরফে শাহজাহান শিকারীসহ আসামী স্থানীয় আওয়ামী লীগের ১১ নেতা-কর্মীদের শরণখোলা থানা পুলিশ একজনকেও আজ পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি। ডিএফও জানান, এবারেও যারা সুন্দরবনে পরিকল্পিত ভাবে অগ্নিকান্ডের ঘটনার সাথে জড়িত প্রাথমিত তদন্তে ইতিমধ্যে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রবিবার সকালে বাগেরহাটের আদালতে মামলা দায়ের করা হবে। তবে সুন্দরবনে পরিকল্পিত এসব আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনার মাষ্টারমাইন্ডদের কেন দ্রুত বিচার আইনের মামলার আসামী করা হচ্ছেনা ? সে বিষয়ে নিয়ে কোন মন্তব্য করতে নারাজ এই বন কর্মকর্তা।
ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে গত ১৪ বছরে এনিয়ে ২২ বার আগুনে পুড়েছে। চলতি বছরের ২৮ মাচ পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলী এলাকায় লাগা আগুনে প্রায় দেড় একর এবং ১২ ও ১৮ এপ্রিল লাগা আরো দুটি নাশকতার আগুনে পুড়ে যায় প্রায় ১০ একর বনভূমি। সর্বশেষ একই এলাকায় মাত্র এক মাসের মধ্যে চতুর্থ বার ২৭ এপ্রিল ভোরে ধরিয়ে দেয়া নাশকতান আগুনে এখনো পুড়ছে সুন্দরবনের তুলাতুলির অরন্য। শুধুমাত্র পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় লাগা এসব আগুনে প্রায় ৭০ একর বন ও পুড়েছে কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ। সুন্দরবনকে আগুনে পুড়ে যাবার হাত থেকে রক্ষায় নেই বন বিভাগের কোন নিজস্ব অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা। ২০০২ সালের ২২ মার্চ ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড কটকা অভয়ারণ্যের আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর থেকে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় শুরু হয় অগ্নিকান্ড। আগুন লাগানোর এসব দুস্কর্মের সাথে জড়িত আপরাধীরা সব সময় থেকে যায় ধরাছোয়ার বাইরে। গোটা সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জের মধ্যে কেন বা কোন যাদুবলে শুধুমাত্র চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় একের পর এক আগুন লাগার বিষয়টি এখন মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এদিকে, পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের তুলাতুলি এলাকায় আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে শুক্রবার সন্ধ্যায় খলিলুর রহমান হাওলাদার (৩৫) নামে একজনকে আটক করেছে পুলিশ। শরণখোলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ আলম মিয়া জানান, সুন্দরবনে আগুন দেয়ার ঘটনার সাথে জড়িত এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে খলিলকে আটক করা হয়েছে। খলিল শরণখোলা উপজেলার উত্তর রাজাপুর গ্রামের চান মিয়া হাওলাদারের ছেলে। গত ১৮ এপ্রিল আগুন লাগার ঘটনার পর ১৯ এপ্রিল শরণখোলা থানায় বন বিভাগের মামলা দায়েরের পর এই প্রথম একজনকে আটক করলো পুলিশ।