বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারে টাস্কফোর্স

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক থেকে চুরি হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার উদ্ধারের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।বুধবার এ টাস্কফোর্স গঠন করে অর্থ মন্ত্রণালয়।ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমানকে টাস্কফোর্সের প্রধান ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের মহাব্যবস্থাপককে সদস্য সচিব করা হয়েছে।চুরি হওয়া রিজার্ভ উদ্ধারে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করাই হলো টাস্কফোর্সের প্রধান কাজ।গত ৪ থেকে ৮ ফেব্র“য়ারির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশের রিজার্ভের ১০০ কোটি ডলার চুরির চেষ্টায় ৩৫টি ভুয়া সুইফট কোড পাঠায় হ্যাকাররা।

এর মধ্যে ৩০টি আটকে গেলেও একটি কোডের মাধ্যমে ২ কোটি ডলার চলে যায় শ্রীলংকার প্যান এশিয়া ব্যাংকের শালিকা ফাউন্ডেশনের অ্যাকাউন্টে। চারটি কোডের মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চলে যায় ফিলপাইনের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি)চারটি অ্যাকাউন্টে।ডয়চে ব্যাংকের মাধ্যমে শ্রীলংকায় যাওয়া অর্থ স্থানান্তরের সময় শালিকা ফাউন্ডেশনের বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হলে ডয়চে ব্যাংক বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চায়।এতে বেরিয়ে আসে,অর্থ স্থানান্তরের অনুরোধটি ছিল ভুয়া।এ কারণে ওই অর্থ বাংলাদেশকে ফেরত দেয় ওই ব্যাংকটি।

এদিকে ঘটনা জানার পরও বিষয়টি গোপন রেখে চুরি হওয়া অর্থ ফেরত আনতে গত ১৬ ফেব্র“য়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান ফিলিপাইনের ব্যাংকো সেন্ট্রালের গভর্নর আমান্ডো টেটাংকো জুনিয়রের কাছে সহযোগিতা চেয়ে চিঠি লেখেন।এরপর গত ২৯ ফেব্র“য়ারি ফিলিপাইনের দৈনিক দি ফিলিপিন্স ডেইলি ইনকোয়ারারের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির খবর জানায়। এরপর বাংলাদেশী সংবাদমাধ্যমেও এ খবর এলে তোলপাড় শুরু হয়।পরে গত ৭ মার্চ অর্থমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে এ ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানায়নি। তিনি সংবাদমাধ্যম থেকে ঘটনা জেনেছেন।ওই দিনই বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা চুরির ঘটনা স্বীকারের পাশাপাশি দাবি করে, দেশের বাইরে থেকে হ্যাকাররা অর্থ চুরি করেছে।

কিন্তু,সংবাদমাধ্যমের একাধিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, যেভাবে টাকা চুরি হয়েছে তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে।এর মধ্যে ১০ মার্চ চার দিনের সফরে দিল্লি যান গভর্নর আতিউর রহমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এতবড় ঘটনার পরেও তার এ সফর বিতর্ক উস্কে দেয় এবং তার দায়িত্বহীনতার বিষয়টি জোরেশোরে আলোচিত হয়।উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত ১৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে বিদায়ী গভর্নর আতিউর রহমানের বিরুদ্ধে বিচার দেন অর্থমন্ত্রী। পরদিন মন্ত্রিসভার বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আতিউরের ব্যাপার কথা বলেন তিনি।এরপর ১৫ মার্চ সাড়ে ১১টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন গভর্নর আতিউর রহমান।

একই দিন দুই ডেপুটি গভর্নর মো. আবুল কাশেম ও নাজনীন সুলতানাকে অপসারণ করা হয়। ওএসডি করা হয় অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলমকেও।গত ১৭ মার্চ নতুন গর্ভনরের দায়িত্ব পান সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির।

তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে গত ২৭ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান, ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, দেশটির মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কাউন্সিলের প্রধান ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধিকে চিঠি লেখেন। এরপর ঘটনার জন্য প্রধান সন্দেহভাজন চীনা বংশোদ্ভূত ফিলিপিনো ব্যবসায়ী কিম অং দুই দফায় চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে ৫৪ লাখ ৬০ হাজার ডলার ফেরত দেন।কিন্তু এই অর্থও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দেয়নি ফিলিপিনো কর্তৃপক্ষ।ফিলিপাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জন গোমেজ জানিয়েছেন, উদ্ধার হওয়া কিছু অর্থ ফেরত পেতে সময় লাগবে।বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট থেকে চুরির ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ফিলিপাইনে পাচারের অভিযোগ নিয়ে দেশটির সিনেট কমিটির পঞ্চম দিনের শুনানিতে রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন আরসিবিসি’র সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মায়া দেগুইতো কোম্পানির আরও কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।

শুনানিতে মুখোমুখি হয়েছেন ঘটনার দুই প্রধান আলোচিত চরিত্র ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অং এবং রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন আরসিবিসি’র সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মায়া দেগুইতো। তাদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেছে দেশটির অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি)। দে গুইতোর বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি বলেছেন, গত ফেব্র“য়ারির ৫ তারিখে বাংলাদেশ থেকে চুরি যাওয়া রিজার্ভের টাকা তার একাউনন্টে এলেও সেটা তোলার জন্য তিনি তাড়াহুড়া করেননি। বরং তিনি সাথে সাথে কোম্পানির আঞ্চলিক সেলস ডিরেক্টর ব্রিগেট ক্যাপেনা, আরসিবিসির কার্যনির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট রাউল ট্যানকে জানিয়েছেন। তারপরেই ফেব্র“য়ারির ৯ তারিখে তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল টাকা ব্যাংক থেকে তোলার জন্য। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের কোন পূর্ব ঘোষণা এবং কাগজপত্র ছাড়া ঐ টাকা তার একাউন্টে দেখে তিনি নিজেও বিস্মিত হয়েছিল। টাকা পেয়েও তিনি ব্যাংকের কাস্টমার রিলেশন অফিসার আঙ্গেলা টরেসকে বলেছিলেন ইমেইলে ঐ টাকার চালানপত্র পাঠানোর জন্য যাতে ঐ ফান্ডের সমস্ত তথ্য থাকবে। তিনি দুপুর দুইটার দিকে ইমেইল পাঠালেও উত্তর পেতে পেতে ৬টা বেজে যায়।

এদিকে টাকা তার একাউন্টে আসার কয়েক ঘণ্টা পরেই তিনি ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অং এর ফোন কল পান। সেখানে তাকে নির্দেশনা দেয়া হয় ঐ ডলার ভাঙ্গিয়ে সমপরিমাণ অর্থ ব্লুমবেরি হোটেল এবং ইস্টার্ন লেইজুরের ঠিকানায় পাঠাতে বলা হয়।সন্ধ্যায় তার কোম্পানির জেলা প্রধান নেসটর পিনেডা তাকে ফোন করে একাউন্ট আটকে রাখতে পারবে কিনা। তিনি তখন তার আরেক বস সেলস ডিরেক্টর ব্রিগেট ক্যাপেনাকে ফোন করে পিনেডার একাউন্ট আটকে রাখার অনুরোধের কথা বলেন। কিন্তু ফেব্র“য়ারির ৯ তারিখে ব্যাংক থেকে ফিরতি চালানের কাগজ আসার আগেই টাকার আদান প্রদানের কাজ শুরু হয়ে যায়। এদিকে, ফিলিপাইনের ব্যুরো অব ইন্টারনাল রেভিন্যু (বিআইআর) কমিশনার কিম হেনারেস মঙ্গলবার সিনেটের ব্লু রিবেন কমিটির কাছে প্রকাশ করেন যে, ফিলিপাইন রেমিটেনস কোম্পানি (ফিলরেম) অর্থ প্রেরনকারী সংস্থা হিসেবে অনুমোদিত ছিল না।

রিজার্ভ পাচারের বিষয়ে এর আগের চার দফা শুনানিতে এ পর্যন্ত অভিযুক্ত হিসেবে উঠে এসেছে চীনা ব্যবসায়ী কিম অং, ওয়েক্যাং জু, উইলিয়াম গো, ফিলিপিন্স ব্যাংক আরসিবিসি’র মায়া দেগুইতো, অ্যাঞ্জেলা তোরেস ও লোরেনজো ট্যান এবং বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান ফিলরেমের প্রেসিডেন্ট সালুদ বাতিস্তার নাম।

এছাড়াও চীনের দুই ক্যাসিনো অপারেটর গাও এবং দিং- অর্থ পাচারের এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলেও জানিয়েছেন চীনা ব্যবসায়ী কিম অং।সোমবার মায়া দেগুইতো এবং তার আইনজীবী ফার্দিনান্দ টোপাকিও’র বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছেন আরসিবিসি’র প্রেসিডেন্ট লোরেনজো ট্যান। ইতিমধ্যেই মিস দেগুইতোসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ফিলিপাইনের এন্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল।