খুনিরা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত হত্যায় অংশ নেয় সাতজন

রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় খুন হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও বন্ধু মাহবুব তনয় হত্যায় সাতজন অংশ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন জুলহাজের বাসার নিরাপত্তারক্ষী পারভেজ মোল্লা। ঘটনার দিন তাঁকে কুপিয়ে আহত করা হয়।বুধবার দুপুরে জুলহাজের বাসার ফটকের সামনে পারভেজ মোল্লা সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, জুলহাজের বাসার ফটকে প্রথমে চারজন পার্সেলের তিনটি বক্স নিয়ে এসে বলে, পার্সেলগুলো জুলহাজ স্যারের। তখন পারভেজ গেটের সিটকিনি আটকে দোতলায় জুলহাজের কাছে পার্সেলের বিষয়টি জানানোর জন্য ওপরে যান। তাঁর সঙ্গে ওই চারজনও ওপরে উঠে যায়। এ সময় জুলহাজ দরজা খুললে ঘাতকদের একজন জানায়, তাঁর (জুলহাজের) নামে পার্সেল আছে। কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে জুলহাজের কথা হয়। জুলহাজ বলেন, তাঁর নামে কোনো পার্সেল আসার কথা নয়। পার্সেল এলেও পার্সেলে কী আছে, সেটা দেখবেন, তারপর পার্সেল গ্রহণ করবেন। এদিকে, কোথায় আঘাত করলে দ্রুত মৃত্যু হয়, সেই প্রশিক্ষণ নিয়েই খুনিরা সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে কুপিয়েছে বলে মনে করছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশের ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন,দক্ষ হাতের কাজ, খুনিরা প্রশিক্ষিত। কোথায় আঘাত করলে মারা যাবে, সে ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েই তারা কুপিয়েছে। সোমবার বিকালে কলাবাগানের লেক সার্কাস এলাকায় পার্সেল দেওয়ার কথা বলে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ইউএসএআইডির কর্মসূচি কর্মকর্তা জুলহাজ (৩৫) ও তার বন্ধু তনয়কে (২৬)।পাঁচ থেকে সাতজন এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় বলে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য।

দুই মামলা: জুলহাজ ও মাহবুব হত্যার ঘটনায় কলাবাগান থানায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি হত্যা মামলা, অন্যটি অস্ত্র আইনে। কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হাসান মাহমুদ গতকাল বলেন, নিহত জুলহাজ মান্নানের ভাই মিনহাজ মান্নান হত্যা মামলাটি করেছেন। সরকারি কাজে বাধা ও অস্ত্র আইনে মামলা করেছেন ঘটনার সময় ঘটনাস্থলের কাছে দায়িত্ব পালন করা উপপরিদর্শক শামীম আহমেদ। দুটি মামলায়ই অজ্ঞাতনামা পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে।কলাবাগান থানার পুলিশের সূত্র বলেছে, পালিয়ে যাওয়ার সময় এক দুর্বৃত্তের কাছ থেকে উদ্ধার করা ব্যাগ থেকে পাওয়া একটি দেশি ও একটি বিদেশি পিস্তল, গুলি, চাপাতি, একটি গামছা, একটি লুঙ্গিসহ নয় ধরনের আলামত পাওয়া গেছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে পুলিশ। এক পুলিশ সদস্য ব্যাগটি উদ্ধার করেন।পালাতে থাকা দুর্বৃত্তদের আটকাতে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের কোপে আহত হন এএসআই মমতাজ।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন,আলামত ধরে তদন্ত চলছে। এসব ঘটনায় জামায়াত-শিবিরসহ জঙ্গি সদস্যরা জড়িত থাকতে পারে। তবে তারা সব একই। আমরা অনেকগুলো হত্যার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করেছি। এগুলোর বিচারকাজ চলছে। তিনি বলেন, সব হত্যার বিচার হবে। এ বিষয়ে গোয়েন্দারা সচেতন রয়েছেন। সারা পৃথিবীতে অস্থিরতা চলছে, সে তুলনায় আমরা নিয়ন্ত্রণে আছি।

জুলহাজ মান্নান, মাহবুব তনয়উপর্যুপরি কোপানো হয়েছে: জুলহাজ ও মাহবুরের লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেন, দুজনকেই উপর্যুপরি কোপানো হয়েছে। জুলহাজের মাথার বাঁ দিকে গভীর গর্ত হয়ে মগজ বেরিয়ে যায়। এতে তাঁর মৃত্যু হয়। মাহবুবের মাথার পেছনে ও ঘাড়ে উপর্যুপরি কোপ ছিল। তাঁর স্পাইনাল কর্ড কেটে যায়। এতেই তাঁর মৃত্যু হয়। দুজনেরই হাতে কোপ ছিল। ধারণা করছি, বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা।পারভেজের ভাষ্য, পার্সেল দেওয়ার নামে তাঁরা কথা বলার একপর্যায়ে পারভেজ ও জুলহাজ আগত ব্যক্তিদের সন্দেহ করেন। এ সময় জুলহাজ দরজা আটকে দিতে গেলে ঘাতকেরা তাঁকে বাধা দেয়। এ অবস্থায় পারভেজ ঘাতকদের বাধা দিলে ঘাতকদের একজন পারভেজের বাঁ বাহুতে চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়। পারভেজ বলেন, তখন আমি বুঝতে পারিনি যে আমাকে কোপ দেওয়া হয়েছে। তারপর তিনি আবার বাধা দিতে গেলে তাঁর কপালে কোপ দেওয়া হয়। এ সময় রক্ত বের হলে তিনি চিৎকার দিয়ে নিচে নেমে আসেন। তখন ওই চারজন ঘরে ঢুকে জুলহাজ ও তনয়কে কুপিয়ে চলে যায়। কোপানোর সময় তারা আল্লাহু আকবর বলে। নিচে নামার সময় পারভেজ দেখেন, গেটের সামনে আরও দুজন ও গেটের বাইরে একজন দাঁড়িয়ে।

পারভেজ বলেন,বাসার নিরাপত্তায় তিনিসহ আরও একজন ছিলেন।এছাড়া কেয়ারটেকার (তত্ত্বাবধানকারী) ছিলেন একজন। তিনি নিচে নেমে দেখেন, কেয়ারটেকার ও নিরাপত্তারক্ষী সুমনকে গেটের পাশে একটি ছোট্ট কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে। পুরো ঘটনাটি চার থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘটে। ঘটনার পর ঘাতকেরা পালিয়ে যায়। সবার গায়ে নীল গেঞ্জি ছিল। তা প্যান্টে গোঁজা ছিল। ঘাতকদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর। সবাই গোঁফদাড়ি কামানো (ক্লিন শেভড) ছিল।জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ডের তদন্তে আরও কিছু আলামত পাওয়ার কথা জানিয়ে ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার সম্ভাবনার পাশাপাশি আরও কয়েকটি দিক তারা খতিয়ে দেখছেন যা এখনই বলা সম্ভব নয়।বুধবার নিজের কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা (নিহতরা) একটি সংগঠন করত। সেখানে কোনো আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত সমস্যা অথবা কোনো সংঘবদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী ঘটনাটি ঘটিয়েছে কি না কোনো সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছি না।তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। দুই-চারদিন গেলেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারব। কাউকে সন্দেহের বাইরে রাখা হচ্ছে না। সব ডাইমেনশন মাথায় নিয়ে এগোচ্ছে পুলিশ। সোমবার বিকালে কলাবাগানের লেকসার্কাসে নিজের বাসায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ইউএসআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী তনয়কে। সমকামীদের অধিকারের পক্ষের সাময়িকী রূপবান সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন জুলহাজ।তাদের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের ভাষ্যমতে, যেভাবে দুজনকে আঘাত করা হয়েছে তাতে দক্ষ, প্রশিক্ষিত’ হাতের কাজ মনে হয়েছে।গত ফেব্র“য়ারিতে লেখক অভিজিৎ রায় থেকে শুরু করে ঢাকায় যে কয়েকজন লেখক, ব্লগার ও প্রকাশককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাদের ময়নাতদন্তকারী এই চিকিৎসক বলছেন, ওই সব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জুলহাজ-তনয় খুনের মিল রয়েছে।হত্যাকাণ্ডের পর পাঁচ থেকে সাতজনকে আল্লাহু আকবার বলতে বলতে গুলি ছুড়ে পালিয়ে যেতে দেখার কথা জানিয়েছেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী।তারপরেও এ ঘটনায় আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি সন্দেহে রাখার কারণ ব্যাখ্যায় ডিএমপি কমিশনার বলেন, তদন্তের স্বার্থে আরও কিছু কথা আপনাদের বলতে পারছি না। আমরা আরও কিছু আলামত পেয়েছি। একজন হত্যাকারী এমন ঘটনা ঘটাতে পারে যাতে তার দায় এড়িয়ে ইঙ্গিত যেন অন্যদিকে যায় সেটিও তো হতে পারে।

আছাদুজ্জামান বলেন, তদন্তকারী অফিসার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এর যৌক্তিকতা ও সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা। একজন খুন করে অন্যকে ফাঁসানোর জন্য অন্য ধরনের ডাইমেনশন দেবার একটি অপচেষ্টাও হতে পারে। বাট বিষয়টা হলো তদন্তের বিষয়, বাস্তবতার বিষয়, যুক্তির বিষয়। প্রত্যেকটির তদন্ত হচ্ছে। হত্যার আসল উদ্দেশ্য কী ছিল, কারা জড়িত ছিল তা খুঁজে বের করব। সেদিনের ঘটনার বিবরণে তিনি বলেন, সোমবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে এক লোক কুরিয়ার সার্ভিসের একটা আইডি কার্ডসহ দুটি পার্সেল নিয়ে কলাবাগানের ওই বাড়িতে যায়। সে গিয়ে রিসিপশনে বলেছে যে, জুলহাজ মান্নানের সঙ্গে কথা হয়েছে। এরপর জুলহাজ নিচে নেমে এসেছে। ওই লোককে নিয়ে ওনার বাসায় গেছে। তখন মেইন গেইটের কলাপসিবল গেইট দিয়ে চারজন হঠাৎ ঢুকে পড়ে। তিনজন দারোয়ান তাদের বাধা দিলে দুইজনকে কুপিয়ে আহত করা হয় এবং গেইটের পাশে একটি রুমে তালাবদ্ধ করে রাখে।তিনজন সন্ত্রাসীর কাঁধে ব্যাগ ছিল, নীল গেঞ্জি পরা ছিল। কোনো কিছু বোঝার আগে দোতলায় উঠে যায়। ঘড়ি ধরে মাত্র পাঁচ মিনিট তারা সেখানে ছিল। জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু তনয়কে নির্মমভাবে কুপিয়ে আহত করে। একই পথ ধরে চলে যায়। ডলফিন গলি থেকে ঘটনাস্থল প্রায় ৩০০ গজের মতো। সেখান দিয়ে তারা চলে যায়।ঘটনার খবর পেয়ে সাত মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় জানিয়ে পুলিশ কমিশনার বলেন, সেখানে একজন এসআই ও এএসআই মমতাজ তাদের প্রতিরোধ করে। তখন মমতাজকে সন্ত্রাসীরা চাপাতি দিয়ে কোপায়।সন্ত্রাসীরা চলে গেলেও পুলিশ তাদের একটি ব্যাগ রেখে দিতে সক্ষম হয়েছে। সেখানে একটি পিস্তল, একটি মোবাইল, কিছু আরবি লেখা কাগজপত্র পাওয়া গেছে। যে পথ দিয়ে গিয়েছে সেখানের কিছু ফুটেজও পাওয়া যায়, সেটি পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও খুনিদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারাকে পুলিশের ব্যর্থতা বলতে নারাজ ডিএমপি কমিশনার।

এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ গুলি চালালেও তাদের গায়ে লাগেনি। কারণ ওই সময় আসরের নামাজ শেষে রাস্তায় মুসল্লিরা বেরিয়ে যায়। তখন সন্ত্রাসীরা জনগণের ভিড়ে হারিয়ে যায়। এটি ব্যর্থতা বলব না, দুঃখজনক বলব।পুলিশ সদস্যরা যখন এক খুনিকে জাপটে’ ধরল তখন মানুষ সহযোগিতা করলে তাদের ধরা যেত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।এই ঘটনাকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এদের শনাক্ত করতে চৌকস কর্মকর্তারা কাজ করছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে।অতীতে ঘটনাগুলো যেভাবে ডিটেকশন করেছি। এটিও করব। এতে আতঙ্কগ্রস্ত হবার কিছু নেই।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, দেশের এক ধরনের বিপথগামী লোক যারা দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি করতে, অশান্তি তৈরি করতে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড করে দেশে নৈরাজ্য তৈরি করতে একটা অপপ্রয়াস কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে করছে। সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে আমাদের কলাকৌশল আছে। নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে সফলতা রয়েছে।বর্তমানে যা ঘটছে এটিও উদঘাটন হবে। অপরাধীদের শনাক্ত করে ধরে আইনের আওতায় আনতে পারব। সেজন্য কিছুটা সময় দিতে হবে। জঙ্গিবাদ দমনে সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, দেশবাসীকে অনুরোধ করব জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে। জঙ্গিরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে সাময়িকভাবে বাসা ভাড়া নিচ্ছে। বাসা ভাড়া নেবার সময় তথ্য থাকলে তারা অপরাধ করতে পারবে না। যদি করে তাদের উদঘাটন করা যাবে।আনসার আল ইসলাম-এর এই হত্যার দায় স্বীকার নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে দায় স্বীকার করা হয়। এর যৌক্তিকতা এবং বাস্তবতা কতটুকু আছে, তা ভেবে দেখা দরকার। এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।