ক্রিকেটের যে রেকর্ডগুলো সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখনো টিকে রয়েছে

ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। অন্য ভাবে বলতে গেলে ক্রিকেট হচ্ছে রেকর্ড ভাঙ্গা আর গড়ার খেলা। যার ধারাবাহিকতায় প্রতিনিয়ত তৈরী হয় নতুন নতুন রেকর্ড, তৈরী হয় নতুন নতুন ইতিহাস। বিশ্ব ক্রিকেটে গত কিছুদিনের রেকর্ড ভাঙার খেলাও এখন একটা খেলায় রূপ নেয়েছে। বিশেষ করে বিগত বছরগুলোতে খেলার সংখ্যা এত বেড়েছে যে রেকর্ড বইয়ে নাম লেখাচ্ছেন অনেক ক্রিকেটার নিত্য নতুন করে। আর, রেকর্ড গড়াই হয় ভাঙার জন্য। কিন্তু বিশ্ব ক্রিকেটে এমন অনেক রেকর্ড আছে যেগুলো সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখনো টিকে রয়েছে । তার কয়েকটির বয়স তো একশও পার করেছে।

চলুন জেনে নেয়া যাক তেমনই কিছু রেকর্ডের কথা…

দলীয় রানের তিন ভাগের দুই ভাগই তার!

এ রেকর্ডের বয়স টেস্ট ইতিহাসের সমান। ইতিহাসের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেই অনেক গুলো রেকর্ড করে ফেলেছিলেন চার্লস ব্যানারম্যান । টেস্ট ইতিহাসের প্রথম বলের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। প্রথম রান নিয়েছেন তিনি। এমনকি প্রথম শতকও তার! এসব রেকর্ড তো কারও পক্ষেই ভাঙা সম্ভব নয়। কিন্তু আরেকটি রেকর্ড করেছিলেন চার্লস, ১৩৮ বছর পরও যেটি অধরা রইল সবার জন্য। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসের সংগ্রহ ছিল ২৪৫, যার ১৬৫ রান এসেছিল চার্লসের ব্যাট থেকে। দলের ৬৭ শতাংশ রান কেবল একজন ব্যাটসম্যানের ব্যাট থেকে এসেছে! দলীয় ২৪০ রানের মাথায় ইনজুরির কারণে মাঠ না ছাড়লে রেকর্ডটি আরও বড় হতেই পারত। তবে ততক্ষণে তিনি দলের হয়ে দুই তৃতীয়াংশ রান সংগ্রাহক হয়ে গেছেন। এই রেকর্ড ভাঙতে পারেননি এখনো কেউ।

অভিষেকে সেরা বোলিং রেকর্ড!

টেস্ট অভিষেকে চমক দেখিয়েছেন অসংখ্য ক্রিকেটার। বিশেষ করে বোলারদের টেস্ট অভিষেকের পারফরম্যান্স তো অধিকাংশ সময় হয় চমক জাগানিয়া। বারবার অচেনা ঘাতকে কাঁটা পড়েছেন অসংখ্য ব্যাটসম্যান । তারপরও অভিষেকে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডের বয়স ১২০ বছর হয়ে গেল। অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ড দলের দ্বিতীয় ইনিংসে অ্যালবার্ট এডউইন ট্রট যখন বোলিং করতে এলেন তখনো বোঝা যাইনি কি হতে যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই। প্রথম ইনিংসে উইকেট শূন্য থাকা এই ডানহাতি দ্বিতীয় ইনিংসে ২৭ ওভার বল করে ৪৩ রানের বিনিময়ে ৮ উইকেট তুলে নেন। অস্ট্রেলিয়ান এই বোলারের রেকর্ড ১২০ বছর পরেও অক্ষুণ্ন রয়েছে । এই রেকর্ড ভাঙার কাছাকাছি কেবল তাঁর স্বদেশি বব মেসি যেতে পেরেছিলেন। তাও সেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ৭৭ বছর পর অভিষিক্ত বব ৮ উইকেট নিয়েছিলেন ৫৩ রানের বিনিময়ে।

অভিষেকে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড!

অভিষেকে ব্যাট করতে নেমে অনেক ব্যাটসম্যান স্নায়ুচাপে ভোগেন বলে শোনা যায়। ইংলিশ ব্যাটসম্যান রেজিন্যাল্ড ফস্টার অবশ্য এই সব স্নায়ুচাপ চাপ-টাপের ধার ধারতেন না। ১৯০৩ সালে সিডনি টেস্টে ব্যাট ৩ উইকেট পরার পর ব্যাট করতে নেমেছিলেন। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন মাঠ ছেড়ে যাচ্ছেন তখন তাঁর নামের পাশে ২৮৭ রান! মাত্র ১৩ রানের জন্য ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ত্রিশতক হাঁকানোর রেকর্ড হাত ফসকে যায়। সেই সঙ্গে অভিষেকে ত্রিশতক হাঁকানোর অবিস্মরণীয় এক রেকর্ডও হাত ছাড়া করেন তিনি। কিন্তু অভিষেকে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ১১১ বছর পরেও তাঁর বগলদাবা। অভিষেকে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় দ্বিতীয় স্থান দক্ষিণ আফ্রিকান জ্যাক রুডলফের । বাংলাদেশের সঙ্গে চট্টগ্রামে টেস্ট অভিষেকে ২২২ রানে অপরাজিত ছিলেন তিনি।

৬৭৫ রানে হার!

ছোট মাঠ, ভারী ব্যাট আর বোলিংয়ে হাজারো শৃঙ্খল মিলিয়ে ক্রিকেটে এখন ব্যাটসম্যানদের জয়জয়কার। ক্রিকেট মানেই এখন রান আর রান। কিন্তু রানের হিসেবে সবচেয়ে বড় জয়ের রেকর্ডের বয়স কিন্তু প্রায় শতবর্ষ হতে চলেছে। ১৯২৮ সালের ব্রিসবেন টেস্টে ইংল্যান্ড ৬৭৫ রানে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর ৮৭ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু এই রেকর্ড এখনো ভাঙা যায়নি। ইনিংসে জেতার রেকর্ডের বয়স অবশ্য একটু কম। আজ থেকে ৭৭ বছর আগে ওভালে ইংল্যান্ড তাঁদের চিরশত্রু অস্ট্রেলিয়াকেই ইনিংস এবং ৫৭৯ রানে হারিয়েছিল। সে রেকর্ডও এখনো অক্ষুণ্ন।

২৬ রানেই অলআউট!

টেস্টে সর্বনিম্ন রানে গুটিয়ে যাওয়ার রেকর্ড কোন দলের জানেন? না, বিশ্ব ক্রিকেটে যাদের টেস্ট খেলার সামর্থ্য নিয়ে সর্বদা আলোচনা হয় – মানে ছোট কোন দল নয়! এই রেকর্ডের মালিক নিউজিল্যান্ড। ৬০ বছর আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেদের মাটিতে ২৭ ওভার ব্যাটিং করে ২৬ করতে পেরেছিল। দলীয় সর্বনিম্ন রানের এই রেকর্ড গত ছয় দশক ধরে নিউজিল্যান্ড বহন করছে। গত ষাট বছরে অন্য কোনো দলের ইনিংস ৪০ রানের নিচে গুটিয়ে যায়নি।

গড় ৯৯.৯৪!

টেস্ট ক্রিকেটের রানের রেকর্ড নিয়ে কথা হবে আর স্যার ডন ব্র্যাডম্যান সেখানে আসবেন না এটি অসম্ভব। ১৯৪৮ সালে ওভাল টেস্টে শেষবারের মতো ব্যাট করতে নামার সময় খুব সহজ একটি সমীকরণ ছিল ব্র্যাডম্যানের সামনে। মাত্র ৪ রান করলেই ক্যারিয়ার শেষ করবেন ১০০ গড় নিয়ে। কিন্তু উইলিয়াম হোলিসের বলে শূন্য রানে ফিরে যান তিনি। তারপরও তাঁর ব্যাটিং গড় দাঁড়ায় ৯৯.৯৪! এরপর ৬৭ বছর হতে চলল, ব্যাটিং গড়ে ব্র্যাডম্যানের ধারে কাছেও কেউ যেতে পারেননি।

ডন ব্র্যাডম্যানের আরেকটি রেকর্ডও এখনো অক্ষুণ্ন। নিজের ক্যারিয়ারে ৮০ ইনিংসে ব্যাট করেছেন , তাঁর ২৯ ইনিংসেই শতক হাঁকিয়েছেন। প্রতি ২.৭৬ ইনিংসে একটি শতরান! এই রেকর্ড ও অক্ষুণ্ন আছে গত ৬৭ বছর ধরে।

সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি!

ওয়ানডে ও টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ওয়ানডে ও টেস্ট দুই ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ শতকের মালিক। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩৪৩৫৭ এবং ঠিক ১০০ টি শতক নিয়ে যে রেকর্ড গড়েছেন ভারতের ‘লিটল মাস্টার’, সেটিও হয়তো এমনই এক রেকর্ডে রূপান্তরিত হচ্ছে। ব্র্যাডম্যানের টেস্ট গড়ের মতো যে রেকর্ড ভাঙার স্বপ্ন দেখা যায় কিন্তু বাস্তবে করে দেখানো প্রায় অসম্ভব। নিকট ভবিষ্যতে এই রেকর্ড ভাঙার কোনো সম্ভাবনা নেই। কে জানে হয়তো ১০০ বছর পরেও যখন ‘যে রেকর্ড অটুট এখনো’ এর তালিকা তৈরি হবে, সেখানে শচিন টেন্ডুলকারের নাম জ্বলজ্বল করবে ।