চলচ্চিত্র নির্মাতা খালিদ মাহমুদ মিঠুকে

বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা খালিদ মাহমুদ মিঠুকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ফুলেল শ্রদ্ধায় চির বিদায় জানালেন।কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীগণ এবং বিএফডিসিতে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিল্পী-কলাকুশলীরা তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান।বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে দ্বিতীয় নামাজে জানাজার পর বিএফডিসি ও চ্যানেল আই ভবন কার্যালয়ে আরো দু’দফা জানাজা শেষে বনানী করবস্থানে চিত্রশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক খালিদ মাহমুদ মিঠুর দাফন সম্পন্ন হয়।বুধবার বিকেল ৪টার দিকে খালু আবজাল আহমেদ রানার কবরে তার দাফন সম্পন্ন হয়। কবর নম্বর ১৭৯৮/৮৯।আগামী শুক্রবার (১১ মার্চ) বাদ আছর ধানমন্ডি-৪ এ খালিদ মাহমুদ মিঠুর বাসভবনের কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে।

একই দিনে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে তার চতুর্থ ও শেষ নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। তৃতীয় জানাজা সম্পন্ন হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (এফডিসি) প্রাঙ্গণে। এছাড়া বাদ জোহর দ্বিতীয় জানাজা সম্পন্ন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। এরপর তার মরদেহ এফডিসিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মিঠুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন চলচ্চিত্রকর্মী, শিল্পী ও কলাকুশলীরা।এর আগে সোমবার (০৭ মার্চ) বাদ মাগরিব ধানমন্ডি-৪ এ খালিদ মাহমুদ মিঠুর বাসভবনের সামনে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে মরদেহ বারডেম জেনারেল হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়প্রয়াতের পরিবার ও স্কুল জীবনের বন্ধুদের যৌথ উদ্যোগে আগামী ১১ মার্চ, শুক্রবার বাদ আছর ধানমন্ডির ৪ নম্বর রোডের তার ৩৬/১ নম্বর ফ্ল্যাটে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এতে তার বন্ধু, স্বজন ও গুণগ্রাহি সবাইকে পরিবারের পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে।মৃত্যুকালে তিনি সহধর্মিনী বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী কনকচাঁপা চাকমা, পুত্র আর্য শ্রেষ্ঠ ও কন্যা শিরোপা পূর্ণাকে রেখে গেছেন।

শহীদ মিনার ও চারুকলা অনুষদে তার মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসে শিল্পকলা ও চলচ্চিত্র জগতের বিশিষ্টজনেরা এ মৃত্যুকে অনাকাঙ্খিত বলে উল্লেখ করেন। বিশিষ্টজনেরা বলেন, জাতির জন্য তিনি দেশ-বিদেশ থেকে অনেক সুনাম কুড়িয়ে এনেছেন এবং আগামীতেও জাতিকে তার আরো অনেক কিছু দেবার ছিল। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি শুধু তার পরিবারেরই নয়, দেশেরও অপূরণীয় ক্ষতি করে দিল। ধানমন্ডি ৪ নম্বর রোড দিয়ে চলার পথে একটি গাছ উপড়ে পড়ে কেড়ে নিল তার তাজা প্রাণ। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তাই বিশিষ্টজনদের দাবি, আর যেন কাউকে এমন ভাগ্য বরণ করতে না হয়। সেদিকে নজর দিয়ে নগরীর বয়োবদ্ধ ও দুর্বল গাছগুলো উপড়ে ফেলার জন্য তারা নিবেদন জানান।কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে শ্রদ্ধানুষ্ঠানে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ তাকে ফুলেল শ্রদ্ধায় সিক্ত করেন। সেখানে তার স্মরণে দাাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতাও পালন করা হয়।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বের শুরুতেই এ গুণী শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। এরপর একে একে শ্রদ্ধা জানান নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, ড. এনামুল হক, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নেত্রী মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবীর, নিজেরা করি’র খুশী কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, আদিবাসী ফোরামের নেতা সঞ্জিব দ্রং, গ্যালারি চিত্রকের শিল্পী মনিরুজ্জামান, শিল্পী আবুল বারক আলভী, শিল্পী মোখলেসুর রহমান, অভিনেতা শংকর সাজওয়াল, অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম, কবিতা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সামাদ ও কবি তারিক সুজাত, চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, প্রয়াত মিঠুর স্কুল জীবনের বন্ধুগণ, শিল্পী হাসেম খান, নাট্যজন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ও সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফসহ আরো অনেকে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এ নির্মাতাকে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আরো শ্রদ্ধা জানায় ভারতীয় হাইকমিশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি, বটতলা, কচিকণ্ঠ উচচ বিদ্যালয়, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, কিরিয়া প্রিন্ট ফাউন্ডেশন, গেন্ডারিয়া কচিকাঁচার মেলা, পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজেলা পরিষদ, গানের দল মাদল, বাংলাদেশ আদিবাসী কালচারাল ফোরাম, রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, চিপাচস, ঢাকা ফটোগ্রাফিক ইনস্টিটিউট, স্যার জন উইনসন স্কুল, ¯্রােত, বাংলাদেশ সঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ, গীতাঞ্জলি, গ্যালারি কসমস, শিল্পকলা একাডেমীসহ আরো বিভিন্ন সংগঠন।

শহীদ মিনার থেকে তার মরদেহ বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চারুকলার শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিল্পীরা তাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। চারুকলা অনুষদের পক্ষে ডিন শিল্পী নিসার হোসেইন, শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, চলচ্চিত্র নির্মাতা মোর্শেদুল ইসলাম, চলচিচত্র নির্মাতা ক্যাথরিন মাসুদ, শিল্পী ও অভিনেত্রী বিপাসা হায়াৎ, কবি নাসির আহমেদ তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়া শান্ত মারিয়াম ফাউন্ডেশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ, স্বাধীনতা চারুকলা সংসদ, ঢাবি চারুকলা অনুষদের মৃৎ বিভাগ, সমকাল শিল্পী গোষ্ঠী, গ্যালারি টুয়েন্টি ওয়ান, চারুকলার অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগ, চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগ, চারুকলার প্রিন্টমেকিং বিভাগ, ঢাবি টেলিভিশন ও চলচিচত্র অধ্যায়ন বিভাগ, গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগ এলামনাই এসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ চারুকলা অনুষদ এ শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

বাদ জোহর ঢাবির কেন্দ্রীয় মসজিদে এ চিত্র নির্মাতা ও শিল্পীর দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে সেখান থেকে তার মরদেহ বিএফডিসিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও চলচিচত্র পরিচালক ও শিল্পী-কলাকুশলীরা তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান এবং তৃতীয় নামাজে জানাজায় শরীক হন। বিএফডিসি থেকে তার মরদেহ চ্যানেল আই ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও তার আরেকটি নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। পরে বিকেলে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

সহধর্মিনী কনকচাঁপা চাকমা বলেন, জন্ম যখন আমাদের হয়েছে, একদিন মরতেও হবে। সেটা হোক সময়ে বা অসময়ে। তবে মিঠু অসময়েই চলে গেলেন। নানা চড়াই-উতড়াই পাড়ি দিয়ে যখন তার সাফল্য আসা শুরু হয়েছিল, তখনই তিনি চলে গেলেন। বলা যায়, তার কাজের স্বর্ণ যুগেই তাকে নিয়তির কাছে আত্মসমপর্ন করতে হলো। তিনি বলেন, তার চলে যাওয়া মেনে নেয়া যায় না। এটা আমার ও আমার পরিবারের, নাকি দেশের দুর্ভাগ্য বলতে পারব না। এভাবে যেন আর কাউকে চলে যেতে না হয়, এ জন্য তিনি সিটি কর্পোরেশনের সচেতনতা আশা করেন।

দুঃখ করে এ শিল্পী আরো বলেন, আমার দু’সন্তান এখনও ছোট। তাদের ভবিষ্যত মিঠু গড়ে দিয়ে যেতে পারল না। এখন তাদের মা বলতেও আমি, বাবা বলতেও আমি। আমাকেই তাদের ভবিষ্যত গড়তে হবে। এ জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই, আমি যেন তাদের বাবার মত করেই তাদের গড়ে তুলতে পারি।

রামেন্দু মজুমদার বলেন, এমন মৃত্যু অগ্রহণযোগ্য। কেবল পরিবারের জন্য নয়, সকলের জন্য। মিঠু যদিও চিক্রকর ছিলেণ, তবে চলচ্চিত্র ও নাটকে তার আগ্রহ ছিল বেশি। যখন তার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু পাওয়ার ছিল, তখনই তিনি চলে গেলেন। এটা দুঃখজনক। তার কাজের মদ্যদিয়ে দেশ অনেক সমৃদ্ধ হতে পারত। তিনি বলেন, তার দুই সন্তানও অনেক মেধাবী। আশা করব, তার দুই সন্তান বাবার অসমাপ্ত কাজ শেষ করবে।

সঞ্জীব দ্রং বলেন, কনকচাঁপা দিদির কারণে মিঠু দা আমাদের পাহাড়িদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। তার চিত্রকর্ম ও চলচিচত্রে আমাদের জীবনের সুখ, দুঃখ ও হাসি-কান্নার নানা চিত্র উঠে এসেছে। তিনি বলেন, এ সাংস্কৃতিক পরিবার আগামীতেও দেশের সংস্কৃতিতেও অবদান রাখবে। আমরা পাড়াড়িরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি।