খুনিরা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত হত্যায় অংশ নেয় সাতজন

যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক কর্মকর্তা, সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্তত পাঁচ জনের ছবি চিহ্নিত করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। খুনিরা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) স্লিপার সেলের সদস্য বলেই ধারণা তদন্তকারীদের। এর আগেও এবিটির স্লিপার সেলের এই সদস্যরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেছেন, ঘটনাস্থল ও আশপাশের সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ দেখে কয়েকজন দুর্বৃত্তকে চিহ্নিত করা গেছে। ঘটনাস্থল থেকে জব্দকৃত আলামত তদন্তে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এ পর্যায়ে হত্যার মোটিভ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া গেছে।খুব দ্রুতই ঘৃণ্য চক্রের এসব দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলে জানান এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা। গত সোমবার রাজধানীর কলাবাগান থানা এলাকায় জুলহাজ ও তার বন্ধুকে হত্যার পরপরই ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে তিনটি ভিডিও ফুটেজসহ অন্তত দশটি গুরুত্বপূর্ণ আলামত জব্দ করা হয়। পরবর্তীতে সেসব আলামত পর্যালোচনা করে তদন্তে এখন পর্যন্ত জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর সদস্য হতে পারে বলে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যার মোটিভ বা কারণ সম্পর্কেও কিছুটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া গেছে। খুনিদের গ্রেপ্তার করতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অভিযান চলছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার শুরুতে অনেকগুলো কারণ সামনে রেখে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করা হয়। তবে তদন্তের এ পর্যায়ে তাদের কাছে মনে হচ্ছে, সমকামীদের অধিকার বিষয়ক বাংলাদেশের একমাত্র পত্রিকা ‘রূপবান’র সম্পাদক হিসেবে জুলহাসের ভূমিকাকে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর সদস্যরা ভালোভাবে নেয়নি। তদন্তে এখন ব্যক্তিগত কোনো কারণে জুলহাজ ও তার বন্ধুকে খুন করা হতে পারে এমন তথ্যও পাওয়া যায়নি। গোয়েন্দারা মনে করছেন, ব্যক্তিগত কারণে কাউকে খুন করার জন্য এতবড় ঝুঁকি নিয়ে কেউ কাউকে খুন করবে না। গত সোমবার কলাবাগানে লেকসার্কাসের পাশের একটি ভবনের তিন তলায় ভাড়া বাসায় খুন হোন জুলহাজ ও তার বন্ধু তনয়। পার্শ্ববর্তী ভবনের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে পাঁচ জন খুনির পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। এছাড়া পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের কাছ থেকে একটি ব্যাগও ছিনিয়ে নিয়েছেন ওই এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশ। এদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামন খাঁন কামাল বলেছেন, ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সঠিক পথে এগোচ্ছে। শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে একটি শো-রুম উদ্বোধন শেষে কলাবাগানের ওই জোড়া খুনের তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমরা ঠিক পথে এগোচ্ছি, তা আমরা আপনাদের জানাবো।গত বছরের কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের মতো সোমবার বিকালে কলাবাগানের লেক সার্কাস এলাকায় পার্সেল দেওয়ার কথা বলে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে খুন করা হয় ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল অ্যাসিসটেন্ট জুলহাজ জুলহাজ (৩৫) ও তার বন্ধু তনয়কে (২৬)।সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাত ভাই জুলহাজ সমকামীদের অধিকারের পক্ষের সাময়িকী ‘রূপবান’ সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন।ওই খুনের ঘটনায় জুলহাজের বড় ভাই মিনহাজ মান্নান বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ৫/৬ জনকে আসামি করে কলাবাগান থানায় হত্যা মামলা করেন। বুধবার তার তদন্তভার পায় ডিবি পুলিশ।

হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে সনাক্ত করা গেছে কি না- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবো না। পরে আপনাদের জানাবো।শুক্রবার সকালেও ধানমন্ডির বাসায় সাংবাদিকদের একই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হন আসাদুজ্জামন খাঁন কামাল।তিনি বলেন, আপনারা বিভিন্ন পত্রিকায় দেখেছেন, আমরা এগুলো আর এখন কিছু বলছে চাচ্ছি না। কয়েকদিন পর সব জানাবো।এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আল কায়দার নামে বার্তা এলেও তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের।জুলহাজের আগে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশে মুক্তমনা লেখক, ব্লগার, শিক্ষক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের অধিকাংশ ঘটনার দায় স্বীকারের বার্তা এসেছে আইএসের নামে। এসব দাবিও খারিজ করে সরকার বলে আসছে, বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এই জঙ্গি গোষ্ঠীর কোনো অস্তিত্ব নেই।ধানমন্ডির বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ ধরনের ‘টার্গেট কিলিং’ এর যত ঘটনা ঘটেছে তাতে জড়িত প্রায় সবাইকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে দাবি করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল।যতগুলো টার্গেট কিলিং হয়েছে ব্লাগারসহ, এগুলোর প্রায় সবগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কয়েকজনকে ধরেছি। তারা বিচারের মুখোমুখি। কয়েকজন অতি শিগগির ধরা পড়বে।জুলহাজ ও তনয়কে খুন করে যাওয়ার সময় এক পুলিশ এবং এক নিরাপত্তাকর্মীকেও কুপিয়ে জখম করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে কয়েকশ’ গজ দূরে ডলফিন রোডের এক বাসার সিসিটিভিতে পাঁচ যুবককে দৌড়ে পালিয়ে যেতে দেখা যায়।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দৌড়ে যাওয়া যুবকরাই লেক সার্কাস রোডে খুন করে সেই রাস্তা দিয়ে পালায়।জুলহাজ হত্যা তদন্তে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র; খুনিদের গ্রেপ্তারের আহ্বান জানিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোনও করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি।